১৯ নভেম্বর ২০২৪, মঙ্গলবার, ০৩:২৫:৪০ অপরাহ্ন
বাজার নিয়ন্ত্রণে বাড়তি তৎপরতা, আছে ঝুঁকিও
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৭-০১-২০২৪
বাজার নিয়ন্ত্রণে বাড়তি তৎপরতা, আছে ঝুঁকিও

আলুতে স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশে এখন ফসলটির ভরা মৌসুম। এই সময়েও বাজারে এক কেজি আলু বিক্রি হচ্ছে ৭০ টাকায়। ডিমের উৎপাদনও দেশে চাহিদার চেয়ে বেশি। তারপরও দাম অসহনীয়। নির্বাচনের আগে কীভাবে কীভাবে যেন গরুর মাংসের দাম কেজিতে ১৫০-২০০ টাকা কমে ৬০০-এর নিচে নেমে এসেছিল। কিন্তু ভোট শেষ না হতেই আবার ছুটছে গরু, মাংসের দাম আবার ৭০০ টাকা। 


তবে নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার মনে হচ্ছে বেশ নড়েচড়ে বসেছে। প্রধানমন্ত্রীসহ বাংলাদেশ ব্যাংক, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও মন্ত্রীরা এ নিয়ে কথা বলছেন। কিন্তু মূল্যস্ফীতি কমাতে নজরদারি বাড়ানোর চেয়ে বরং দফায় দফায় সুদের হার বাড়িয়ে যেভাবে ঋণ ব্যয়বহুল করা হচ্ছে, তাতে ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এতে মূল্যস্ফীতি সাময়িকভাবে কমলেও দীর্ঘ মেয়াদে জিডিপি প্রবৃদ্ধি, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও রাজস্ব আয়ের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। 


বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ডলার সহজলভ্য না করে শুধু সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। কারণ, সুদের হার বাড়ানোর নেতিবাচক প্রভাব অর্থনীতির অন্য খাতে পড়বে। ডলার সহজলভ্য করতে হবে, যাতে খাদ্যপণ্য সহজে আমদানি করা যায়। না হলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্য সফল হবে না।’ 


বিশেষজ্ঞদের পাশাপাশি ব্যবসায়ীরাও একই মত দিচ্ছেন। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের প্রেসিডেন্ট মাহবুবুল আলম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘শুধু মুদ্রানীতিতে সুদের হার বাড়িয়ে ঋণ ব্যয়বহুল করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলে অর্থনীতির জন্য ভালো হবে বলে আমার মনে হয় না। এমনভাবে কৌশল নিতে হবে, যাতে মূল্যস্ফীতি সহনীয় হয়, আবার সার্বিক অর্থনীতিও গতিশীল থাকে।’ 


বাজার নিয়ন্ত্রণে বাড়তি তৎপরতা

সাধারণত বাজার তদারক করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু বাজার শৃঙ্খলায় রাখতে এর আগে মন্ত্রণালয়টিকে কার্যকর ভূমিকা নিতে দেখা যায়নি। বরং ব্যবসায়ীদের পরামর্শে দফায় দফায় শুল্ক-কর কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম কমে এলেও উল্টো তাদের ইচ্ছেমতো পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। গত সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী হিসেবে টিপু মুনশি এই নিয়ে বেশ সমালোচনার মুখে ছিলেন। 

বাজারে একটি অসাধু ব্যবসায়ী চক্রের সিন্ডিকেট আছে, এটা অনেকটা ‘ওপেন সিক্রেট’ বিষয়। কারা সত্যিকার অর্থে এই সিন্ডিকেট করে, তাদের ধরতে কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়েনি। ভোক্তা চরম অসন্তুষ্ট হলেও সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো অনেকটাই নির্বিকার থেকেছে। 


তবে দায়িত্ব নেওয়ার পরই নতুন সরকারের ভেতরে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাড়তি তৎপরতা দেখা গেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এরই মধ্যে কয়েক দফা দ্রব্যমূল্য সহনীয় করতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন। নতুন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল হক টিটু বাজারে সিন্ডিকেট রয়েছে এবং তা নির্মূল করবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি গত তিন দিনে মন্ত্রণালয়টির আওতাধীন কয়েকটি দপ্তরের কর্মকর্তাদের নিয়ে কয়েক দফা বৈঠক করেছেন। সেখানে তিনি যেকোনো মূল্যে বাজার নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট সবাইকে কঠোর নজরদারির নির্দেশ দিয়েছেন। 


নতুন অর্থমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলীও দায়িত্ব নিয়েই তাঁর অগ্রাধিকার হিসেবে জিনিসপত্রের দাম যেন সহনীয় থাকে, সেই পদক্ষেপ নেবেন বলে জানিয়েছেন। একইভাবে শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূনও নিজ মন্ত্রণালয়ে বৈঠক করে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে তাঁর মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ারভুক্ত যা করণীয়, তা করবেন বলে জানিয়েছেন। 


