প্রায় সাত বছর পর গত অক্টোবরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নতুন কমিটি গঠিত হয়। এর পর থেকেই বেপরোয়া হয়ে ওঠেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। একের পর এক অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছেন তাঁরা। চাঁদাবাজি, শিক্ষার্থী নির্যাতন, হলের সিট দখল, সিট থেকে শিক্ষার্থীদের নামিয়ে দেওয়া, দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের মতো অপরাধকর্মের অভিযোগ উঠছে তাঁদের বিরুদ্ধে।
কিছুদিন পরপর এমন ঘটনা ঘটলেও কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এ জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনকে দায়ী করছেন জ্যেষ্ঠ অধ্যাপকেরা। তাঁরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নিয়মতান্ত্রিকভাবে নির্বাচনের মাধ্যমে আসেননি। তাঁরা মূলত মনোনীত প্রশাসন। কারও না কারও মন জুগিয়ে তাঁরা প্রশাসনে এসেছেন। ফলে তাঁদের অনুসারী ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার মতো ক্ষমতা তাঁদের নেই। আর তাঁদের এই নিষ্ক্রিয় ভূমিকার কারণে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছেন।
জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য অধ্যাপক সুলতান-উল-ইসলাম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘প্রশাসন একেবারেই নিষ্ক্রিয় নয়। বিভিন্ন ঘটনায় শিক্ষার্থীদের শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। এমনকি কয়েকজনকে কারাগারেও পাঠানো হয়েছে।
তবে এসব ঘটনা দীর্ঘদিনের মন্দ চর্চার ফল। তাই চাইলেও রাতারাতি তা সমাধান করা সম্ভব নয়।’
জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদুল্লা-হিল-গালিব বলেন, ‘কোনো ঘটনায় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের সংশ্লিষ্টতার খবর পাওয়ামাত্রই আমরা বিষয়টি সমাধান করে দিই। তার পরেও যদি কেউ কোনো ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করে, তাহলে তদন্ত সাপেক্ষে আমরা তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’
এক সপ্তাহে যত ঘটনা
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ১১ মে রাতে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলের অতিথিকক্ষে বসাকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষ বাধে। রাতভর চলে সেই সংঘর্ষ। এ ঘটনায় হলের একটি কক্ষ ভাঙচুর করা হয়।
পরদিন ১২ মে সকালে হলের এক নিরাপত্তাকর্মীকে মারধর করেন ছাত্রলীগের এক পক্ষের নেতা-কর্মীরা। এক দিন পর আবার হলে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। এ সময় ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা হাতে রড, রামদা, লাঠিসোঁটাসহ দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে অবস্থান নেন। সে ঘটনার খবর ও ছবি বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। এর পরও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের হাতে অস্ত্র দেখেননি বলে মন্তব্য করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক আসাবুল হক। ঘটনাটি তদন্তে হল প্রশাসন একটি তদন্ত কমিটি গঠন করলেও তারা নির্ধারিত সময়ে প্রতিবেদন জমা দেয়নি।
সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার বিকেলে গাঁজা সেবনে নিষেধ করায় দুই শিক্ষার্থীকে মারধর ও একটি দোকান ভাঙচুর করেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। এর আগের রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাদার বখ্শ হলের এক শিক্ষার্থীকে ঘুম থেকে তুলে সিট থেকে নামিয়ে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। আর গত বুধবার রাতে সনাতন ধর্মাবলম্বী এক শিক্ষার্থীকে মারধর করে ‘শিবির’ আখ্যা দিয়ে হত্যার হুমকি দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া যায় এক ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে।
ছয় মাসে যত অভিযোগ
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ২১ নভেম্বর শহীদ হবিবুর রহমান হলের আবাসিক শিক্ষার্থী নিকল রায়কে হুমকি ও শারীরিক নির্যাতন করে সিট থেকে নামিয়ে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে হল ছাত্রলীগের সহসভাপতি মিনহাজুল ইসলামের বিরুদ্ধে। ১৮ ডিসেম্বর নবাব আব্দুল লতিফ হলের আবাসিক ছাত্র মফিজুর রহমানকে মারধর ও হল থেকে নেমে যাওয়ার হুমকির অভিযোগ ওঠে। গত ৬ মার্চ ক্যাম্পাসের ভ্রাম্যমাণ দোকান থেকে চাঁদা আদায়ের অভিযোগ ওঠে ছাত্রলীগের চার নেতার বিরুদ্ধে। এরপর গত ১২ মার্চ ক্যাম্পাসের একটি ভ্রাম্যমাণ খাবারের দোকানির কাছে ১০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করেন দুই নেতা।
এ ছাড়া গত ১৩ নভেম্বর রাতে নবাব আব্দুল লতিফ হলে এক ছাত্রলীগের কর্মীকে হলের সিট থেকে নামিয়ে দেওয়াকে কেন্দ্র করে মধ্যরাতে ছাত্রলীগের দুই পক্ষ দেশীয় অস্ত্র নিয়ে মুখোমুখি অবস্থান নেয়। এর কয়েক দিন পরেই মতিহার হলের ক্যানটিনে বসাকে কেন্দ্র করে শাখা ছাত্রলীগের দুপক্ষের মধ্যে ৩ দফা মারামারির ঘটনা ঘটে। গত ৫ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নেতা-কর্মীদের মধ্যে মাদার বখ্শ হলগেটে হাতাহাতির ঘটনায় ছাত্রলীগের একপক্ষের নেতা-কর্মীদের হাতে রড ও লাঠিসোঁটা দেখা যায়।