আকাশপথে মোস্ট ওয়ান্টেড (দাগি) অপরাধী শনাক্তে দেশের সব বিমানবন্দরে বসছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি। অ্যাডভান্স প্যাসেঞ্জার ইনফরমেশন সিস্টেম (এপিআইএস) নামের এই প্রযুক্তিটি স্থাপন করবে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। এর মাধ্যমে বহির্বিশ্ব থেকে কোনো ফ্লাইট দেশে পৌঁছানোর আগেই সংশ্লিষ্ট সবার তথ্য এপিআইএস প্রযুক্তির মাধ্যমে চলে আসবে সার্ভারে। সেই তথ্য যাচাই-বাছাই করে সহজেই অপরাধী শনাক্ত ও ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবেন সংশ্লিষ্টরা। এই সিস্টেমে অভ্যন্তরীণ যাত্রীদের অন্তর্ভুক্ত করার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা বাদ দেওয়া হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, এই প্রযুক্তির কার্যক্রম শুরু হলে সহজেই ধরা পড়বে দেশি-বিদেশি রেড অ্যালার্টপ্রাপ্ত যে কোনো অপরাধী, জঙ্গি, সন্ত্রাসী, পাচারকারী, চোরাকারবারি।
শুধু তাই নয়, এসব অপরাধীরা বিমানবন্দর দিয়ে ছদ্মবেশে দেশে আসতে পারবে না, আবার বিদেশেও যেতে পারবে না। আকাশপথ ব্যবহার করে কোনো যাত্রী বাংলাদেশ থেকে অন্য দেশে যাওয়া এবং অন্য দেশ থেকে বাংলাদেশে আসার আগেই ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে সেই যাত্রী, ক্রু ও বিমানের নাম, ঠিকানা, পাসপোর্ট নম্বর, জাতীয়তা, জন্ম তারিখ, পাসপোর্ট এবং ভিসার বিবরণ, মূল দেশ, গন্তব্য, ভ্রমণসহ বিস্তারিত তথ্য সংবলিত একটি তালিকা ফ্লাইট উড্ডয়নের আগেই ইমিগ্রেশনসহ সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃক্ষের কাছে পৌঁছে যাবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র উল্লিখিত সব তথ্য দিয়ে আরও জানায়, ইতোমধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে এ প্রযুক্তি ক্রয় ও স্থাপন নিয়ে কাজ শুরু করেছে বেবিচক। জিটুজি ভিত্তিতে সিস্টেমটি বিমানবন্দরে স্থাপন করা হবে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের একটি কোম্পানি এ বিষয়ে তাদের আর্থিক ও কারিগরি প্রস্তাবও জমা দিয়েছে। দেশটির সরকার মনোনীত প্রতিষ্ঠান ইটিইকের দেওয়া কারিগরি প্রস্তাব প্রাথমিকভাবে যাচাই-বাছাই শেষ হয়েছে। আর্থিক প্রস্তাব মূল্যায়নের জন্য বেবিচকের সদস্যকে (নিরাপত্তা) আহ্বায়ক করে ৯ সদস্যের একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করা হয়েছে।
৬ নভেম্বর বেসামরিক বিমান পরিবহণ ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব আহমেদ জামিল স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে এই কমিটি গঠনের কথা বলা হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়েছে, ইতঃপূর্বে গঠিত কারিগরি প্রস্তাব মূল্যায়ন কমিটি ও জিটুজি কমিটির পর্যবেক্ষণ ও সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে অভ্যন্তরীণ যাত্রীদের এই প্রযুক্তির বাইরে রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ৪ অক্টোবর অনুষ্ঠিত এপিআইএস বাস্তবায়ন সংক্রান্ত জিটুজি কমিটির সভায় কারিগরি প্রস্তাবটির মূল্যায়ন বিষয়ক উপস্থাপনার সময়ও অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটে যাত্রী চলাচলকে এপিআইএস বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার আওতায় বিবেচনা করার প্রয়োজন নেই মর্মে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয়।
