১৯ নভেম্বর ২০২৪, মঙ্গলবার, ০১:৩৯:৩০ অপরাহ্ন
সমুদ্রের বৈরী পরিবেশে বছরে ১৩৫০ মৃত্যু
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৯-১২-২০২৩
সমুদ্রের বৈরী পরিবেশে বছরে ১৩৫০ মৃত্যু

ট্রলার নিয়ে সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়েছিলেন কুয়াকাটার সাত জেলে। দুদিন পর ঘূর্ণিঝড় মিধিলির কবলে পড়ে ডুবে যায় ট্রলার। চার দিন চার রাত তারা প্রাণপণ সংগ্রাম করে সমুদ্রে টিকে থাকেন। অবশেষে ১ ডিসেম্বর তাদের জীবিত উদ্ধার করা হয়। তবে এই জেলেরা প্রাণ নিয়ে ফিরলেও তাদের মতো অনেকেরই সাগরের গভীর জলরাশিতে সলিল সমাধি হয়। 


স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়ে বৈরী পরিবেশের কারণে প্রতি বছর গড়ে ১৩৫০ জেলের মৃত্যু হচ্ছে। এসব জেলে বাংলাদেশের উপকূলীয় ও সামুদ্রিক জলসীমায় বাণিজ্যিক জাহাজ (ফিশিং ট্রলার), যান্ত্রিক ও কাঠের তৈরি ইঞ্জিনচালিত নৌকায় মৎস্য আহরণে নিয়োজিত থাকেন। এ অবস্থায় সম্প্রতি সংকট নিরসনে এবং জেলেদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তিন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি বৈঠক হয়। সেখানে নৌযানে ডিসট্রেস অ্যালার্ট ট্রান্সমিটার (ডিএটি) স্থাপনসহ অর্ধডজন প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।


বৈঠকে সমুদ্রে জেলেদের মৃত্যুর কারণ হিসাবে দুটি বিষয় উঠে আসে। একটি হলো-মাছ ধরতে গিয়ে বিরূপ আবহাওয়ায় বা সমুদ্রের অবস্থা (সি স্টেট) বুঝতে না পারা। অন্য হলো- জলদস্যুতার শিকার হয়ে প্রাণ হারানো।


আলোচনায় আরও উঠে আসে, মৎস্য আহরণকারী অনেক জলযান আন্তর্জাতিক জলসীমা অতিক্রম করে প্রতিবেশী দেশের জলসীমায় অনুপ্রবেশ করে। তখন সেসব দেশের কোস্ট গার্ডের হাতে আটক হয়ে দীর্ঘদিন তাদের কারাভোগসহ বন্দি জীবনযাপন করতে হয়। তবে কারাভোগের মাত্রা তুলনামূলকভাবে কমছে। এর কারণ সমুদ্রে দস্যুতাসহ অবৈধ কার্যকলাপ প্রতিরোধ এবং পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধিতে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ২০১৫ সালে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। এর আওতায় ভারতীয় কোস্ট গার্ড গত বছরের ২৫ অক্টোবর ২৪ জন জেলে ও দুটি মাছ ধরার ট্রলার ফেরত দেয়।


এ অবস্থায় সংকট সমাধানে নিজ নিজ প্রস্তাবনা তুলে ধরেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডের প্রতিনিধিরা। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কারিগরি দল ও কোস্ট গার্ডের আইটি বিশেজ্ঞগণের সমন্বয়ে জননিরাপত্তা বিভাগের যুগ্মসচিব (সীমান্ত অধিশাখা) সভা করে সংকট সমাধানে একটি প্রতিবেদন তৈরি করবেন।


সভায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. মোস্তাফিজুর রহমান জেলেদের নিরাপত্তার সামগ্রিক অবস্থা তুলে ধরেন। তিনি জানান, বাংলাদেশের উপকূলীয় ও সামুদ্রিক জলসীমায় মৎস্য আহরণে নিয়োজিত সব জলযানের সার্বিক নিরাপত্তার জন্য সভা আহ্বান করা হয়েছে। এর অন্যতম লক্ষ্য- নৌযানের রেজিস্ট্রেশন-লাইসেন্স প্রদানকালে জিপিএস ও ডিএইচএফ সেটসহ নিরাপত্তা ও নেভিগেশনাল ইকুইপমেন্ট থাকা নিশ্চিত করা।


