০১ মে ২০২৫, বৃহস্পতিবার, ১০:০৭:১৫ অপরাহ্ন
‘এসব দিবস আমাদের মতো দিনমজুরের জন্য আসেনি’
স্টাফ রিপোর্টার :
  • আপডেট করা হয়েছে : ০১-০৫-২০২৫
‘এসব দিবস আমাদের মতো দিনমজুরের জন্য আসেনি’

‘দিবস দিয়ে কি করমু? কাজ না থাকলে তো আমাদের পেট চলে না। দিনের বেতন দিনেই হয়, আজ যা ইনকাম হবে তা দিয়েই সংসার চলে। এসব কাজে কোনো নিরাপত্তা নেই। দুর্ঘটনা ঘটলেও আমাদের দেখার কেউ নেই। এ আয়ে পরিবার নিয়ে চলা খুব কষ্টকর।’ এভাবেই নিজের জীবনের গল্প বলছিলেন ফেনীর বড় বাজারে দিনাজপুর থেকে আসা শ্রমিক আসলাম উদ্দিন। 

বৃহস্পতিবার (১ মে) আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসে সরকারি ছুটি থাকলেও এই দিনেও আসলাম উদ্দিনের মতো অনেকে কাজে বের হয়েছেন।

জানা যায়, অন্যান্য জেলার তুলনায় ফেনীতে কাজ বেশি পাওয়া যায় বলে এই ভাসমান শ্রমিকরা বছরের সবসময় এখানে আসেন। তাদের বেশিরভাগ আসেন রংপুর, সিলেট, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, রাজশাহী, নাটোর, বগুড়া, বরিশাল, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, দিনাজপুর ও কুমিল্লাসহ অন্যান্য জেলা থেকে।

রংপুর থেকে আসা শ্রমিক হারুন মিয়া বলেন, প্রায় দশ বছর ধরে লেবারের কাজ করছি। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। কখনো প্রচণ্ড রোদ, কখনো বৃষ্টি, আবার কখনো ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে কাজ করি। ট্রাক থেকে মালামাল লোড-আনলোড করি। আবার মাঝেমধ্যে মানুষজনের বাজারের ব্যাগ গাড়িতে তুলে দেই। পেটের দায় তো আর দিবস মানবে না। ঘরে বসে থাকলে কেউ খোঁজও নেবে না। শরীরের ওপর অনেকসময় ভারী মালামাল পড়ে আহত হই। কিন্তু চিকিৎসা নেওয়ার সামর্থ্যও থাকে না আমাদের।

মে দিবস প্রসঙ্গে কথা হয় শহরের তাকিয়া রোডের মশলা কারখানার শ্রমিক শাহেদা আক্তারের সঙ্গে। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, মরিচ ও বিদ্যুৎ কাউকে ওস্তাদ মানে না। এ কাজের ঝাঁজ বেশি। চোখে পানি চলে আসে। আবার কখনো গলা শুকিয়ে যায়। আমার মতো অনেক নারী এখানে কাজ করছে। সকলেরই একই দশা। দৈনিক যে টাকা আয় হয় তাতে কোনোমতে খেয়ে-না খেয়ে সংসার চলে। আজকে কাজ করলে টাকা পাব, না করলে টাকা নেই। 

শাহেদার সঙ্গে মশলা ভাঙার কারখানায় কাজ করছেন ৪০ বছর বয়সী কাজল বেগম। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, প্রতিদিন ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করতে হয়। যখন মরিচ ভাঙা হয়, তখন শুধু চোখের পানি আসে। ধোঁয়ায় শ্বাস নিতে কষ্ট হয়, গলা ফুলে যায়। মেশিনের তাপও সহ্য করা কঠিন। কিন্তু আমাদের তো আর অন্য কোনো পথ নেই। শ্রমিক দিবসের ছুটির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, অসুস্থ হলেও ছুটি নেওয়া যায় না। একদিন কাজে না এলে মজুরি কেটে রাখা হয়। কাঁধে সংসারের দায়িত্ব আছে। কোনো দিবসের কথা বলে ঘরে বসে থাকার সুযোগ নেই।

বুধবার (৩০ এপ্রিল) দুপুরে ফুলগাজী সদরের বৈরাগপুরের এস আলম ব্রিকসে গিয়ে কথা হয় নেত্রকোণা থেকে আসা শ্রমিক মনুর সঙ্গে। শ্রমিক দিবসের কথা জানেন না উল্লেখ করে তিনি বলেন, একদিন কাজ না করলে টাকা পাওয়া যাবে না। বাড়তি আয়ের আশায় সারাদিন রোদে পুড়ে কাজ করছি। কাজ না করলে আনন্দও নেই। পরিবার সবসময় আমার দিকে তাকিয়ে আছে। এসব দিবস আমাদের মতো দিনমজুরের জন্য আসেনি। এজন্য খোঁজও রাখি না। 

ফেনী জেলা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ তোফাজ্জল হোসেন খান বলেন, ফেনীতে স্থানীয় শ্রমিকের সংখ্যা কম। খুলনা, বরিশাল, রংপুর, দিনাজপুরসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আগত শ্রমিকরাই মূলত বিভিন্ন পেশায় যুক্ত। কিছু কাজে বেশ ঝুঁকি রয়েছে। অসুস্থ হলেও অনেকসময় চিকিৎসা সুবিধা পাওয়া যায় না। চিকিৎসার অভাবে অনেক শ্রমিক পঙ্গুত্ব বরণ করেছে, কেউ কেউ মৃত্যুবরণও করেছে। বর্তমানে ব্যয়বহুল জীবনে এ আয় দিয়ে সংসার চলাও অত্যন্ত কষ্টকর। আমাদের জীবনমান উন্নয়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

প্রসঙ্গত, ১৮৮৬ সালের এই দিনে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটের শ্রমিকেরা শ্রমের উপযুক্ত মূল্য ও দৈনিক অনধিক আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে আন্দোলনে নামেন। ওই দিন আন্দোলনরত শ্রমিকদের ওপর পুলিশ গুলি চালায়। এতে অনেক শ্রমিক হতাহত হন। তাদের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে দৈনিক কাজের সময় আট ঘণ্টার দাবি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এরপর থেকে আন্তর্জাতিকভাবে দিনটি মে দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। বাংলাদেশেও যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হয়ে আসছে মে দিবস। এবারের মে দিবসের প্রতিপাদ্য হলো-‘শ্রমিক-মালিক এক হয়ে, গড়বো এ দেশ নতুন করে’।

শেয়ার করুন