ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কেনাকাটার নামে ৪ বছরে ৪৭ কোটি ১৭ লাখ টাকা লোপাট হয়েছে। ২০১৪-১৫ থেকে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে নানা অনিয়মের মাধ্যমে সংশ্লিষ্টরা এসব অর্থ আত্মসাৎ করেছেন বলে এক নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।এইসময়ে একে একে হাসপাতালটির তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন অধ্যাপক ডা. কামদা প্রসাদ সাহা, ডা. মো. ওমর ফারুক ও ডা. গনপতি বিশ্বাস।স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ডা. মো. ওমর ফারুক অবসরে গেছেন বেশ আগেই এবং গনপতি বিশ্বাস সাময়িক বরখাস্ত অবস্থায় আছেন।
বাংলাদেশ কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের কার্যালয় ‘ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কমপ্লায়েন্স অডিট রিপোর্ট’ শীর্ষক একটি নিরীক্ষা প্রতিবেদন প্রকাশ করে সম্প্রতি। এই প্রতিবেদনে উঠে আসে, ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কেনাকাটায় পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুল (পিপিআর) মানা হয়নি। লঙ্ঘন করা হয়েছে আর্থিক ক্ষমতা অর্পণ বিধিমালা।
এ ছাড়া টেন্ডার আহ্বান ছাড়াই কেনাকাটা ও বিল পরিশোধ করা হয়েছে। প্রকৃত রোগীর তুলনায় বেশি রোগী দেখিয়ে পথ্যের বিল দেওয়া হয়েছে। এমনকি টেন্ডারের চুক্তি অনুসারে মালামাল বুঝে না পেয়েও বিল প্রদানের মাধ্যমে এসব টাকা লুটপাট করা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কেনাকাটায় বিপুল পরিমাণ অর্থের নয়ছয় হয়েছে মূলত পণ্যের অতিমূল্য দেখিয়ে। যেমন ১৮ টাকার আইভি ক্যানুলা কেনা হয়েছে ৩৮ টাকায়। এ ছাড়া ২৬ টাকার হ্যান্ড গ্লাভস ৪৪ টাকায়, ৩৭ টাকার ডিভাইস ২২০ টাকায়, ৩৯ টাকার ডিভাইস ২৭৫ টাকা, ১৬৫ টাকার এক্স-রে ফিল্ম ২৮৮ টাকায়, ৯৯ টাকার নিডেল ২৭৫ টাকা এবং ২৭৫ টাকার তোয়ালে কেনা হয় ৬৮৫ টাকায়।
পিপিআর বিধি লঙ্ঘনের বিষয়ে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারী যন্ত্রপাতি এবং এমএসআর মালামাল কিনতে ২০১৮ সালের ২৭ অক্টোবর দরপত্র আহ্বান করে। সরবরাহকারীর সঙ্গে ২৪ কোটি ৬২ লাখ ৭১ হাজার ১১৪ টাকার চুক্তি স্বাক্ষর করে এবং চুক্তির বিপরীতে ২৩ কোটি ১৩ লাখ ৮৯ হাজার ৯৩০ টাকা পরিশোধ করে। কিন্তু চুক্তি স্বাক্ষরের আগে পিপিআর-২০০৮-এর বিধি ১১ ও ৩৬ অনুযায়ী কর্তৃপক্ষের অনুমোদন গ্রহণ করা হয়নি। এমনকি আর্থিক ক্ষমতা অর্পণ ২০১৫-এর ৪(খ) অনুসারে বিভাগীয়/আঞ্চলিক অফিসের ক্ষমতা ৫০ লাখ টাকা হলেও ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষ ৯টি চুক্তি করে, যার প্রতিটিই ছিল আর্থিক ক্ষমতার অতিরিক্ত।
২০১৭ সালের ১৯ অক্টোবর ক্রয় পরিকল্পনা ছাড়াই এমএসআর মালামাল কিনতে দরপত্র আহ্বান করা হয়। হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ককে সভাপতি করে সাত সদস্যের মূল্যায়ন কমিটি গঠন করা হয়। একই ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানের প্রধান ও অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে সিদ্ধান্ত নিয়ে চুক্তি এবং কার্যাদেশ ইস্যু করে। কিন্তু পিপিআর ২০০৮-এ বিধি ৩৬(২) অনুসারে একই ব্যক্তি মূল্যায়ন কমিটির চেয়ারম্যান এবং অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষ হতে পারবে না। এ ক্ষেত্রে সিপিটিউ ইস্যুর নির্ধারিত ফরমে চুক্তি সই না করে স্ট্যাম্পে টাকার পরিমাণ এবং তারিখ ছাড়াই স্বাক্ষর করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় মূল্যায়িত দরপত্রে অনুমোদন ছাড়াই ৭ কোটি ৫৩ লাখ ২৭ হাজার ১২৮ টাকার কেনাকাটা সম্পন্ন করা হয়।
একইভাবে বাজারমূল্য থেকে বেশি দামে এমএসআর সরঞ্জাম কেনায় সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৩ কোটি ৪৩ লাখ ৮৫ হাজার
৬৬৮ টাকা। অনিয়মের এখানেই শেষ নয়। স্ট্যান্ডার্ড টেন্ডার ডকুমেন্টসের ২৩.১-এর নির্দেশ সুস্পষ্ট লঙ্ঘন করে ৩৭ লাখ ৫০ হাজার টাকায় প্রতি সেট পর্দা কেনা হয় ফরিদপুর মেডিকেলে। কিন্তু পর্দা কেনার ক্ষেত্রে সরবরাহকারীর ইনভয়েস, মালামালের বিবরণী, পরিমাণ, একক দাম ও মোট মূল্য, সরবরাহ নোট, উৎপাদন সনদ, উৎপাদকারীর ওয়ারেন্ট সনদ ছিল না।
এ ছাড়া কেবিন ও পেয়িং বেডে অবস্থানকারী রোগীর চেয়ে বেশি রোগী দেখিয়ে পথ্য বিল পরিশোধের মাধ্যমে ২৭ লাখ ৫১ হাজার ৮৭৫ টাকা, সরবরাহকারী নির্ধারিত সময়ে মালামাল সরবরাহ না করলেও জরিমানার ১৫ লাখ ৩০ হাজার ২৬১ টাকা আদায় না করা, স্পেসিফিকেশন অনুসারে মালামাল সরবরাহ না করায় ৯ লাখ ৭৮ হাজার ২০০ টাকা ক্ষতি হয়েছে সরকারের।
এসব অনিয়মের বিষয়ে কী ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে, জানতে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব ড. মু. আনোয়ার হোসেন হাওলাদারকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।