রাজধানীর মগবাজারের মীরবাগ। সেখানে রমনা রেলওয়ে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অস্তিত্ব শুধু সাইনবোর্ডে। বিদ্যালয়ের জন্য কেনা পাঁচ কাঠা জমিতে গড়ে উঠেছে পুরোদস্তুর কাঁচাবাজার। বিদ্যালয়ের বেদখল জমিতে থাকা সেমিপাকা দোকানগুলো থেকে ভাড়া তুলছেন স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা।
কেবল মীরবাগের এই বিদ্যালয়ের নয়, রাজধানীর আরও ২৯টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জমি বেদখল হয়ে গেছে। বেদখল জমির পরিমাণ ১৭ বিঘার বেশি। ১৬টি বিদ্যালয়ের জমি দখল করেছেন প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। ৫টির জমিতে পানির পাম্প করেছে ঢাকা ওয়াসা। বাকি জমি গেছে অন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বাজার, বস্তি, দোকান এবং ধর্মীয় স্থাপনায়। এ ছাড়া দুটি বিদ্যালয়ের জমি নিয়ে মামলা চলছে। একটির জমির নামজারি নিয়ে জটিলতা রয়েছে।
জানতে চাইলে ঢাকার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) মমতাজ বেগম আজকের পত্রিকাকে বলেন, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জমি উদ্ধারে ইতিমধ্যে সংশ্লিষ্ট থানার সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) প্রতিবেদন পাঠাতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদন পেলে বিধি অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ঢাকা মহানগরে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে মোট ৩৪২টি। এগুলো ১২টি শিক্ষা থানার অধীনে পরিচালিত হয়। বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থী রয়েছে দেড় লাখের বেশি। প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাজধানীতে সবচেয়ে বেশি সাতটি বিদ্যালয়ের জমি বেদখল হয়েছে ডেমরা শিক্ষা থানায়। মতিঝিলে ছয়টি, মিরপুরে পাঁচটি, কোতোয়ালিতে চারটি, সূত্রাপুরে চারটি, মোহাম্মদপুরে তিনটি, রমনার একটি, তেজগাঁওয়ে একটি, ধানমন্ডিতে একটি এবং লালবাগ শিক্ষা থানার একটি বিদ্যালয়ের জমি দখল হয়ে গেছে।
নথিপত্র বলছে, ২০১৪ সালে ২৮টি বিদ্যালয়ের বেদখল হওয়া জমির পরিমাণ ছিল ২৪০ দশমিক ৯৫ শতাংশ বা সাড়ে ৭ বিঘা। বেদখল জমি উদ্ধারে ব্যবস্থা নিতে ওই বছর ঢাকার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে প্রতিবেদন পাঠিয়েছিল জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয়। এরপর কিছু জমি উদ্ধার হলেও একপর্যায়ে উদ্ধার থেমে যায়।
পরে অন্যান্য বিদ্যালয়ের জমিও দখল হতে থাকে। ২০২৩ সালে জমি বেদখল হওয়া বিদ্যালয়ের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩০টি এবং বেদখল জমির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৫৭২ দশমিক ১৫ শতাংশ বা ১৭ বিঘার বেশি। অর্থাৎ মাত্র ৯ বছরে বেদখল হওয়া জমির পরিমাণ বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ঢাকা মহানগরের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দখল হওয়া জমি উদ্ধারে ইতিমধ্যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এর অগ্রগতি প্রতি মাসে পর্যালোচনা ও মনিটরিংয়ের জন্য বিষয়টি মাসিক সমন্বয় সভার অ্যাজেন্ডাভুক্ত করা হয়েছে। তাঁর আশা, শিগগির এর সুফল মিলবে।
২০২৩ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৬টি বিদ্যালয়ের জমি ভোগদখল করছেন স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। ৫টি জমিতে বসানো হয়েছে ঢাকা ওয়াসার পানির পাম্প।
শিক্ষা নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী আজকের পত্রিকাকে বলেন, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জমি দখল করেছে সরকারি প্রতিষ্ঠান ঢাকা ওয়াসাও। সরকারি প্রতিষ্ঠানই যদি দখল করে, তাহলে তো লুটেরা গোষ্ঠী সাহস পাবেই। তিনি অবিলম্বে দখলদারদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি এবং বেদখল হওয়া জমি উদ্ধার করে স্কুল কর্তৃপক্ষকে ফিরিয়ে দিতে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান।
