দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ন্যূনতম ৬০টি আসনে ছাড় চান আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের শরিকরা। এর বাইরেও আরও দুটি দাবি জানাবে তারা। প্রথমত, শরিকদের ছাড় দেওয়া আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত কোনো প্রার্থী থাকবে না। দ্বিতীয়ত, আওয়ামী লীগের পদ-পদবিওয়ালা কোনো স্থানীয় নেতা তাদের আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে পারবেন না। এসবের নিশ্চয়তা চাইবেন তারা।
আজ সোমবার প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সঙ্গে অনুষ্ঠেয় বৈঠকে এই তিন দফা দাবি তুলবেন ক্ষমতাসীনদের শরিক দলগুলোর শীর্ষ নেতারা। সন্ধ্যা ৬টায় প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে এই বৈঠক হওয়ার কথা। বৈঠকে তিন দাবির বাইরে আরও একটি বিষয়ে কথা বলবেন শরিক দলের নেতারা। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের একাধিক সিনিয়র নেতা জোটের শরিকদের নিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্যের সঙ্গে বিভিন্ন সময় কথা বলছেন, এটাও বন্ধ করার অনুরোধ জানাবেন তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শনিবার ১৪ দলীয় জোটের সমন্বয়ক ও মুখপাত্র, বর্ষীয়ান রাজনীতিক আমির হোসেন আমুর সঙ্গে তার রাজধানীর ইস্কাটনের বাসভবনে গিয়ে বৈঠক করেন ১৪ দলীয় জোটের শীর্ষ কয়েক নেতা। সেখানেও শরিকদের আসন সমঝোতার বিষয়ে আলোচনা হয়। বৈঠকে ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ, তরিকত ফেডারেশন ও জাতীয় পার্টি-জেপির পক্ষ থেকে নিজ নিজ দলের প্রার্থীর তালিকা আমির হোসেন আমুর কাছে দেন নেতারা। একই সঙ্গে জোট নেতারা আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দ্রুত একটি বৈঠকের বিষয়ে তাগিদও দিয়েছিলেন। এর পরদিনই এলো প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে শরিকদের বৈঠকের খবর।
আজকের বৈঠকের বিষয়টি যুগান্তরকে নিশ্চিত করেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ ও ১৪ দলীয় জোটের সমন্বয়ক আমির হোসেন আমু। শেখ হাসিনা জোটের শরিকদের নিয়ে এমন এক সময় বৈঠক করতে যাচ্ছেন, যখন ভোটের বল নির্বাচনের মাঠে পুরোদমে গড়িয়েছে। আগামী ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। বিএনপিসহ তাদের বলয়ের রাজনৈতিক দলগুলোর বর্জনের মধ্যে অনুষ্ঠিতব্য এই নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন (ইসি) নিবন্ধিত ২৯টি রাজনৈতিক দল অংশ নিচ্ছে। ইতোমধ্যে মনোনয়নপত্র দাখিলপর্ব শেষ। এখন চলছে যাচাই-বাছাইয়ের কাজ। আগামী ১৭ ডিসেম্বর মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন। এর পরপরই প্রতীক বরাদ্দ। শুরু হবে আনুষ্ঠানিক নির্বাচনি প্রচারণা।
এবারের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়য়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট শরিকদের মধ্যে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ ৯১, জাতীয় পার্টি-জেপি ২০, বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল (এমএল) ৬, গণতন্ত্রী পার্টি ১২, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ ৬, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি ৩৩, বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন ৪৭টি আসনে দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন দিয়েছেন। এছাড়া আওয়ামী লীগের মহাজোটের শরিক দল বিকল্পধারা বাংলাদেশ ১৪টি আসনে প্রার্থী দিয়েছে। ১৪ দলীয় জোটের শরিকরা গত তিনটি (নবম, দশম ও একাদশ) সংসদ নির্বাচনেই আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন সমঝোতা করে ভোটে অংশ নেয়। বিকল্পধারা বাংলাদেশ গত দুটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন সমঝোতা করে।
