২০১৬ সালের জুলাইয়ে শুরু হয় ‘আইসিটির মাধ্যমে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার প্রচলন (দ্বিতীয় পর্যায়)’ শীর্ষক প্রকল্প। শুরুতে এ প্রকল্পের মেয়াদ ছিল ৪ বছর। পরে দুই দফায় মেয়াদ বাড়িয়ে করা হয় ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত। এতেও কাজ শেষ হয়নি। দীর্ঘ ৭ বছর এ প্রকল্পের অগ্রগতি মাত্র ৮ দশমিক ৬৪ শতাংশ। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর।
একই অবস্থা ১৬০ উপজেলায় আইসিটি প্রশিক্ষণকেন্দ্র প্রতিষ্ঠায় নেওয়া দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রকল্পটিরও। ২০১৭ সালের জুলাইয়ে এ প্রকল্প নেয় বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস)। কয়েক দফা মেয়াদ বাড়ানোর পর ২০২৩ সালের জুনে এটির কাজ শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত অগ্রগতি মাত্র ৩১ শতাংশ।
শুধু এ দুই প্রকল্প নয়, শিক্ষার অধিকাংশ প্রকল্পই বাস্তবায়ন হচ্ছে ধীরগতিতে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, গত অর্থবছরের সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের ৭৩ প্রকল্পের মধ্যে ৩৩টিরই মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু কাজ শেষ হয়নি এখনো। এ অবস্থায় আবারও বাড়ানো হচ্ছে এসব প্রকল্পের মেয়াদ।
প্রকল্পগুলোর ধীরগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (পরিকল্পনা) মো. আব্দুল মতিন ১৩ সেপ্টেম্বর আজকের পত্রিকাকে বলেন, শিক্ষার প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে কেন বিলম্ব হচ্ছে তা চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে সংশ্লিষ্টদের কঠোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
মেয়াদ শেষ হওয়া এসব প্রকল্পের ১৬টিই বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি)। এ ছাড়া শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর ১১টি, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর তিনটি, ব্যানবেইস দুটি এবং বাংলাদেশ স্কাউটস একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।
ইউজিসির অধীনে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পগুলোর এমন ধীরগতির কারণ জানতে চাইলে সংস্থাটির সচিব ড. ফেরদৌস জামান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘অর্থছাড়সংক্রান্ত জটিলতা, অনেক ক্ষেত্রে প্রকল্প পরিচালকের সক্ষমতার অভাব, রেট শিডিউল পরিবর্তন ও অসাধু ঠিকাদারদের কারণে প্রকল্পগুলো যথাসময়ে বাস্তবায়ন হয়নি। প্রকল্পগুলো যেন সময়মতো বাস্তবায়ন হয় সে জন্য মনিটরিং জোরদার করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।’
আর শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মো. দেলোয়ার হোসেন মজুমদার বলেন, ‘করোনা মহামারি, জমিসংক্রান্ত জটিলতা, রেট শিডিউল পরিবর্তন, ডলার-সংকটে নির্মাণসামগ্রীর দাম বাড়াসহ বেশ কিছু কারণে যথাসময়ে প্রকল্পগুলো শেষ করা যায়নি। আমি দায়িত্ব গ্রহণের পর সব সমস্যা কাটিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নের গতি বাড়ানোর জন্য যথোপযুক্ত পদক্ষেপ নিয়েছি। বর্তমানে প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়নের গতি বেড়েছে।’
শিক্ষার প্রকল্পগুলোর নানা সমস্যার তথ্য উঠে এসেছে গত অর্থবছরের (জুলাই ২০২২-২০২৩ জুন পর্যন্ত) উন্নয়ন প্রকল্পসমূহের বাস্তবায়ন অগ্রগতি পর্যালোচনা সভায়। গত ৩১ জুলাই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি। গত ২১ আগস্ট সভার কার্যবিবরণী স্বাক্ষরিত হয়।
ওই কার্যবিবরণী বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২৩ প্রকল্পে পূর্ণকালীন পরিচালক না থাকা, উপাচার্যদের প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব গ্রহণ, অর্থ ব্যয়ের ক্ষমতা প্রয়োগ করতে না পারা, ব্যয়ের সক্ষমতা বিবেচনা না করে এডিপি-আরএডিপি প্রণয়ন, মাঠপর্যায়ের প্রকৃত তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা না করে প্রকল্প প্রণয়ন করাসহ নানা সংকটে ধুঁকছে প্রকল্পগুলো।
ব্যয়ই হয়নি ২ হাজার কোটি টাকা
প্রকল্পের বাস্তবায়ন অগ্রগতি পর্যালোচনা সভায় উঠে আসা তথ্যমতে, গত অর্থবছরে শিক্ষার ৭৩টি প্রকল্পের অনুকূলে বরাদ্দ ছিল ৭ হাজার ২১৮ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে ব্যয় হয়েছে ৫ হাজার ১৫৩ কোটি ৮৭ লাখ টাকা। অর্থাৎ আর বাকি ২ হাজার ৬৪ কোটি টাকা ব্যয় করা যায়নি। এ জন্য জাতীয় অগ্রগতির চেয়ে শিক্ষার প্রকল্পগুলোর অগ্রগতি কম।
এমন প্রেক্ষাপটে চলতি অর্থবছরের শিক্ষার প্রকল্পগুলোর জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয় করা নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। কারণ প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি না হওয়া পর্যন্ত অনেক প্রকল্পের বরাদ্দকৃত অর্থ ছাড় করা যাবে না বলে সভা জানানো হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, চলতি অর্থবছরে গত বছরের চেয়ে ৮৩ শতাংশ বরাদ্দ বেশি। কিন্তু প্রকল্প পরিচালকদের অদক্ষতা, যথাযথ মনিটরিং এবং অনিয়মের কারণে চলতি বছরও প্রকল্পগুলোর অগ্রগতি কম হতে পারে।
প্রকল্প পরিচালকদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্নশিক্ষার প্রকল্পগুলো সময়মতো বাস্তবায়ন না হওয়ায় প্রকল্প পরিচালকদের যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। বিষয়টি নিয়ে কথা হয়েছে প্রকল্পসমূহের বাস্তবায়ন অগ্রগতি পর্যালোচনা সভায়ও। সভায় অতিরিক্ত সচিব (পরিকল্পনা) মো. আব্দুল মতিন বলেন, প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রকল্প পরিচালকদের ব্যবস্থাপনা, ক্রয় প্রক্রিয়া এবং প্রকল্প বাস্তবায়নসংশ্লিষ্ট বিধিবিধান সম্পর্কে জ্ঞানের ঘাটতি থাকায় প্রকল্প বাস্তবায়নে এর প্রভাব প্রতীয়মান। এ জন্য সভায় প্রশিক্ষণ আয়োজনের সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়েছে।