১৯ নভেম্বর ২০২৪, মঙ্গলবার, ০৯:৩৭:৫০ অপরাহ্ন
বছরের শেষে বিপাকে শিক্ষক-অভিভাবক
  • আপডেট করা হয়েছে : ০২-০১-২০২৪
বছরের শেষে বিপাকে শিক্ষক-অভিভাবক

বিদায়ি বছরে দেশের শিক্ষাঙ্গনে আলোচনার কেন্দ্রে ছিল নতুন শিক্ষাক্রম। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের তিন শ্রেণিতে এ কারিকুলাম অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই বাস্তবায়ন করতে গিয়ে শুরু হয় নানা আলোচনা-সমালোচনা। বছরের শেষে এসে তা আন্দোলনে গড়ায়। নতুন শিক্ষাক্রমের বিরোধিতা করে গ্রেফতার হন বেশ কয়েকজন শিক্ষক ও অভিভাবক। এ নিয়ে তুমুল বিতর্কের পাশাপাশি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন শিক্ষকরা।


জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে টানা ২৩ দিনের আন্দোলনে বন্ধ হয়ে যায় দেশের সব বেসরকারি স্কুল-কলেজের ক্লাস-পরীক্ষা। বৈষম্য নিরসন ও পদোন্নতির দাবিতে আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারাও।


এছাড়া এসএসসি-এইচএসসিতে নিম্নমুখী ফল, ডেঙ্গুতে একের পর এক শিক্ষার্থীর মৃত্যু, নতুন পাঠ্যবই ছাপাতে বিলম্ব, এক দশক পর প্রাথমিকের শিক্ষকদের পদোন্নতি, চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তিতে ২৭ হাজার শিক্ষক নিয়োগ, প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অনিয়ম, কিন্ডাগার্টেন নিয়ন্ত্রণে নীতিমালা, ১৭তম শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় ২৪ হাজার উত্তীর্ণ, তিন বিসিএস-এর ফল প্রকাশ, গুচ্ছ ভর্তি নিয়ে ভোগান্তি, একক ভর্তি পরীক্ষা আয়োজনে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির টানাপোড়েনসহ নানা ইস্যুতে ২০২৩ সালে আলোচনায় ছিল শিক্ষা খাত।


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক মো. মজিবুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, বৈশ্বিক পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মেলাতে শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন আনতে হয়। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কোনো ধরনের প্রস্তুতি ছাড়াই নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করতে গিয়ে আলোচনার মুখে পড়তে হয়েছে। তাই বছরজুড়ে এটিই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল।


নতুন শিক্ষাক্রম : নতুন শিক্ষাক্রমের শিখন পদ্ধতি শিক্ষকদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, এর জন্য তাদের তেমন কোনো প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়নি। মাত্র পাঁচদিনের প্রশিক্ষণও ছিল অপ্রতুল। অধিকাংশ শিক্ষকই পাঁচদিনের প্রশিক্ষণে নতুন কারিকুলামের কিছুই বুঝে উঠতে পারেননি। ?মূল্যায়নের পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনা হয়েছে। ত্রিভুজ, বৃত্ত ও চতুর্ভুজ সাংকেতিক চিহ্ন দিয়ে শিক্ষার্থীদের মেধা মূল্যায়নের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এতে শিক্ষার্থী কোন বিষয়ে খারাপ করছে, কোনটিতে ভালো করছে, তা জানার আসলে কোনো উপায় নেই।


বিদায়ি বছরে প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে বাস্তবায়ন করা হয় নতুন শিক্ষাক্রম। চলতি বছরে নতুন করে দ্বিতীয়, তৃতীয়, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে চালু হচ্ছে নতুন শিক্ষাক্রম। এরপর ২০২৫ সালে পঞ্চম ও দশম শ্রেণিতে, ২০২৬ সালে একাদশ এবং পর্যায়ক্রমে ২০২৭ সালে দ্বাদশ শ্রেণিতে (উচ্চমাধ্যমিক) বাস্তবায়ন করা হবে। নবম শ্রেণির বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা ও মানবিক নামে তিন বিভাগও নতুন কারিকুলামে তুলে দেওয়া হয়েছে। নতুন শিক্ষাক্রমে আলাদা কোনো বিভাগ বিভাজন থাকছে না। সব শিক্ষার্থীকেই দশম শ্রেণি পর্যন্ত ১০টি অভিন্ন বিষয় পড়তে হবে। এছাড়া নতুন শিক্ষাক্রমে দশম শ্রেণির আগের সব পাবলিক পরীক্ষা তুলে দেওয়া হয়েছে। উচ্চমাধ্যমিকে গিয়ে বিভাগ বিভাজন হবে।