২০২৩ সালের প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, সবচেয়ে বেশি জমি দখল হয়েছে ডেমরার ধার্মিকপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের, ৬৯ শতাংশ। ওই জমিতে থাকা বিশাল পুকুরটি দখল করেছেন স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। এ থানা এলাকার আরও ছয়টি বিদ্যালয়ের জমি বেদখল হয়েছে।
মগবাজারের মীরবাগের রমনা রেলওয়ে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পুরো পাঁচ কাঠা জমিতেই এখন কাঁচাবাজার। ২০০৪ সালে বিদ্যালয় করার জন্য এই জমি কেনা হয়েছিল। সরেজমিনে দেখা যায়, সাইনবোর্ড ছাড়া বিদ্যালয়ের কোনো অবকাঠামো নেই। ওই জায়গায় সেমিপাকা কয়েকটি দোকান। স্থানীয় লোকজন জানান, দীর্ঘ দিন খালি পড়ে থাকায় এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তিরা সেখানে কাঁচাবাজার গড়ে তুলেছেন। দোকানগুলো থেকে দিনে ৫ হাজার টাকার বেশি ভাড়া তুলছেন তাঁরা।
এ বিষয়ে রমনা থানা শিক্ষা কর্মকর্তা মোসা. শাহানাজ বেগম আজকের পত্রিকাকে বলেন, জায়গাটি উদ্ধার করে সরকারি বিদ্যালয় স্থাপন, অবকাঠামো উন্নয়নসহ দৃষ্টিনন্দন প্রকল্পের আওতায় বিদ্যালয় ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
মতিঝিল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে তিনটি ভবন। তবে প্রধান ফটক একটাই। ভবনগুলোর একটিতে লেখা মতিঝিল কলোনি উচ্চবিদ্যালয়, আরেকটি ভবনে বসেন থানা শিক্ষা কার্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। আরেকটি ভবনে মতিঝিল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ওই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নুরজাহান হামিদা বলেন, ‘আমাদের জমি দখল করে মতিঝিল কলোনি উচ্চবিদ্যালয় করা হয়েছে। জমি উদ্ধারে উচ্চ আদালতে মামলা চলছে।’ তবে মতিঝিল কলোনি উচ্চবিদ্যালয়ের গভর্নিং বডির সভাপতি শাহ ইস্কান্দার আলী রাজু বলেন, ‘২০০২ সালে তৎকালীন পূর্তমন্ত্রী মির্জা আব্বাস আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠকের মাধ্যমে আমাদের জমি বরাদ্দ দিয়েছেন। জমি দখলের অভিযোগ সত্য নয়। বিষয়টি নিয়ে মামলা চলছে। এর বেশি বলা সম্ভব নয়।’
প্রতিবেদন অনুযায়ী, খিলগাঁও স্টাফ কোয়ার্টার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জমি বেদখল হয়েছে। সরেজমিনে দেখা যায়, বিদ্যালয়ের সামনের অংশে খিলগাঁও গভ. স্টাফ কোয়ার্টার হাইস্কুল এবং পেছনের অংশে রয়েছে কয়েকটি টিনের ছাপরা। প্রাথমিক বিদ্যালয়টির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষক বলেন, বিদ্যালয়ের জমি দখল করেই হাইস্কুল ও ছাপরাগুলো তোলা হয়েছে। ছাপরাগুলো তুলে দখলে রেখেছেন স্থানীয় প্রভাবশালী এক ব্যক্তি। বেদখল জমি উদ্ধারে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, তেজগাঁও থানার বিকে আফতাব মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ১১ শতাংশ জমিতে বসবাস করছে একটি পরিবার। তবে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে বক্তব্য দিতে রাজি হয়নি।
প্রতিবেদন বলছে, খিলগাঁওয়ের আইডিয়াল মুসলিম বালক-বালিকা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের খেলার মাঠে ওয়াসার পানির পাম্প বসানো হয়েছে। মাঠের অভাবে খেলতে না পারায় ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। ওয়াসার পানির পাম্পে জায়গা বেদখল হয়েছে সুরিটোলা মডেল, মাতুয়াইল ২ নম্বর, সারুলিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ধানমন্ডি ১ নম্বর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক শাহ রেজওয়ান হায়াত আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ঢাকা মহানগরের বেশ কিছু সরকারি বিদ্যালয়ের জমি বেদখল হয়ে গেছে। জমিগুলো উদ্ধারে উদ্যোগ নিয়েছি। আশা করছি, শিগগির বেশ কিছু জমি উদ্ধার সম্ভব হবে।