এ ব্যাপারে জাতীয় ভোক্তা-অধিকার অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এইচ এম সফিকুজ্জামান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘নির্বাচন শেষ হওয়ার পর সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণে খুবই তৎপর। কর্মপরিকল্পনা তৈরি হচ্ছে। এখনই বিস্তারিত বলতে পারব না। তবে আমরা সরকারের মনোভাব বাস্তবায়নে এবং মানুষের কষ্ট লাঘবে সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাব।’


সুদহার বাড়ালে বাড়বে ঝুঁকি

বাংলাদেশ ব্যাংক আগামী ছয় মাসের জন্য আজ বুধবার নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করতে যাচ্ছে। জানা গেছে, এবারের মুদ্রানীতির মূল অগ্রাধিকার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। আর এটা করতে কঠোর করা হচ্ছে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ। সুদের হার আরও বাড়ানো হতে পারে। আগের দুই মুদ্রানীতিতেও সুদের হার বাড়ানো হয়েছিল। তারপরও মূল্যস্ফীতিতে খুব একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়েনি। উল্টো বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমে গিয়েছিল। 


কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সবশেষ তথ্য বলছে, গত বছরের সেপ্টেম্বরে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশে; আগের মাসে যা ছিল ৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ। ২০২১ সালের অক্টোবরের পর গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২৩ মাসের মধ্যে এই হার সর্বনিম্ন। এর অর্থ হচ্ছে বেসরকারি খাতে ঋণ কম যাচ্ছে। 


বাংলাদেশ ব্যাংকের লক্ষ্য ছিল গত ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশে আর আগামী জুনের মধ্যে সেটি ৬ শতাংশে নামিয়ে আনা। অথচ গত নভেম্বরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৪৯ শতাংশ। ডিসেম্বরে কাগজে-কলমে খাদ্য মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমলেও বাস্তবে ভুগছে মানুষ। সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি কমানোর কৌশল বাস্তবে সুফল না দিলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক বারবার ওই পথেই হাঁটছে। স্বল্পতম সময়ে ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১১ দশমিক ৮৯ শতাংশ করা হয়েছে; নতুন মুদ্রানীতিতে তা ১৩ শতাংশ ছাড়িয়ে যেতে পারে। 


বিশ্লেষকেরা বলছেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের অগ্রাধিকার ইতিবাচক। তবে শুধু বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা বৃথা। বরং তা হিতে বিপরীত হতে পারে। কেননা, সুদের হার বাড়লে বেসরকারি খাতে ঋণ ব্যয়বহুল হবে। তখন নতুন বিনিয়োগে উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ীরা ঋণ পাবেন না। আমদানি-রপ্তানি কমবে। বিনিয়োগ কমে গেলে মানুষের নতুন কাজের সুযোগ হবে না। কর্মসংস্থান কমবে। তখন বেকারত্বের হার বাড়বে। অন্যদিকে মুদ্রানীতিতে আমানতের সুদ বাড়ানোর সুযোগ থাকায় মানুষ খরচ কমিয়ে টাকা ব্যাংকে ঢোকাবে। 


এসবের সরাসরি প্রভাব পড়বে জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে। এরই মধ্যে বিশ্বব্যাংক, এডিবি এবং আইএমএফও বলে দিয়েছে সামনে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার কমবে। অথচ সরকার চলতি অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ২ শতাংশ অর্জনের লক্ষ্য ঠিক করে রেখেছে। 

অর্থনীতি শ্লথ হলে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে রাজস্ব আয়ে। মানুষের ব্যবসা চাঙা না থাকলে, মানুষ খরচ না করলে, সরকারেরও রাজস্ব আয় কমে যাবে। এমনিতেই চলতি অর্থবছরের প্রথম ৫ মাসে শুল্ক-করসহ সব মিলিয়ে রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি হয়েছে ১৬ হাজার ৪৫৯ কোটি টাকা। রাজস্ব আদায় কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় না হলে সরকারের উন্নয়ন কর্মসূচি বা এডিপিরও লক্ষ্য অর্জিত হবে না। সব মিলিয়ে দেখা যাবে, একমাত্র মূল্যস্ফীতি কমাতে গিয়ে রক্ষণশীল নীতির কারণে পুরো অর্থনীতিই তখন শ্লথ হয়ে গেছে। 


অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্সের (এবিবি) সাবেক প্রেসিডেন্ট ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন, শুধু মুদ্রানীতি কঠোর করে বাজার নিয়ন্ত্রণ হবে না। স্বল্প মেয়াদে হয়তো মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমল, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে অর্থনীতির অন্য খাতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এখানে পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে কার্যকর নজরদারি নেই। বাজারে বড় গ্রুপগুলোর আধিপত্য রয়েছে। শুধু একটি ফর্মুলা দিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ হবে না।


শেয়ার করুন