বিশ্বের বহু দেশেই ‘লবিস্ট ফার্ম’-এ কাজের মাধ্যমে আয় বৈধ। সেসব প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন প্রভাবশালী রাজনীতিক, কূটনীতিকসহ বিভিন্ন পেশার অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা। প্রভাবশালী এমন ব্যক্তিদের কাজে লাগিয়ে আন্তর্জাতিক মহলকে প্রভাবিত করার চেষ্টা বাংলাদেশের বড় রাজনৈতিক দলগুলোর জন্যও নতুন কিছু নয়। মাঝেমধ্যেই ব্যাপকভাবে আলোচিত হয় এ ধরনের প্রবণতা।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে প্রভাবিত করতে তৎপর ছিলেন এ ধরনের লবিস্টরা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য এখনো একাধিক লবিস্ট ফার্ম ও ব্যক্তির তৎপরতা চলছে। তাদের মধ্যে ঢাকায় নিযুক্ত সাবেক দুই মার্কিন রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম বি মাইলাম এবং জন ড্যানিলোভিজ এ মুহূর্তে সবচেয়ে সক্রিয় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিভিন্ন সূত্র বলছে, বাংলাদেশে মার্কিন কূটনীতিক হিসেবে কাজ করার সুবাদে রাজনৈতিক ও সুশীল সমাজের পরিচিতির সুযোগ হয় এই দুই মার্কিনির। চাকরি থেকে অবসর নিলেও পেশা হিসেবে বেছে নেন লবিস্ট হিসেবে কাজ করাকে। প্রতিষ্ঠা করেন লবিস্ট ফার্ম। বাংলাদেশে দায়িত্ব পালনকালে তৎকালীন সরকারের ঊর্ধ্বতনদের সঙ্গে সুসম্পর্কের সুবাদে তাদের এখন আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে বিএনপি-জামায়াত ব্যবহার করছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
সরকারের শুভাকাঙ্ক্ষী মহলেরও অভিযোগ, সাউথ এশিয়া পারসপেক্টিভস, রাইট টু ফ্রিডমসহ নানা মাধ্যমে নিবন্ধ লিখে বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক তথ্য দিচ্ছেন ওই দুই কূটনীতিক। উচ্চপর্যায়ে যোগাযোগের সুযোগ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে বাংলাদেশ বিষয়ে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছেন তারা। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিনারে বাংলাদেশ নিয়ে নেতিবাচক বক্তব্য দেন তারা। এ ছাড়া ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাদের বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার জন্য প্রভাবিত করার চেষ্টা করেন। বিএনপি চেয়ারপারসনের ঘনিষ্ঠ এক ব্যক্তি এসব কর্মকাণ্ডে ওই কূটনীতিকদের অর্থ ও তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সহযোগিতা করেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
সূত্র জানায়, ওই দুই সাবেক মার্কিন কূটনীতিককে বাংলাদেশের কে বা কারা সহযোগিতা করছে, সে বিষয়ে সরকারের কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থা নিয়মিত তথ্য সংগ্রহ করে তা সরকারকে অবহিত করছে।
জানা গেছে, এক যুগেরও বেশি সময় ধরে বিএনপি-জামায়াত জোট বিদেশে লবিস্ট নিয়োগ করে কর্মকাণ্ড পরিচালিত করলেও বিষয়টি সামনে আসে ২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)-এর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার পর। এই ঘটনার পর, সরকার এবং ক্ষমতাসীন দলের নেতারা সরকারবিরোধী প্রচার চালানোর জন্য মার্কিন লবিস্টদের জড়িত থাকার দিকে অভিযোগের অঙ্গুলি তোলেন। তারা বলেন, এই লবিস্টরা নিষেধাজ্ঞার পেছনে চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে। এমনকি সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, বিএনপি বিভিন্ন লবিং ফার্মে ৩৭ লাখ ডলার বিনিয়োগ করেছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন গত বছর জাতীয় সংসদে জানিয়েছিলেন, বিএনপি ও জামায়াত যুক্তরাষ্ট্রে মোট ৮টি লবিস্ট ফার্ম নিয়োগ দিয়েছে। তার দেওয়া তথ্যমতে, বিএনপি ২০১৭ সাল পর্যন্ত ৪টি এবং ২০১৯ সালে একটি লবিস্ট ফার্ম নিয়োগ করে। আর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকাতে জামায়াত-বিএনপি ৩টি লবিস্ট ফার্ম নিয়োগ করে। এ বছরের ২৪ মে বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করে যুক্তরাষ্ট্র। এর পর জুন মাসে এক অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরকারবিরোধী বিদেশি লবিস্ট নিয়োগকারীদের উদ্দেশে বলেন, ‘দেশটাকে ধ্বংস করবেন না। দেশ আপনার, আমার, সবার। যারা বিরোধী দলে রয়েছে তাদেরও দেশ এটি। সুতরাং দেশকে ধ্বংস করে লাভ নাই। কারণ ধ্বংস হলে সবার ক্ষতি।’
এরপর গত আগস্ট মাসে এক টুইটে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম অভিযোগ করেন, ‘ঢাকায় নিযুক্ত সাবেক মার্কিন কূটনীতিক উইলিয়াম বি মাইলাম এবং জন ড্যানিলোভিজের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ, তারা নিরপেক্ষ নন তারা কখনও নিরপেক্ষ ছিলেন না। যখন তারা ঢাকায় দায়িত্ব পালন করছিলেন তখনো না। প্রশ্ন হলো, তারা কি এটা বিনামূল্যে করছেন? যদি তা না হয়, তাহলে তাদের টাকা কে দিচ্ছে? ‘কেন’, এর উত্তর আমরা জানি।’
এর জবাবে অবশ্য পাল্টা টুইট করে জন ড্যানিলোভিজ বলেছিলেন, ‘মাননীয় প্রতিমন্ত্রী জানেন যে এটি একটি মিথ্যা এবং এটি দুঃখজনক যে তিনি চরিত্র হননের সঙ্গে জড়িত। আমি বুঝতে পারি যে তাকে কতটা চাপের মধ্যে থাকতে হচ্ছে। বাংলাদেশ এবং এর নাগরিকদের প্রতি আমার ভালোবাসা অকৃত্রিম এবং আমি সেখানে ও অন্যত্র গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রচারে আমার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে চাই।’
জানা গেছে, উইলিয়াম বি মাইলাম ১৯৯০ সালের আগস্ট থেকে ১৯৯৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ঢাকায় রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সে সময় ক্ষমতায় ছিল বিএনপি। কিন্তু বাংলাদেশের সঙ্গে তার সম্পর্ক শুরু হয় আরও আগে ১৯৮৫ সাল থেকে। সে সময় তিনি ছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি, যার দায়িত্ব ছিল বিভিন্ন দেশে আমেরিকার দান-অনুদানের জন্য নিয়োজিত ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ডিপার্টমেন্ট দেখাশোনা করা। আর এই সূত্রে তিনি বাংলাদেশের জন্য গঠিত দাতা সংস্থাগুলোর ক্লাব ‘প্যারিস কনসোর্টিয়ামে’ আমেরিকার প্রতিনিধি হয়ে হাজির থাকতেন। সে সময়ে প্রতিবছর এপ্রিল মাসে শুধু বাংলাদেশের জন্য আমেরিকাসহ পশ্চিমা দাতা দেশগুলোর একটি সমন্বয় বৈঠক বসত, প্যারিসে। বাংলাদেশে কাজ শেষে ১৯৯৮ থেকে ২০০১ পর্যন্ত তিনি পাকিস্তানেও দায়িত্ব পালন করেন। মূলত সে সময় থেকেই মাইলামের মূল পরিবর্তন ঘটে বলে অনেকে বলে থাকেন।
অভিযোগ রয়েছে, মার্কিনিদের পররাষ্ট্রনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, তারা চেষ্টা করে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে যেন প্রতিক্রিয়াশীল এবং মৌলবাদী দলগুলো থাকে এবং আস্তে আস্তে সেই দলগুলো শক্তিশালী হয়। তারা মনে করে, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে যদি মৌলবাদী প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক শক্তি না থাকে তাহলে সেই দেশগুলো আস্তে আস্তে কমিউনিস্টদের দখলে চলে যাবে। কট্টর সমাজতন্ত্রবিরোধী উইলিয়াম বি মাইলাম জঙ্গিবাদ, উগ্রবাদ এবং প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীকে সমর্থন করেন, তাদের মদদ দেন। আর এ কারণেই বিএনপি তাকে বেছে নিয়েছে।
