১৯ নভেম্বর ২০২৪, মঙ্গলবার, ০৬:৩০:৩০ অপরাহ্ন
রাজনীতির বাইরে গরম ভেতরে গুমোটভাব
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৩-১০-২০২৩
রাজনীতির বাইরে গরম ভেতরে গুমোটভাব

 দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে রাজনীতির মাঠে সরব বিভিন্ন দল ও জোট। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে ধারাবাহিক আন্দোলনে আছে বিএনপি ও তাদের মিত্ররা। বিপরীতে মাঠ দখলে রাখতে পাল্টা কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। পাশাপাশি চলছে নিয়মিত সাংগঠনিক তৎপরতাও। সেইসঙ্গে নানা ইস্যুতে উত্তপ্ত বাগযুদ্ধ তো আছেই। সব মিলিয়ে নির্বাচন সামনে রেখে গরম হাওয়া দৃশ্যমান। তা সত্ত্বেও দেশি-বিদেশি নানা প্রেক্ষাপটে ভেতরে ভেতরে রাজনীতিতে এক ধরনের গুমোট পরিস্থিতি বিরাজ করছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।


সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন করার বিষয়ে অনড় অবস্থানে রয়েছে আওয়ামী লীগ। অন্যদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি। দাবি পূরণ না হলে দেশে কোনো নির্বাচন করতে দেওয়া হবে না বলেও জানিয়ে দিয়েছে তারা। বড় দুই দলের পরস্পরবিরোধী এমন অবস্থান অবশ্য নতুন নয়। ২০১৪ সালেও একই রকম ঘোষণা দিয়েছিল বিএনপি ও তার মিত্ররা। তবে সেবার নির্বাচন ঠেকাতে পারেনি তারা।


তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি তুলেও ২০১৮ সালে শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেয় বিএনপি। সেই নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও সরকার ও সংসদের স্বাভাবিক কার্যক্রমের ওপর তা কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি।


তবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আগের দুই নির্বাচনের তুলনায় রাজনীতিতে ভিন্ন আবহ বিরাজ করছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, বাংলাদেশের প্রতিটি নির্বাচনের আগেই তৎপর হয়ে ওঠেন পশ্চিমা দেশসহ বিদেশি কূটনীতিকরা। তবে ভিসা নীতিসহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সক্রিয়তার কারণে এবার পরিস্থিতি ব্যতিক্রম হয়ে উঠেছে। সেইসঙ্গে নাগরিক সমাজের কোনো কোনো অংশকে ঘিরে নানা গুঞ্জন সার্বিক পরিবেশকে গুমোট করে তুলেছে।


আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সাম্প্রতিক কিছু বক্তব্যে দেশে আবারও অসাংবিধানিক সরকারকে ক্ষমতায় বসানোর তৎপরতা বা ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত মিলেছে। তার মতে, ‘এক-এগারোর মতো অস্বাভাবিক সরকার আনার চেষ্টায় ষড়যন্ত্র হচ্ছে, এজন্য পরিস্থিতি মোকাবিলায় দলের নেতাদের প্রস্তুত থাকতে হবে।’


বিশ্লেষকদের মতে, বেশ কিছু দিন ধরেই রাজনীতিতে ভেতরে ভেতরে গুমোট পরিস্থিতি চলছে। সুষ্ঠু, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানে পশ্চিমাদের অব্যাহত চাপ, আমেরিকার ভিসা নীতির প্রয়োগ এই গুমোট পরিবেশকে আরও ত্বরান্বিত করেছে। নভেম্বরে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন ও তপশিল ঘোষণার আগের সময় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও মাঠের বিরোধী দলের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আগামী দিনে কী ঘটতে যাচ্ছে, সে সম্পর্কে কোনো আভাস দিতে পারছেন না বিশ্লেষকরা।


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ‘কয়েক মাস ধরেই রাজনীতিতে এই গুমোট পরিস্থিতি বিরাজ করছে। প্রধান দুই দলের মধ্য বাগযুদ্ধ চলছে। একে অন্যকে ছোটখাটো সব বিষয়েই ঘায়েল করতে চাচ্ছে। তবে পুরো বিষয়টি সমাধান হতে পারে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন ও তপশিল ঘোষণার মাধ্যমে।’


রাজনীতিতে এই গুমোট পরিবেশ অনিশ্চয়তায় ফেলেছে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ, প্রভাব ফেলেছে রেমিট্যান্স প্রবাহে। ফলে অস্বস্তিতে আছেন রাজনীতিক, ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষও। তাদের মনে এখন একটাই প্রশ্ন—কী হচ্ছে, কী হবে? সমাধান কোথায়?


আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গতকাল এক বিবৃতিতে বলেন, ‘বিএনপি কখনো জনকল্যাণ এবং মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও ভাগ্যোন্নয়নের রাজনীতি করেনি। সেজন্য বিএনপির রাজনীতি বিদেশি প্রভুদের কৃপানির্ভর! জনগণ, গণতন্ত্র ও কল্যাণকর রাজনীতির প্রতি বিএনপির ন্যূনতম বিশ্বাস থাকলে এদেশের গণতন্ত্রে কোনো সংকট সৃষ্টি হতো না।’


এদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিসা নীতি প্রয়োগের ঘোষণা দেওয়ায় আশাবাদী হয়ে উঠেছে বিএনপিসহ বিরোধীরা। আর সরকারি দলের আচার-আচরণে মনে হচ্ছে, কিছুই হবে না। তবে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা নিয়ে সামাজিকমাধ্যমে প্রচার হওয়া নানা গুজবে অনেক রাজনীতিক, আমলা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ী অস্বস্তির মধ্যে পড়েছেন। কেউ কেউ হয়েছেন বিচলিত।


বাংলাদেশ সম্পর্কে কূটনীতিকদের বক্তব্য, ওয়াশিংটনে পররাষ্ট্র দপ্তরের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে প্রশ্নোত্তর বিরোধী রাজনীতিকদের চাঙ্গা করেছে। তাদের ধারণা, অক্টোবরে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ওপর চাপ অব্যাহত রাখবে। অর্থনীতি আরও স্থবির হয়ে পড়বে। এ জন্য অক্টোবর মাসটা সরকারের জন্যও চ্যালেঞ্জিং। সব মিলিয়ে রাজনীতি ও অর্থনীতিতে কোনো সুখবর নেই। অন্যদিকে বাংলাদেশে মানবাধিকার ইস্যুতে পশ্চিমা বিশ্বের অর্থায়নে চলে এমন দেশি-বিদেশি বেসরকারি সংস্থাও সরকারের ওপর চাপ বাড়াচ্ছে, যা গুমোট পরিবেশ সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা।


যদিও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা আত্মবিশ্বাসী যে, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনেই একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন হবে এবং সেই নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ আবারও সরকার গঠন করবে। এমন মনোভাব বজায় রেখে ক্ষমতাসীন দল নির্বাচনী ইশতেহার প্রণয়নের কাজ শুরু করেছে। প্রতিটি আসনভিত্তিক জরিপ চালিয়ে সম্ভাব্য প্রার্থীদের তালিকা প্রস্তুত করছে। অনলাইন ও অফলাইনে নির্বাচনী প্রচারণার জন্য বিশাল এক কর্মীবাহিনী ও কৌশল প্রস্তুত করছে। মাঠের রাজনীতি দখলে রাখতে ধারাবাহিক কর্মসূচি অব্যাহত রাখার কৌশল নিয়েছে ক্ষমতাসীনরা।


পাশাপাশি গত সাড়ে ১৪ বছরে আওয়ামী লীগ যে উন্নয়ন করেছে আগামীতেও এই ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে, তা উপস্থাপন করতে নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার আগ পর্যন্ত একের পর এক বড় বড় প্রকল্পের উদ্বোধন করা হবে। এসব উন্নয়ন কাজের উদ্বোধনকে কেন্দ্র করে জনসমাগমের মাধ্যমে মাঠ দখলে রাখবে দলটি। শান্তি ও উন্নয়ন সমাবেশ ছাড়াও বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল, পদ্মা রেলসেতু, মেট্রোরেলের মতিঝিল অংশ এবং বঙ্গবন্ধু টানেলের উদ্বোধন উপলক্ষে সুধী সমাবেশ করবে দলটি।


অবশ্য মাঠের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে দলকে চাঙ্গা রাখলেও সরকার দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যেও বিরাজ করছে এক ধরনের সংশয়। সার্বিক পরিস্থিতিতে অনেক প্রশ্নের উত্তর মেলাতে পারছেন না কেউ। তবে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা যুক্তরাজ্য সফর শেষে বুধবার দেশে ফিরলে সব সংশয় দূর হবে বলেও শীর্ষ নেতারা মনে করেন।


আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, ‘বিএনপিসহ বিরোধী রাজনীতিকদের অমূলক কথাবার্তা এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী। সেইসঙ্গে সম্প্রতি প্রয়োগ হওয়া স্যাংশনও কিছুটা দায়ী। তবে শিগগিরই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে, দেশে যথাসময়েই সুষ্ঠু, অবাধ ও শান্তিপূর্ণ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।’


আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম অবশ্য মনে করেন, ‘দেশে গুমোট পরিস্থিতি নেই। কিছু অর্থনৈতিক সংকট আছে, তবে তা গুরুতর কিছু নয়। যারা দেশে উন্নয়ন দেখতে পায় না সেই বিএনপি-জামায়াত জোট দেশে পরিস্থিতি গুমোট, অন্ধকার বলে দাবি করে।’


বিশ্লেষকদের মতে, বিএনপি লাগাতার আন্দোলনে থাকলেও সম্প্রতি তাতে কিছুটা শৈথিল্য এসেছে বলে মনে হচ্ছে। তাদের কর্মসূচির সংখ্যা বাড়লেও নেতাকর্মীদের বাইরে সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততা বাড়াতে পারেনি। ফলে আগামী দিনে তাদের আন্দোলন সহিংস রূপ নেয় কি না-অনেকের মধ্যে সেই আশঙ্কাও দেখা দিচ্ছে।


যদিও বিএনপি নেতাদের দাবি, তাদের আন্দোলন সঠিক পথেই রয়েছে। বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের দাবি, তপশিল ঘোষণার আগেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করতে হবে এবং সেটা অক্টোবর মাসেই। যদিও আন্দোলনসহ সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে বিএনপিতেও বিরাজ করছে গুমোট পরিস্থিতি। কারণ আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে দাবি পূরণে বাধ্য করতে না পারলে নির্বাচন বয়কট করেও কোনো লাভ হবে না। নেতাকর্মীদের মধ্যে দীর্ঘদিন পর ক্ষমতায় যাওয়ার যে স্বপ্ন তৈরি হয়েছে তা পূরণ না হলে তাদের মধ্যে দেখা দেবে চরম হতাশা।


জানতে চাইলে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেন, ‘দেশে এখন একটা তীব্র রাজনৈতিক সংকট তৈরি হয়েছে। এই সংকটটা এতটাই তীব্র যে, গত ৫২ বছরের মধ্যে দেশে এমন রাজনৈতিক সংকট তৈরি হয়নি। এই রাজনৈতিক সংকট থেকে যদি আমরা সন্তোষজনকভাবে বের হয়ে আসতে না পারি, তাহলে এটা যে কোনো পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি করতে পারে, অস্থিরতা বাড়াতে পারে। সংকট এখন যে অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে সেখানে সরকার ও বিরোধী দল যদি কেয়ারটেকার সরকার ইস্যুতে সমঝোতায় পৌঁছাতে না পারে, আগামীতে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন না হয়, তাহলে পরিস্থিতি আরও জটিল হবে।’


সূত্রে জানা গেছে, দুই প্রধান দলের বাইরেও তাদের শরিকদের কর্মকাণ্ডেও কিছুটা স্থবিরতা লক্ষ করা গেছে। বিএনপি নির্বাচনে যাবে কি না-সেটা পরিষ্কার না হওয়ায় সরকারের শরিক দলগুলোর নির্বাচনী প্রস্তুতি থমকে আছে। বিরোধী জোটেও এ নিয়ে আছে নানা অস্বস্তি।


এ বিষয়ে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, ‘আগের প্রতিটি নির্বাচনের আগেই এরকম গুমোট পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। ২০১৪ ও ২০১৮ সালেও হয়েছে। তবে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে এই পরিস্থিতি কেটে যাবে।’


রাজনীতিতে গুমোট পরিবেশের বিষয়ে একমত পোষণ করে গণতন্ত্রী পার্টির সাধারণ সম্পাদক ভৌপেন্দ্র ভৌমিক দোলন বলেন, ‘যতই ষড়যন্ত্র হোক মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি ক্ষমতায় আসবে, তা বিশ্বাস করি না। তবে গুমোট পরিস্থিতি বলছে, সামনের দিনগুলোতে এই শক্তি দেশে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা করবে। ২০০৪ সালে ২৩ দফার ভিত্তিতে ১৪ দলের যাত্রা শুরু হয়েছিল, তা যদি বাস্তবায়িত হতো তাহলে আজ রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা দেখা দিত না।’

শেয়ার করুন