জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ কন্যা আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৭৬তম জন্মদিন আজ বুধবার।
১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় শেখ মুজিবুর রহমান ও শেখ ফজিলাতুন নেছার ঘর আলো করে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে দেশের নেতৃত্ব দেওয়া শেখ হাসিনাকে এখন দক্ষিণ এশিয়ারই অন্যতম সেরা নেতা মনে করা হয়।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৭তম অধিবেশনে যোগ দিতে প্রধানমন্ত্রী জন্মদিনে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন। তার অনুপস্থিতিতেই দিনটি উৎসবমুখর পরিবেশে নানা কর্মসূচি উদযাপন করবে আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন।
কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে বুধবার বিকেল ৩টায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলনকেন্দ্রে আলোচনা সভার আয়োজন করেছে আওয়ামী লীগ। কেন্দ্রীয়ভাবে এদিন বাদ জোহর জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমসহ দেশের সব মসজিদে দোয়া ও মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে।
এর আগে সকাল ১০টায় ধর্মরাজিক বৌদ্ধ মহাবিহারে (বাসাবো, সবুজবাগ) বৌদ্ধ সম্প্রদায়, সকাল ৯টায় খ্রিস্টান অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ (সিএবি) মিরপুর ব্যাপ্টিস্ট চার্চে এবং বেলা সাড়ে ১১টায় ঢাকেশ্বরী মন্দিরে হিন্দু সম্প্রদায় বিশেষ প্রার্থনা সভার আয়োজন করবে। এসব কর্মসূচিতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা উপস্থিত থাকবেন।
একই দিনে ঢাকাসহ সারাদেশে সব সহযোগী সংগঠন আলোচনা সভা, আনন্দ র্যালি, শোভাযাত্রা, দোয়া মাহফিল, বিশেষ প্রার্থনা ও আলোকচিত্র প্রদর্শনীসহ দিবসটির তাৎপর্য অনুযায়ী যথাযথ স্বাস্থ্যসুরক্ষা বিধি মেনে বিভিন্ন কর্মসূচি করবে।
আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন। বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুসারে, তার নেতৃত্বে অর্থনীতির প্রতিটি সূচকে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বের কাছে বাংলাদেশকে একটি রোল মডেল হিসেবে পরিচিত করেছেন।
সন্ত্রাস ও জঙ্গি দমনেও শেখ হাসিনা বিশ্বনেতাদের প্রশংসা কুড়িয়েছেন। মিয়ানমারে জাতিগত সহিংসতায় পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা মুসলিমদের আশ্রয় দিয়ে সারাবিশ্বে হয়েছেন প্রশংসিত। বাংলাদেশকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়।
রাজনৈতিক বিশ্লেকদের মতে, বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বের কারণেই করোনা মহামারির মধ্যেও দেশের অর্থনীতির চাকা সচল থাকায় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এশিয়ার প্রায় সব দেশের ওপরে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঠিক নেতৃত্ব, সময়োচিত পদক্ষেপ, মানুষের জন্য আর্থিক ও খাদ্য সহায়তা, অর্থনীতিকে বাঁচাতে প্রণোদনা ঘোষণা এবং বাস্তবায়নের কারণে দেশে অনাহারে একজন মানুষেরও মৃত্যু হয়নি। খাদ্যের জন্য কখনো কোথাও হাহাকার হয়নি।
শেখ হাসিনার সরকারের আমলেই বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি ও একাত্তরের ঘাতক যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজ শেষ করা সম্ভব হয়েছে। সংবিধান সংশোধনের মধ্য দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনরায় প্রতিষ্ঠা, ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তি এবং সমুদ্রে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ব্লু ইকোনমির নতুন দিগন্ত উন্মোচন হয়।
তার সরকার ভারতের সঙ্গে সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন ও ছিটমহল বিনিময়, বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটের সফল উৎক্ষেপণের মধ্য দিয়ে মহাকাশ জয়, সাবমেরিন যুগে বাংলাদেশের প্রবেশ, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ, মেট্রোরেল, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন, কর্ণফুলী টানেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, নতুন নতুন উড়াল সেতু, মহাসড়কগুলো ফোর লেনে উন্নীত করে।
প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে এলএনজি টার্মিনাল স্থাপন, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, মাথাপিছু আয় দুই হাজার ৮২৪ মার্কিন ডলারে উন্নীত, দারিদ্র্যের হার হ্রাস, মানুষের গড় আয়ু প্রায় ৭৪ বছর চারমাসে উন্নীত, যুগোপযোগী শিক্ষানীতি প্রণয়ন, সাক্ষরতার হার ৭৫ দশমিক ৬০ শতাংশে উন্নীত করা, বছরের প্রথম দিনে প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীর হাতে বিনামূল্যে নতুন বই পৌঁছে দেওয়া, মাদরাসা শিক্ষাকে মূলধারার শিক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত করা ও স্বীকৃতি দান, মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন, প্রত্যেকটি জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ, নারীনীতি প্রণয়ন, ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণ, ফাইভ-জি মোবাইল প্রযুক্তির ব্যবহার চালুসহ অসংখ্য ক্ষেত্রে কালোত্তীর্ণ সাফল্য অর্জন করেছে বাংলাদেশ।
ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের প্রবক্তা শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব গ্রহণের পর থেকে দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের মধ্যদিয়ে দলকে সুসংগঠিত করেন। ১৯৯৬ সালে প্রথম, ২০০৮ সালে দ্বিতীয়, ২০১৪ সালে তৃতীয় এবং ২০১৮ সালে চতুর্থবারের মতো নির্বাচনে জয়লাভ করে দলকে দেশের নেতৃত্বের আসনে বসাতে সক্ষম হন।
দাদা শেখ লুৎফর রহমান ও দাদি সাহেরা খাতুনের অতি আদরের নাতনি শেখ হাসিনার শৈশব-কৈশোর কেটেছে টুঙ্গিপাড়ায়। শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রেহানা ও শেখ রাসেলসহ তারা পাঁচ ভাই-বোন। বর্তমানে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা ছাড়া কেউই জীবিত নেই। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মা শেখ ফজিলাতুন নেছাসহ সবাই ঘাতকদের নির্মম বুলেটে নিহত হন।
শেখ হাসিনার শিক্ষাজীবন শুরু হয় টুঙ্গিপাড়ার এক পাঠশালায়। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়ে পরিবারকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। তখন পুরান ঢাকার রজনী বোস লেনে ভাড়া বাসায় ওঠেন তারা।
বঙ্গবন্ধু যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার সদস্য হলে সপরিবারে ৩ নম্বর মিন্টো রোডের বাসায় তারা বসবাস শুরু করেন। শেখ হাসিনাকে ঢাকার টিকাটুলির নারী শিক্ষা মন্দিরে ভর্তি করা হয়। এখন এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি শেরেবাংলা গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজ নামে খ্যাত। শুরু হয় তার শহর বাসের পালা।
তিনি ১৯৬৫ সালে আজিমপুর বালিকা বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক, ১৯৬৭ সালে ইন্টারমিডিয়েট গার্লস কলেজ (বর্তমান বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা মহাবিদ্যালয়) থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করেন। ওই বছরেই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অনার্সে ভর্তি হন এবং ১৯৭৩ সালে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।
শেখ হাসিনা বাংলাদেশ ছাত্রলীগের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সরকারি ইন্টামেডিয়েট গার্লস কলেজের ছাত্রী সংসদের সহসভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি ওই কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং পরের বছর সভাপতি হন।
তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর ছাত্রলীগের সদস্য হন। পরে তিনি রোকেয়া হল শাখার সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন। ছাত্রজীবন থেকেই শেখ হাসিনা সব গণআন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।
বঙ্গবন্ধুর আগ্রহে ১৯৬৮ সালে পরমাণু বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে শেখ হাসিনার বিয়ে হয়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানের করাচিতে নিয়ে যাওয়ার পর গোটা পরিবারকে ঢাকায় ভিন্ন এক বাড়িতে গৃহবন্দি করে রাখা হয়।
অবরুদ্ধ বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের ২৭ জুলাই শেখ হাসিনা গৃহবন্দি অবস্থায় তার প্রথম সন্তান সজীব ওয়াজেদ জয়ের মা হন। ১৯৭২ সালের ৯ ডিসেম্বর কন্যাসন্তান সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের জন্ম হয়।
শেখ হাসিনাকে একাধিকবার হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড নিক্ষেপ করে তাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করা হয়। এ হামলায় তিনি বেঁচে গেলেও সমাবেশে আসা ২৪ জন নিহত হন। এছাড়া অন্তত ৫০০ নেতাকর্মী আহত হন।
শিল্প সংস্কৃতি ও সাহিত্য অন্তঃপ্রাণ শেখ হাসিনা লেখালেখিও করেন। তার লেখা ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা ৩০টিরও বেশি।
প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- শেখ মুজিব আমার পিতা, সাদা কালো, ওরা টোকাই কেন, বাংলাদেশে স্বৈরতন্ত্রের জন্ম, দারিদ্র্য দূরীকরণ, আমাদের ছোট রাসেল সোনা, আমার স্বপ্ন আমার সংগ্রাম, সামরিকতন্ত্র বনাম গণতন্ত্র, আর্ন্তজাতিক সর্ম্পক উন্নয়ন, বিপন্ন গণতন্ত্র, সহে না মানবতার অবমাননা, আমরা জনগণের কথা বলতে এসেছি, সবুজ মাঠ পেরিয়ে ইত্যাদি।