এতে তিনটি বিষয় সবার জন্যই বাধ্যতামূলক থাকবে।


শিক্ষাবিদরা বলছেন, নতুন শিক্ষাক্রম যুগোপযোগী। তবে বর্তমান বাস্তবতায় তা বাস্তবায়নে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে রয়েছে যথাযথ প্রস্তুতির অভাব, শিক্ষার্থীর চাপ, দক্ষ শিক্ষক ও শিক্ষাসহায়ক উপকরণের সংকট, মানসম্মত প্রশিক্ষণ ও প্রথাগত মনোভাব।


নতুন শিক্ষাক্রমে পরীক্ষা ও মুখস্থনির্ভরতার পরিবর্তে অভিজ্ঞতানির্ভর পড়াশোনায় জোর দেওয়া হয়েছে। এতে বদলে গেছে চিরাচরিত পড়াশোনার পদ্ধতিও।


তবে শিক্ষাক্রমের এমন আমূল পরিবর্তন নিয়ে শুরু হয়েছে তুমুল বিতর্ক। এক পক্ষ বলছে, নতুন শিক্ষাক্রম যুগোপযোগী। একজন শিক্ষার্থীকে দক্ষ, যোগ্য ও সুনাগরিক হিসাবে গড়ে তুলতে এটি সহায়ক। অন্য একটি পক্ষ শিক্ষাক্রমের কড়া সমালোচনা করে বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছে।


রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় এ দাবিতে অভিভাবকরা মানববন্ধনও করেছেন। ফেসবুক গ্রুপ থেকে গড়ে ওঠা ‘সম্মিলিত শিক্ষা আন্দোলন’ নামের সংগঠন এখনো সক্রিয়। তবে মিথ্যা ও বিকৃত তথ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়ানোর অভিযোগে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) পক্ষ থেকে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের মামলায় ছয়জনকে পুলিশ গ্রেফতারও করেছে।


শিক্ষাবিদরা বলছেন, বর্তমান বাস্তবতায় নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে রয়েছে যথাযথ প্রস্তুতির অভাব, শিক্ষার্থীর চাপ, দক্ষ শিক্ষক ও শিক্ষাসহায়ক উপকরণের সংকট, মানসম্মত প্রশিক্ষণ এবং প্রথাগত মনোভাব।


শিক্ষকদের আন্দোলন : বিদায়ি বছরে শিক্ষকদের দাবি আদায়ে আন্দোলন নিয়ে ছিল বেশ আলোচনা। মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণের দাবিতে গত বছরের ১১ জুলাই শুরু করে ২৩ দিন রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন বেসরকারি শিক্ষকরা। তবে তাদের দাবি পূরণে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ এখনো নেয়নি সরকার।


এদিকে আন্তঃক্যাডারবৈষম্য নিরসন ও সুপারনিউমারারি পদ (নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সংখ্যার চেয়ে অতিরিক্ত পদ) সৃষ্টি করে পদোন্নতি দেওয়াসহ বিভিন্ন দাবিতে অক্টোবরে কর্মবিরতিতে নামেন বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা। পরে আন্দোলনকারী বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির নেতারা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে বৈঠক করে আন্দোলন স্থগিত করেন। এখন পর্যন্ত তাদের মূল দাবি পূরণ হয়নি। বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির নেতারা আশা করছেন, হয়তো দ্রুত সময়ের মধ্যে মূল দাবির একটি পদোন্নতি দেওয়া হতে পারে।


এদিকে প্রায় এক দশক পর পদোন্নতি জট খুলেছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। সহকারী শিক্ষকরা প্রধান শিক্ষক পদে পদোন্নতি পাচ্ছেন। গত ৩ আগস্ট লক্ষ্মীপুরের ২০৫ জন সহকারী শিক্ষককে পদোন্নতি দেওয়ার মাধ্যমে এ প্রক্রিয়া শুরু করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।


দেশজুড়ে অনুমোদনহীনভাবে গড়ে ওঠা কিন্ডারগার্টেনগুলোকে নিয়মের আওতায় আনতে ‘বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নিবন্ধন বিধিমালা’ জারি করেছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। প্রায় ১০ বছর চেষ্টার পর ২০২৩ সালে এ নীতিমালা করা সম্ভব হয়েছে। এটি নতুন মাইলফলক হিসাবে দেখছেন প্রাথমিক অধিদপ্তরের কর্মকর্তারাও।


২০২৩ সালের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় পাশের হার, জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল অন্য বছরের তুলনায় অনেক কম।


নির্বাচনের বছর হওয়ায় এবার দুই মাস আগে পাঠ্যবই ছাপানো শেষ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরকার। তবে সরকারের এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে লেজেগোবরে অবস্থায় পড়ে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। শিক্ষার্থীদের হাতে সব বই পৌঁছে দিতে চলতি বছর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। অপরদিকে চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তিতে ২৭ হাজার শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ)।


শেয়ার করুন