এ প্রসঙ্গে বেসামরিক বিমান পরিবহণ ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী যুগান্তরকে বলেন, বিমানপথে অপরাধী শনাক্তে দেশের সব বিমানবন্দরে বসবে অ্যাডভান্স প্যাসেঞ্জার ইনফরমেশন সিস্টেম, যার মাধ্যমে দেশে ফ্লাইট পৌঁছার আগেই যাত্রীর সব তথ্য চলে আসবে বিমানবন্দরে। এই প্রযুক্তিটি দেশকে দেশি-বিদেশি শত্রু মোকাবিলায় সহায়তা করবে।
জানা গেছে, জাতিসংঘ নিরাপত্তা কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত ও আন্তর্জাতিক সিভিল এভিয়েশন সংস্থার (ইকাও) মানদণ্ড অনুসারে অ্যাডভান্স প্যাসেঞ্জার ইনফরমেশন সিস্টেম প্রতিষ্ঠা করা সদস্য রাষ্ট্রগুলোর জন্য বাধ্যতামূলক।
সিস্টেমটির প্রধান ব্যবহারকারী প্রতিষ্ঠান হচ্ছে বাংলাদেশের ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। এছাড়া জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও এ সিস্টেমের উপাত্ত ব্যবহার করতে পারবে। সিস্টেমটির সঙ্গে প্যাসেঞ্জার নেম রেকর্ড (পিএনআর) এবং ইলেকট্রনিক ট্রাভেল অথরাইজেশন (ইটিএ) প্রযুক্তিও অন্তর্ভুক্ত থাকবে। এর ফলে অপরাধী, অনাকাঙ্ক্ষিত বা বিপজ্জনক যাত্রীর আগমনের বিপরীতে ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ আগাম প্রস্তুতির সময় পাবে এবং এমনকি বিদেশের বিমানবন্দরে বোর্ডিংয়ের সময় চিহ্নিত যাত্রীর যাত্রাও বাতিল করতে পারবে। এতে সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম সম্প্রসারিত হবে। সিস্টেমটি প্রবর্তিত হলে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাস ও অপরাধ দমন সহজতর হবে। এছাড়া অর্থ পাচার, মাদক চোরাচালান ও মানব পাচার প্রতিরোধেও সিস্টেমটি সহায়ক হবে। একই সঙ্গে নিরীহ সাধারণ যাত্রীদের ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস ছাড় কার্যক্রম দ্রুত ও সহজতর হবে।
এআইপিএস সিস্টেমটি যাত্রীদের তথ্যাদি এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ওয়াচলিস্টের ভিত্তিতে বিশ্লেষণ করতে সক্ষম হবে। এই বিশ্লেষণের পরিসর অত্যন্ত ব্যাপক, যাত্রীর নাম ও অন্যান্য তথ্যাদির বানানে সম্ভাব্য পার্থক্যগুলোও বিশ্লেষণ করতে সক্ষম হবে।
টিকিট কেনার সময়, সিট রিজার্ভেশন বা চেক-ইন করার সময় পাসপোর্ট এবং ভিসার মতো ভ্রমণ নথি থেকে এইসব তথ্য সংগ্রহ করা হবে। আন্তঃজাতিক অপরাধ এবং জঙ্গি ও অন্যান্য অপরাধীদের অবাধ বিচরণ রোধে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে সন্দেহভাজন যাত্রীদের সনাক্ত করে ভ্রমন রোধ ও গ্রেফতার করতে সক্ষম হবেন।
এপিআইএস ইন্টারপোল এবং অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দ্বারা জারি করা মোস্ট ওয়ান্টেড বা রেড অ্যাল্যার্ট বা ওয়ারেন্টের মতো তথ্য যাচাই করতেও সক্ষম হবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চোরাচালান রোধে এপিআইএস কার্যকর ভূমিকা রাখছে। ফলে বাংলাদেশের বিমানবন্দরে চোরাচালানের ঘটনা রোধে সহায়ক হবে। সিস্টেমটি সব যাত্রী, ক্রু এবং অন্যান্য এয়ারলাইন কর্মীদের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রবেশ এবং প্রস্থান করার ইলেকট্রনিক ডাটাবেজ হিসাবে কাজ করবে।
জানা গেছে, বেবিচকের যাচাই-বাছাই কমিটি ইতোমধ্যে ইটিইকের দেওয়া কারিগরি প্রস্তাব প্রাথমিকভাবে মূল্যায়ন করেছে। এরপর তারা বাংলাদেশের বিমানবন্দরগুলোতে এই প্রযুক্তি (APIS) বাস্তবায়নে অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটে যাত্রী চলাচলকে বিবেচনা না করার নির্দেশনা দিয়েছে। ফলে অভ্যন্তরীণ যাত্রীরা এর আওতামুক্ত থাকছেন। বেবিচকের একজন সদস্য যুগান্তরকে জানান, আইকাও এর নির্দেশনা অনুযায়ী ২০২৪ সালের মধ্যে এটি বাস্তবায়ন করতে হবে। সেই লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি।