সরকারি চাকরিতে প্রায় পাঁচ লাখ পদে কোনো জনবল নেই। পদগুলো পূরণে উল্লেখযোগ্য কোনো নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিও নেই।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রশাসনে অনুমোদিত ১৯ লাখ ১৫১ পদের বিপরীতে কর্মকর্তা ও কর্মচারী রয়েছেন ১৩ লাখ ৯৬ হাজার ৮১৮ জন। বর্তমানে চার লাখ ৮৯ হাজার ৯৭৬টি পদ শূন্য রয়েছে। এতে মোট জনবলের প্রায় ২৫ শতাংশের বেশি শূন্যই রয়েছে। জনপ্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পরিসংখ্যান নিয়ে ২০২২ সালের ‘স্ট্যাটিসটিকস অব গভর্নমেন্ট সার্ভেন্টস’ বই থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
তবে একাধিক মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে পদগুলো শূন্য থাকার পেছনের কারণ। তাদের কেউ বলছেন, মামলার কারণে শূন্য পদে জনবল নিয়োগ দেওয়া যাচ্ছে না। কেউ বলছেন, ৪০-৪৫ বছর আগের নিয়োগবিধির আলোকে নিয়োগ দেওয়া যুক্তিসংগত হবে না।
আবার কেউ বলছেন, নিয়োগ এখন উচ্চমাত্রার একটি ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। নিয়োগ দিতে গিয়ে বদলি, ওএসডি এবং পদোন্নতিবঞ্চিত হতে হয়। একজন চাকরি প্রার্থীর জন্য একাধিক প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ, সংসদ-সদস্য, মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী এবং উপদেষ্টার আধা সরকারি পত্র (ডিও লেটার) জমা হচ্ছে। আবার কেউ বলছেন, প্রযুক্তি ব্যবহার করে লিখিত পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঝুঁকি এখন প্রবল। ফলে এখন আর কেউ শূন্যপদে জনবল নিয়োগ নিয়ে ভাবেন না, আগ্রহ দেখান না।
জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, মামলা-মোকদ্দমার কারণে নিয়োগ অনেক ক্ষেত্রে আটকে আছে। তা ছাড়া নিয়োগে কোনো সমস্যা থাকার কথা নয়।
তিনি আরও বলেন, নিয়োগে তদবির ছিল, আছে এবং থাকবে। এটাই বাস্তবতা। এসবের মধ্যে থেকেই চাকরি প্রার্থীদের জন্য একটি সমপ্রতিযোগিতার পরিবেশ তৈরি করে নিয়োগ দিতে পারাই আমাদের কাজ। সে কাজটি আমরা করছি। অতীতেও করেছি।
ভূমি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) মো. আব্বাস উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগবিধি হালনাগাদ করা নেই। ৩০ থেকে ৩৫ বছর আগের নিয়োগবিধির আলোকে জনবল নিয়োগ দিলে সমস্যা আছে। এ জন্য নিয়োগ বিলম্ব হচ্ছে। তা ছাড়া মামলার কারণেও নিয়োগ কার্যক্রম শুরু করা যায় না।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কেএম আব্দুল ওয়াদুদ যুগান্তরকে বলেন, শূন্যপদে জনবল নিয়োগ এখন উচ্চমাত্রার ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। এ ঝুঁকি এখন আর কেউ নিতে চান না। তিনি আরও জানান, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির জনবল নিয়োগে কোনো কারণ ছাড়াই একই পরীক্ষা তাকে পাঁচবার নিতে হয়েছে। ষষ্ঠবার পরীক্ষা নেওয়ার জন্য যখন চাপ এলো তখন তিনি আর পরীক্ষা নেবেন না বলে সাফ জানিয়ে দেন। তখন একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার হস্তক্ষেপে ওই নিয়োগ চূড়ান্ত করা হয়।
তিনি আরও জানান, আগে বুয়েট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে দিয়ে লিখিত পরীক্ষা নেওয়ার পর মন্ত্রণালয় ভাইবা নিয়ে নিয়োগ চূড়ান্ত করত। এখন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ সার্কুলারে বলা আছে, নিয়োগকারী মন্ত্রণালয়কে লিখিত পরীক্ষা নিতে হবে। লিখিত পরীক্ষা সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং কাজ। যে কারণে ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় কেউ আর নিয়োগে জড়াতে চান না।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (বিধি) মো. মুহিদুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, আমার পরিচিত একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নিয়োগ নিয়ে বিবাদে জড়ানোর কারণে আর পদোন্নতিই পাননি। তিনি আরও বলেন, একজন সাবেক ডিসি (বর্তমানে যুগ্মসচিব) জানিয়েছেন ৫০ জন এমএলএসএস নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর একজন এমপি ৫২টি ডিও লেটার পাঠিয়েছেন। ওই জেলায় আরও চারজন এমপি রয়েছেন। শেষ পর্যন্ত ওই নিয়োগ না দিয়েই তিনি ডিসির দায়িত্ব পালন শেষ করে অন্যত্র বদলি হয়ে গেছেন। এ ধরনের পরিস্থিতিতে কেউ নিয়োগে জড়াতে চান না।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তা ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় বলেন, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির নিয়োগে একটি পদের জন্য ডিও লেটার আসে ৮০ থেকে ১২০টি। এখন কোনটি রেখে কোনটি ফেলব। কেউ কারও চেয়ে কম প্রভাবশালী নন। যার ডিও লেটার অনার করা হবে না নির্ঘাত তার রোষানলে পড়তে হয়। অনেক সময় পদপদবি হারাতে হয়। হয়রানিমূলক বদলিও করা হয়। আটকে দেওয়া হয় কাঙ্ক্ষিত পদোন্নতি। নিয়োগ দিতে গিয়ে পান থেকে চুন খসলেই সব দায়িত্ব নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানান, জনবল নিয়োগ ঘিরে একটি দালালচক্র সবসময় সক্রিয়। তারা প্রশ্নপত্র ফাঁস করবেই। প্রশ্নপত্র ফাঁস হলে তদন্ত কমিটি হবে। গণমাধ্যমে তুলোধোনা করা হবে। সঙ্গে যোগ হবে নিয়োগ কমিটির কে কখন কোথায় কী করেছে। সব মিলিয়ে নিয়োগ এখন বেশ ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। এ ছাড়া একটি নিয়োগে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ থাকে। যাদের নিয়ে নিয়োগ কার্যক্রম পরিচালনা করব তারাই কেউ কাউকে বিশ্বাস করেন না। পরস্পরের প্রতি বিশ্বাসবোধের অভাব চরম আকারে দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া প্রযুক্তির এ যুগে প্রিলিমিনারি, লিখিত এবং ভাইবা পর্যায়ে যে কেউ অপকর্মে জড়িয়ে পড়তে পারে। ফলে এখন কেউ নিজ থেকে উচ্চ ঝুঁকি নিয়ে সরকারি নিয়োগে আগ্রহ দেখান না।
তারা আরও জানান, এখন অর্থনৈতিক সংকট চলছে। সে কারণেও অনেক নিয়োগ আটকে আছে। কাজের জায়গায় জনবল সংকট রাখা ঠিক না বলেও তারা মন্তব্য করেন।