সরকার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে উড্রো উইলসন সেন্টারের সিনিয়র স্কলার মাইলাম আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে সমস্ত তৎপরতার মূলে রয়েছেন। প্রবীণ কূটনৈতিক হওয়ার কারণে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের অন্দরমহলে তার ভালো যোগাযোগ রয়েছে। এটিকে পুঁজি করে বিএনপি-জামায়াতপন্থি ব্যক্তিদের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে তিনি বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে প্রচার করছেন। ১৯৯০ সাল থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত তিনি যখন বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন, তখনো তিনি আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করেছিলেন। মাইলাম বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারেরও বিরোধিতা করেন। তিনি ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে এবং পরে বিভিন্ন মাধ্যমে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে নিবন্ধ লেখেন।
এমনকি ২০২০ সালে করোনা ভাইরাস মহামারি প্রাদুর্ভাবের সময়ে বিএনপিঘেঁষা ও যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এক সংবাদ মাধ্যমের সম্পাদকের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে তথ্য লুকানোর অভিযোগ করেন। মাইলাম ওয়াশিংটনভিত্তিক রাইট গ্রুপ ‘রাইট টু ফ্রিডম’-এর প্রেসিডেন্ট। তিনি সাউথ এশিয়ান পারস্পেক্টিভ ম্যাগাজিনের সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
একই ম্যাগাজিনের দায়িত্ব পালন করেছেন জন ড্যানিলোভিজ। ২০০৭ এবং ২০০৮ সালে সামরিক-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক শাসনামলে ঢাকায় বাংলাদেশে মার্কিন দূতাবাসের ডেপুটি চিফ অব মিশন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ড্যানিলোভিজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিএনপি পক্ষে লবিস্ট হিসেবে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ মেলে ড্যানিলোভিজের টুইট বার্তা থেকে। সেখানে দেখা গেছে, তিনি সক্রিয়ভাবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের বিরোধিতায় নিয়োজিত আছেন।
দক্ষিণ এশিয়া প্রেক্ষিত ম্যাগাজিনে ড্যানিলোভিজের ‘মার্কিন ভিসানীতি : এর পর কি?’ শিরোনামে লেখাটিতেও কৌশলে বর্তমান সরকারের বিরোধিতা করেছেন। তথ্য দিয়ে বিরোধী শিবিরের ভূমিকায় নেমেছেন। তিনি রিটুইট করে বাংলাদেশ অনেকের কড়া জবাব দিয়েছেন যার মাধ্যমে নিজেকে আওয়ামী লীগের বিরোধী হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করেছেন।
অন্যদিকে বিভিন্ন মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে দেখা যায়, মাইলাম তার নিবন্ধ ও সেমিনারের বক্তৃতায় মূলত বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে নিজেকে উপস্থাপন করেছেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তার মূল প্রতিপক্ষ ছিল আওয়ামী লীগ ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
২০১৪ সালের নির্বাচন প্রসঙ্গে মাইলাম বলেন, ‘কোনো বিরোধী দল ছাড়াই আওয়ামী লীগ ২০১৪ সালে একদলের শাসন কায়েম করে।’
মার্কিন দুই কূটনীতিকের এসব তৎপরতা সম্পর্কে আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক শাম্মী আহমেদ বলেন, ‘এটা সত্য যে বিএনপি-জামায়াত অবৈধ অর্থ লগ্নি করে বিদেশে লবিস্ট নিয়োগ করে রেখেছে। তারা প্রতিনিয়ত দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। এর মধ্যে ইউরোপ-আমেরিকায় অনেকেই আছে। এরা দেশের স্বার্থে বিরুদ্ধে কাজ করছে। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে, করবে। আমরা মুক্তিযুদ্ধে যেমন কোনো বিদেশি শক্তির সাহায্য নিয়ে দেশ স্বাধীন করিনি, তেমনি দেশের জনগণ সঙ্গে থাকলে এই শক্তিকেও আগামীতে পরাজিত করব।’