অন্যান্যবারের মতো আগামী নির্বাচনেও তারা আওয়ামী লীগের কাছে আসন ছাড় চায়। আওয়ামী লীগের প্রতীক নৌকা নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পাশাপাশি যার যার দলীয় প্রতীক নিয়েও নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে এগোচ্ছে তারা। তবে বিপত্তি বেধেছে এখনো আসন ছাড় বা আসন সমঝোতা নিয়ে কোনো আলোচনাই হয়নি প্রধান দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে। দীর্ঘ অপেক্ষার পর মান ভাঙাতে শরিকদের নিয়ে বসছেন জোট নেত্রী শেখ হাসিনা। সেখানেই শরিকরা যার যার দলের পক্ষে দাবি তুলবেন বলে জানিয়েছেন ১৪ দলের একাধিক শীর্ষ নেতা।
চলতি বছর ১৮ জুলাই শেষবারের মতো ১৪ দলীয় জোটের শরিক নেতাদের নিয়ে বৈঠক করেন শেখ হাসিনা। ওইদিন সন্ধ্য ৭টায় প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে বৈঠক হয়। এর আগে জোটের শীর্ষ নেতাদের নিয়ে বৈঠক করেছিলেন গত বছরের ১৫ মার্চ। সেই বৈঠকও হয়েছিল ২০১৮ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ টানা তৃতীয় দফায় ক্ষমতায় আসার প্রায় তিন বছর পর।
নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার পরপরই ভোটের মাঠে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছেন নৌকার ওপর ভর করে সংসদ-সদস্য হওয়া ১৪ দলীয় জোটের শরিক দলের শীর্ষ নেতারা। এবার তাদের আসনে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী ঘোষণা করায় বেশ বিপাকে আছেন। শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা মাঠে থাকবেন, নাকি কেন্দ্রের নির্দেশে সরে দাঁড়াবেন, নাকি আওয়ামী লীগেরই কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে তাদের বিরুদ্ধে ভোটে লড়বেন-এমন শঙ্কার মধ্যে সময় পার করছেন তারা। ভোটের মাঠে এর যে কোনো একটি থাকলেই শরিক দলের অনেক নেতার জন্য পাশ করে আসা খুব সহজ হবে না, শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে এ নিয়েও কথা বলবেন তারা।
জানতে চাইলে এ প্রসঙ্গে ক্ষমতাসীন ১৪ দলীয় জোটের অন্যতম প্রধান শরিক বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন যুগান্তরকে বলেন, আওয়ামী লীগ সভাপতির সঙ্গে বৈঠকে আমরা আমাদের দাবি-দাওয়া তুলে ধরব।
জোটের আরেক প্রধান শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, আরও আগে বসলে ভালো হতো। তারপরও এই বৈঠকে অনেক বিষয়ে সমাধান হবে বলে আমরা আশা করছি।
সংশ্লিষ্টদের মতে, নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার আগে থেকেই আসন সমঝোতার জন্য উন্মুখ ছিলেন ১৪ দলীয় জোট শরিকরা। জোট নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করে আগেভাগেই বিষয়টি চূড়ান্ত করার তাগাদাও ছিল তাদের। কিন্তু শরিকদের সঙ্গে আসন ভাগাভাগি নিয়ে এবার শুরু থেকেই কৌশলী ছিল আওয়ামী লীগ। বিএনপিসহ তাদের মিত্রদের ভোট বর্জনের এই নির্বাচনে শরিকদের সঙ্গে আসন সমঝোতার চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসতে তাই সময়ক্ষেপণ করেছে দলটি। এ নিয়ে অভিমানও জমছিল শরিকদের মধ্যে। অবশেষে সেই অপেক্ষার পালা শেষ হতে যাচ্ছে। শেখ হাসিনা শরিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বসে নির্বাচনি কৌশল, আসন সমঝোতাসহ বিরোধী রাজনীতিকে মোকাবিলায় করণীয় সম্পর্কে দিকনির্দেশনা দেবেন, এমনটাই প্রত্যাশা জোট নেতাদের।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে ২০০৬ সালে ২৩ দফার ভিত্তিতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে ১৪ দলীয় জোট। ওই সময় থেকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে জোটগতভাবে আসন ভাগাভাগি করে নির্বাচনে অংশ নেয় জোটের শরিকরা। নবম ও দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর গঠিত সরকারে শরিকদের প্রতিনিধিত্ব ছিল। তবে সর্বশেষ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর গঠিত সরকারের মন্ত্রিসভায় শরিক দলের কাউকে রাখা হয়নি। এরপর থেকেই নানা কারণে জোট শরিকদের মধ্যে দূরত্ব বেড়েছে। বেড়েছে মান-অভিমান।