দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বাজারে টাকার সরবরাহ কমাতে চায় বাংলাদেশ ব্যাংক। তাই বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে গ্রাহক পর্যায়ে ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে সুদের হার বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সংস্থাটি। এখন কোনো ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ধার করতে গেলে শতকরা ৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ সুদ গুণতে হবে। কিন্তু আগে যা ছিল ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ। অন্যদিকে গ্রাহক পর্যায়ে ঋণ নিতে গেলে এখন ব্যাংকগুলো সর্বোচ্চ প্রায় সাড়ে ১১ শতাংশ পর্যন্ত মুনাফা আদায় করতে পারবে। কারণ দশমিক ২৫ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে স্মার্ট বা সিক্স মান্থ মুভিং এভারেজ রেট অফ ট্রেজারি বিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের কনফারেন্স হলে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে গতকাল রবিবার এসব কথা জানান ব্যাংকটির প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক, পরিচালক সাঈদা খানম প্রমুখ।
প্রধান অর্থনীতিবিদ জানান, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদহার বাড়ানোর এখন কোনো বিকল্প দেখছি না। ব্যাংক ঋণের সুদ হার বাড়লে আগের চেয়ে কম ঋণ গ্রহণ করবে মানুষ। পক্ষান্তরে যাদের কাছে টাকা রয়েছে বেশি মুনাফা পাওয়ার আশায় তারা ব্যাংকে টাকা রাখবে। এতে ধীরে ধীরে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসবে বলে আশা ব্যক্ত করেন তিনি। আগামী ডিসেম্বর নাগাদ মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশ এবং জুন এর মধ্যে ৬ শতাংশে নামাতে চায় বাংলাদেশ ব্যাংক। এই লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য প্রয়োজনে আবারো সুদের হার বাড়ানোর সিদ্ধান্ত আসতে পারে।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে প্রধান অর্থনীতিবিদ বলেন, অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তের ফলাফল আসতে কিছুটা সময় লাগে। পাশাপাশি কাক্সিক্ষত ফলাফল পাওয়া বাধাগ্রস্ত করে বৈরী আবহাওয়া। আগেও আমরা বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নিয়েছি কিন্তু বর্ষাকাল হওয়ার কারণে ভালো ফলাফল পাওয়া যায়নি। এখন যেহেতু আবহাওয়াজনিত কোনো সমস্যা নেই, তাই আশা করছি খুব দ্রুতই কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারব।
ড. হাবিবুর রহমান আরো বলেন, এই মুহূর্তে জিডিপি প্রবৃদ্ধি আমাদের মূল লক্ষ্য নয়। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসাই আমাদের মূল লক্ষ্য। প্রয়োজনে জিডিপি কিছুটা কমবে। তারপরও সবার আগে মূল সমস্যাতে নজর দিতে হবে। ইতোমধ্যেই আমরা ক্ষুদ্র এবং কৃষি ঋণ বিতরণের গুরুত্ব বাড়িয়েছি। এছাড়া পদ্মা সেতু, বিভিন্ন রেল এবং সড়ক পথের উন্নয়নের কারণে অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধান সহজ হবে। সুদের হার বৃদ্ধির কারণে নির্বাচনে ব্যাংক থেকে ঋণ কম বের হতে পারে বলেও আশা প্রধান অর্থনীতিবিদের।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বাইরের তিনজন অর্থনীতিবিদ নিয়ে গঠিত নতুন মুদ্রানীতি কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, নীতি সুদহার করিডোরের ঊর্ধ্বসীমা স্ট্যান্ডিং লেন্ডিং ফ্যাসিলিটি (এসএলএফ) সুদহার ৯ দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৯ দশমিক ৭৫ শতাংশে পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া নীতি সুদহার করিডোরের নি¤œসীমা স্ট্যান্ডিং ডিপোজিট ফ্যাসিলিটি (এসডিএফ) সুদহার ৫ দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৫ দশমকি ৭৫ শতাংশ করা হয়েছে।
যে পদ্ধতির ওপর ভিত্তি করে এখন ঋণের সুদহার নির্ধারিত হয়, তা হলো ‘এসএমএআরটি’ বা ‘স্মার্ট’ ‘এসএমএআরটি’ বা ‘স্মার্ট’ তথা সিক্স মান্থ মুভিং এভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিল হিসেবে পরিচিত। প্রতি মাসের শুরুতে এই হার জানিয়ে দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নিয়ম অনুযায়ী, এতদিন ‘স্মার্ট’ হারের সঙ্গে সর্বোচ্চ সাড়ে ৩ শতাংশ হারে মার্জিন বা সুদ যোগ করে পরবর্তী মাসের ঋণের সুদহার নির্ধারণ করা হতো। এর আগে এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে এই রেট দশমিক ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়েছিল। এখন তা ২৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে অর্থাৎ ৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ যোগ করে সুদহার নির্ধারণ করতে হবে।
চলতি বছরের অক্টোবরে ১৮২ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের ৬ মাসের গড় সুদহার (স্মার্ট রেট) ছিল ৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, ‘স্মার্ট’ হারের সঙ্গে সর্বোচ্চ ৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ হারে মার্জিন বা সুদ যোগ করে নভেম্বর মাসে ঋণ দিতে পারবে ব্যাংক। সেই হিসাবে ঋণের সুদহার হবে ১১ দশমিক ১৮ শতাংশ। সেই হিসেবে, চলতি নভেম্বর মাসে ব্যাংক থেকে বড় অঙ্কের ঋণে সর্বোচ্চ ১১ দশমিক ১৮ শতাংশ সুদ নিতে পারবে। তবে নভেম্বরে ঠিক করা ঋণের এই সুদহার পরবর্তী ছয় মাসের মধ্যে পরিবর্তন করা যাবে না।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানায়, গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সভাপতিত্বে ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে গত ২২ নভেম্বর পুনর্গঠিত মনিটারি পলিসি কমিটির (এমপিসি) প্রথম সভা হয়। সভায় অভ্যন্তরীণ এবং বৈশ্বিকসহ সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, উচ্চ মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতি, বিনিময় হার, তারল্য ও সুদহার পরিস্থিতি এবং নীতি সুদহারের গতিবিধি নিয়ে পর্যালোচনা করা হয়। বাজারভিত্তিক বিনিময় হার ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতকরণ এবং ব্যাংকিং খাতে ক্রমবর্ধমান খেলাপি ঋণের সমস্যা মোকাবিলায় পদক্ষেপ নেয়ার পক্ষে সভায় গুরুত্ব দেয়া হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করছে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি চলতি বছরের ডিসেম্বর শেষে পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট ভিত্তিতে ৮ শতাংশে এবং আগামী জুন শেষে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনা এবং বিনিময় হার ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে সুদহার বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।