জননিরাপত্তা বিভাগের যুগ্মসচিব (সীমান্ত অধিশাখা) মো. ফিরোজ উদ্দিন খলিফা জানান, সমুদ্রগামী বাংলাদেশী ফিশিং বোট বা ট্রলারসমূহের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে এবং আন্তর্জাতিক জলসীমা অতিক্রমসংক্রান্ত অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে কিছু উদ্যোগ নিতে হবে। এজন্য বাংলাদেশের উপকূলীয় ও সমুদ্রসীমায় এখতিয়াভুক্ত সব সমুদ্রগামী বাংলাদেশি নৌযানের লাইসেন্স দেওয়ার সময় জিপিএস, এইচএফ, ভিএইচএফ, এআইএস, জিএসএম ইত্যাদি সেট থাকা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।


সভায় কোস্ট গার্ডের অপারেশন পরিদপ্তরের পরিচালক ক্যাপ্টেন ফাইজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, বিভিন্ন সময়ে উপকূলীয় বা সমুদ্রগামী মাছ ধরা ট্রলার বিরূপ আবহাওয়ায় পড়ে হারিয়ে যায়। তারা বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা পার হয়ে ভুলক্রমে প্রতিবেশী দেশের সমুদ্রসীমায় প্রবেশ করে। এসব নৌযানের নিরাপত্তা নিশ্চিতে বোটগুলোর নাম ও রেজিস্ট্রেশন নম্বর কেবিন টপে লেখা প্রয়োজন। তাহলে নৌবাহিনী বা বিমানবাহিনীর এমপিএ বা হেলিকপ্টার দ্বারা সেগুলো দ্রুত শনাক্ত ও প্রাকৃতিক দুর্যোগকালীন দুর্ঘটনাকবলিত বোটগুলোকে তাৎক্ষণিক খুঁজে বের করা এবং উদ্ধার করা সহজ হবে। এছাড়া দুর্যোগে পড়া বোটগুলোকে শনাক্ত এবং উদ্ধার করতে পার্শ্ববর্তী দেশের (ভারত) মতো ডিসট্রেস অ্যালার্ট ট্রান্সমিটার (ডিএটি) স্থাপনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়।


সংকট নিরসনে মতামত তুলে ধরেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সাসটেইনেবল কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন ফিশারিজ প্রজেক্ট (এসসিএমএফপি)-এর ডিপিডি ড. মোহাম্মদ শরিফুল আজম। তিনি বলেন, ভেসেল মনিটরিং সিস্টেমের আওতায় তিন ধরনের নৌযান রয়েছে। এগুলো হলো- বাণিজ্যিক নৌযান, যান্ত্রিক নৌযান এবং আর্টিসানাল ফিশিং ভেসেল। এর কোনো নৌযানকেই ফিটনেস সার্টিফিকেট ছাড়া সমুদ্রে চলাচলের অনুমতি দেওয়া হয় না।


তিনি আরও বলেন, চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় একটি ফিশিং ভেসেল মনিটরিং সিস্টেম স্থাপন করা হয়েছে। মোবাইল নেটওয়ার্কভিত্তিক জিএসএম’র মাধ্যমে সমুদ্র উপকূল থেকে ৩০-৫০ কিমি. দূরত্বের নৌযানসমূহ ট্রেকিং ও মনিটরিং করা হচ্ছে। এর আওতায় আট হাজার ৫০০ মাছ ধরা নৌযানে পাইলটিংয়ের আওতায় আনা হবে। গ্রামীণফোন নেটওয়ার্কের আওতা বা টাওয়ারের উচ্চতা বাড়িয়ে তা উপকূল থেকে ৬০ কিমি. পর্যন্ত জলযানসমূহ ট্রেকিং বা মনিটরিং করা সম্ভব হবে। এ প্রকল্পের আওতায় ৭-৮ দিন সমুদ্রে অবস্থানকারী মাছ ধরার নৌযান এবং উপকূল থেকে ১৫০ কিমি. দূরত্বে অবস্থানরত জলযানসমূহকে এআইএস’র মাধ্যমে ট্রেকিং বা মনিটরিং করা সম্ভব হবে।


নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব (পরিকল্পনা) সুরাইয়া পারভীন শেলী বলেন, সমুদ্রগামী বাণিজ্যিক জাহাজগুলো ট্রেকিং বা মনিটরিংয়ের জন্য নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয় একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এ প্রকল্পের সঙ্গে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের এসসিএমএফপিকে প্রযুক্তিগতভাবে সমন্বয় করা যেতে পারে। তাহলে আরও কার্যকরভাবে সমুদ্রে মাছ ধরা সব জলযানকে ট্রেকিং বা মনিটরিংয়ের আওতায় আনা সহজ হবে।


শেয়ার করুন