আসন্ন ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে চাল, ডাল, আটা, চিনি, ডিম, মুরগি ও মাছের মতো অত্যাবশ্যকীয় ১৭টি পণ্যের দাম কমানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কৃষিজাত পণ্য বিশেষ করে পোল্ট্রি, গবাদিপশু ও মাছের দেশীয় উৎপাদন বাড়াতে ভর্তুকি, প্রণোদনা এবং আমদানিকৃত পণ্যে শুল্ককর ও ভ্যাট ছাড় দেওয়া হবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে সরকারের পক্ষ থেকে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। বৈশ্বিক সংকটের কথা বিবেচনায় নিয়ে নতুন অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ছয় শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া মূল্য কমিয়ে নিত্যপণ্যের বাজারে স্বস্তি দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ নির্দেশনা রয়েছে। এ কারণে বাজেট প্রণয়নে নিত্যপণ্যের দাম কমানোর বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে নতুন বাজেটে করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো হচ্ছে না। দুই বছর পর আবারও অপ্রদর্শিত অর্থ বা কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হতে পারে।
অত্যাবশ্যকীয় ১৭টি পণ্যের বেশিরভাগই আমদানিনির্ভর। অন্যদিকে এসব পণ্যের দেশীয় উৎপাদনেও বীজ, সার, ওষুধ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা হয়ে থাকে। এ অবস্থায় ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই থেকে বেশ কয়েক বছর ধরেই অত্যাবশ্যকীয় ১৭ ভোগ্যপণ্য, যেমনÑ চাল, গম, আলু, পেঁয়াজ, রসুন, ছোলা, বুট, ডাল, হলুদ, মরিচ, ভুট্টা, আটা, ময়দা, লবণ, ভোজ্যতেল, চিনি ও সকল প্রকার ফল ইত্যাদির সরবরাহ পর্যায়ে উৎসে কর দুই শতাংশ হারে কর্তনের বিধান বাতিল করার প্রস্তাব করে আসছে। এটা করা হলে বাজেট ঘোষণার পরও নিত্যপণ্যের দাম স্থিতিশীল থাকবে বলে মনে করে এফবিসিসিআই। দেশের বিদ্যমান খাদ্য মূল্যস্ফীতির কথা বিবেচনা করে ইতোমধ্যে খাদ্য, কৃষি সংশ্লিষ্ট পণ্য ও সারের ওপর কর না বাড়াতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, এবার বাজেট সামনে রেখে কর ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন না করা হলেও নিত্যপণ্য আমদানিতে উৎসে কর পুরোপুরি বাতিল করা হতে পারে কিংবা এটি দুই শতাংশ থেকে কমিয়ে এক শতাংশ করা হতে পারে।
আগামী ৬ জুন বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট উপস্থাপন করবেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। এর আগেই এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে এনবিআর। এ প্রসঙ্গে এনবিআরের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, এবারের বাজেটে কর ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন না হলেও নিত্যপণ্য আমদানিতে বিশেষ ছাড় দেওয়া হবে। এ ক্ষেত্রে কর ও ভ্যাট কমানোর মতো সুযোগ রয়েছে। তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং দ্রব্যমূল্য কমাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ নির্দেশনা রয়েছে। আর এ কারণে কোন কোন জায়গায় এনবিআর ছাড় দিলে ভোগ্যপণ্যের দাম কমবে, সে বিষয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। আশা করছি, নিত্যপণ্যের দাম কমানোর উদ্যোগ থাকবে বাজেটে। এদিকে, আসন্ন ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। এ কারণে খাদ্যনিরাপত্তা জোরদার করে ভোগ্যপণ্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনার কৌশল রয়েছে আগামী বাজেটে। এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী সম্প্রতি সচিবালয়ে বলেন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকার সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। এটি বর্তমান সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকার। এ লক্ষ্য বাস্তবায়ন সামনে রেখেই বাজেট প্রণয়ন করা হচ্ছে। আগামী বাজেটে মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটবে।
জানা গেছে, নিত্যপণ্য পেঁয়াজের দাম ও আমদানির লাগাম টানতে এ পণ্যটির উৎপাদন বাড়াতে হবে দেশে। গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ উৎপাদনে গত দুই বছর ধরে বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ দেওয়া হয়। আগামী অর্থবছরের বাজেটেও এই ধারা বহাল রাখা হবে। এ ছাড়া ভোজ্যতেল ও চিনি আমদানিতে শুল্ককর ও ভ্যাট ছাড়ের বিষয়টি বিবেচনায় রেখেছে এনবিআর। কৃষির উপখাত হিসেবে বিশেষ সুবিধা পাবে পোল্ট্রি, মৎস্য ও গবাদিপশু পালন খাত। এ খাতের উদ্যোক্তাদের প্রণোদনা ও নগদ সহায়তা দেওয়ার মতো কর্মসূচি নেওয়া হবে। এ ছাড়া সার, বীজ, জীবন রক্ষাকারী ওষুধ এবং আরও কতিপয় শিল্পের কাঁচামালের ক্ষেত্রে বিদ্যমান শুল্কহার অপরিবর্তিত রাখার প্রস্তাব করা হবে। রাশিয়া-ইউক্রেন, ফিলিস্তিন-ইসরাইল যুদ্ধ এবং ডলার সংকটের কারণে বিশ্বজুড়েই অস্থির ভোগ্যপণ্যের বাজার। গত এক বছরের বেশি সময় ধরে দেশে বেশিরভাগ ভোগ্য ও নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। এতে করে স্বল্প আয়ের মানুষের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি হয়েছে। আয়ের বেশিরভাগ অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে খাদ্যপণ্য কিনতে। এ অবস্থায় আগামী বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেওয়া হয়েছে। সাধারণ মানুষের আগ্রহ- বাজেটে খাদ্যপণ্যের দাম কমাতে কী পদক্ষেপ থাকছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ তথ্যমতে, গত এপ্রিল মাসে দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১০ দশমিক ১১ শতাংশ। এ অবস্থায় মূল্যস্ফীতি সাড়ে ছয় শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনা বেশ কঠিন বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে খাদ্যপণ্যের দাম কমানোর পদক্ষেপ নেওয়া এখন সবচেয়ে বেশি জরুরি। তিনি বলেন, খাদ্যপণ্যের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়াতে হবে। বিশেষ করে ধান, চাল, পেঁয়াজ, মাছ, পোল্ট্রি ও গবাদিপশু উৎপাদন ও লালন-পালনে সরকারের ভর্তুকি ও প্রণোদনা অব্যাহত রাখা প্রয়োজন। একই সঙ্গে কৃষকের স্বার্থে উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে।