০৫ মে ২০২৫, সোমবার, ০৪:০৪:০৪ অপরাহ্ন
শাপলা চত্বর হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে যত মাস্টারমাইন্ড
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৫-০৫-২০২৫
শাপলা চত্বর হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে যত মাস্টারমাইন্ড

দিনটি সামনে এলেই মানুষের বুকে কাঁপন ধরে। বিশেষ করে দেশের আপামর আলেম সমাজের হৃদয়ে শুরু হয় রক্তক্ষরণ। সাদা মনের ওই মানুষগুলো সেদিন ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার চাল বুঝতে না পেরে অকাতরে জীবন দিয়েছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আর দলীয় ক্যাডারদের দিয়ে আলেমদের দমাতে গিয়ে রাজপথ রক্তে রঞ্জিত করা হয়। সেই রক্তের ঋণ এখনো শোধ হয়নি। ২০১৩ সালের ৫ ও ৬ মের কথা।


মতিঝিলের শাপলা চত্বরে অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের একটি সাধারণ সমাবেশ ঠেকাতে পুরো রাষ্ট্র উঠেপড়ে লাগে। দিনের আলোতে পুলিশ-র‌্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অন্য শাখাগুলোর সদস্যরা আলেমদের ওপর বেপরোয়া হামলা, গুলি আর নির্যাতন শুরু করে। পথে পথে রক্ত। লাশ। এক ভীতিকর অবস্থা তৈরি করে সবার মনে নজিরবিহীন ভয় ধরিয়ে দিয়ে শাপলা চত্বর থেকে আলেমদের নির্মূল করতে সর্বাত্মক চেষ্টা করে। গুলির মুখেও ১৩ দফা দাবি বাস্তবায়নে তারা শাপলা ছাড়ছিলেন না। দিন শেষে রাত ঘনিয়ে এলে নির্যাতনের ধরন পালটে যায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী শুরু করে বেপরোয়া গুলি, টিয়ারশেল নিক্ষেপ। জীবন রক্ষায় দিগ্বিদিক ছুটতে গিয়েও গুলির মুখে পড়েন নানা বয়সি আলেমরা। এক বিভীষিকাময় রাত তাদের ওপর দিয়ে যায় ৫ মে।


হেফাজতের নেতাকর্মী তথা আলেমদের নির্মূলের নির্দেশদাতা শেখ হাসিনার ইচ্ছা পূরণে পুলিশের তৎকালীন আইজিপি, ডিএমপি কমিশনার ও র‌্যাব ডিজিসহ অনেক কর্মকর্তা সেই নিষ্ঠুর নির্যাতন আর খুনের দিনটিকে ‘অপারেশন সিকিউর শাপলা’ হিসাবে অবহিত করে উল্লাস করেছিলেন। আজ সেই বিভীষিকাময় কালোদিন। শেখ হাসিনার শাসনামলে হেফাজতের নেতাকর্মীদের হত্যাকাণ্ড নিয়ে কেউ কোনো সত্য প্রকাশ করতে পারেনি। মানবাধিকার সংগঠন অধিকার ৬১ জনকে হত্যার তালিকা প্রকাশ করে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের মুখে পড়ে। অধিকারের আদিলুর রহমান শুভ্রকে নেওয়া হয় জেলে। ওই সংগঠনের ওপর নেমে আসে আরও ভোগান্তি।


৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর ধীরে ধীরে আলোতে আসতে শুরু করে ৫ মে কত ভয়ংকর ও জঘন্যতম গণহত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনাসহ হত্যায় জড়িত সেই সময়ে রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে থাকা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের ইমরান এইচ সরকারসহ জড়িতদের বিরুদ্ধে হেফাজতে ইসলামের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট দুটি অভিযোগ দায়ের করা হয়। ‘সমাবেশ দমন করতে নিরস্ত্র মানুষের ওপর বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করে রাতের অন্ধকারে গুলি চালায় স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের বাহিনী।


এতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গণহত্যার নির্দেশদাতা হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রসিকিউশন হেফাজতের অভিযোগ আমলে নিয়ে মামলা হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করে। শেখ হাসিনাসহ ৯ জনকে সুনির্দিষ্টভাবে অভিযুক্ত করে মামলা রেকর্ডভুক্ত করা হয়। ৯ আসামির মধ্যে ৪ জন বিভিন্ন মামলায় গ্রেফতার। হাসিনাসহ ৫ পলাতক আসামির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। ১২ মে শুনানির দিন ধার্য আছে। মামলাটি এখন তদন্তাধীন। চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, এটা ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম মানবাধিকার লঙ্ঘন ও মানবতাবিরোধী অপরাধ। এজন্য ট্রাইব্যুনাল অনেক পর্যালোচনা করে এই ঘটনাকে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসাবে চিহ্নিত করে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। 


এই মামলার তদন্তে নিয়োজিত কর্মকর্তা (এএসপি) এফএম ইফতেখারুল আলম যুগান্তরকে বলেন, শাপলা চত্বরের হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি অনেক বড় ঘটনা। তদন্তে একটু সময় লাগবে। নিহত ব্যক্তিদের শনাক্ত ও রেকর্ড সংগ্রহ চলছে। মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’র তথ্যের বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে মাঠপর্যায়ে অপরাধীদের শনাক্তের চেষ্টা করছি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন শেখ হাসিনা। তার নির্দেশ ছাড়া কোনো অভিযান হয় না। এমন অভিযানে উনার নির্দেশ থাকবে, এটাই বাস্তবতা। 


হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী যুগান্তরকে বলেন, ৫ ও ৬ মে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের গণহত্যার নির্দেশদাতা ছিলেন পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার নির্দেশেই এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। তিনি বলেন, স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা কতজন আলেমকে হত্যা করেছে তা সঠিকভাবে নিরূপণ করা তখন সম্ভব হয়নি। কারণ আমরা তখন সেই পরিবেশ পাইনি। মাওলানা আজিজুল ইসলাম ইসলামাবাদী বলেন, অর্ধশত অপরাধী যারা এই অপকর্মের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছি। তদন্ত সাপেক্ষে আরও যারা অপরাধী তাদর আইনের আওতায় আনার জন্য আমরা দাবি উত্থাপন করেছি। 


নারী উন্নয়ন নীতি ও শিক্ষা নীতির বিরোধিতা করে ২০১০ সালে গড়ে উঠেছিল কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম। শাহবাগের আন্দোলনের বিপরীতে ব্লগারদের শাস্তির দাবিতে ২০১৩ সালের ৫ মে মতিঝিলে সমাবেশ ডেকেছিল হেফাজত। তাতে বিএনপি-জামায়তসহ ফ্যাসিস্ট আওয়ামী বিরোধী সব সমমনা দল তাদের সমাবেশে যোগ দেয়। এ কারণে হাসিনা সরকারের বুকে কাঁপন ধরে যায়। ভয় পেয়ে তার নির্দেশে গণহত্যা চালানো হয়।


এতে জড়িত পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে তারা হলেন- ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর, গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) হাসান মাহমুদ খন্দকার ও সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ। বিভিন্ন মামলায় গ্রেফতার থাকা চার আসামি হলেন-সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু, সাবেক আইজিপি একেএম শহিদুল হক, মেজর জেনারেল (অব.) জিয়াউল আহসান ও পুলিশের সাবেক উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মোল্যা নজরুল ইসলাম। তাদের ট্রাইব্যুনালে হাজির করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।


ঢাকার আদালতে হাসিনাসহ ৩৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা : শাপলা চত্বরে হেফাজত ইসলামের সমাবেশে নির্বিচারে গুলি চালানোর দায়ে ২০২৪ সালের ১৮ আগস্ট হাসিনাসহ আরও ৩৩ জনের বিরুদ্ধে এই মামলা করা হয়। বাংলাদেশ পিপলস পার্টির (বিপিপি) চেয়ারম্যান বাবুল সরদার চাখারী বাদী হয়ে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে এই মামলা করেন। মামলাটি বর্তমানে তদন্তাধীন। শেখ হাসিনা ছাড়াও মামলার উল্লেখযোগ্য আসামিরা হলেন, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সামরিক উপদেষ্টা তারেক সিদ্দিকী, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ফজলে নূর তাপস, সাবেক সংসদ-সদস্য রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু, আওয়ামী লীগের যুগ্ম মহাসচিব মাহবুবুল আলম হানিফ, জাহাঙ্গীর কবির নানক, সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ, হাসান মাহাবুব খন্দকার, র‌্যাবের সাবেক প্রধান একেএম শহিদুল হক, এনএসআইয়ের সাবেক প্রধান জিয়াউল হাসান, মতিঝিল বিভাগের সাবেক ডিসি বিপ্লব কুমার সরদার, মতিঝিল থানার সাবেক ওসি ওমর ফারুক।


শেয়ার করুন