মাছে-ভাতে বাঙালি। কথাটি সত্য বটে। কিন্তু নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের দাম যেভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে তাতে শাশ্বত এই সত্যভাষণ এখন ফিকে হয়ে আসছে। আমিষের ঘাটতি মেটাতে নিয়মিত মাছ-মাংসও অনেকের পাতে জুটছে না। সাধারণ মানুষের কেউ কেউ সপ্তাহে মাছ জোগাতে পারলেও মাসেও দেখা পাচ্ছে না মাংসের। তবে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দেখা দিয়েছে চাল, ডাল, ডিম ও আলুর দাম বেড়ে যাওয়ায়। এগুলো ছিল গরিবের সাধারণ খাবার। আর যারা কম দামে পাঙাশ, তেলাপিয়া কিনে মাছের স্বাদ নিতেন, তাদেরও এখন মাথায় হাত। জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির পর কোনোভাবেই স্বাভাবিক থাকছে না বাজার। চালের দাম বেড়েছে কেজিতে কমপক্ষে ১০ টাকা, ডাল ও আলুতে কেজিপ্রতি বেড়েছে ৫-৭ টাকা এবং ৪২ টাকা ডিমের হালি এখন ৫৫-৫৬ টাকা। ফলে ঘরে ঘরে প্রতিবেলা খাবারের বাজেটেই লেগেছে বড় ধাক্কা। পাঁচ সদস্যের পরিবারে শুধু খাবারের খরচ বেড়েছে ২০-২৫ শতাংশ।
এদিকে বাজার মনিটরিং এখন অনেকটা কাগুজে শব্দ। সংশ্লিষ্টদের দাবি, দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকারের অনেক সংস্থা মাঠে আছে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি অনেকের জন্য এখন পোয়াবারো হয়ে ধরা দিয়েছে। যেসব পণ্যের দাম যে হারে বাড়ার কথা নয়, তাও বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। সরেজমিন ঘুরে সোমবারও এমন চিত্র মিলেছে রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর অনেক কিছুই সাধারণের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির প্রভাব অন্যান্য খাতসহ সরাসরি নিত্যপণ্যের বাজারে এসে পড়েছে। পরিবহণ খরচ বাড়ায় সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম বাড়ানো হয়েছে। সীমিত আয় ও পণ্যের দাম বেশি হওয়ায় নিম্ন আয়ের মানুষ বেশি ভোগান্তিতে পড়েছে। কিন্তু কার্যত দেখার কেউ নেই। এমন অভিযোগ অনেকের।
রাজধানীর কাওরান বাজার, নয়াবাজার, মালিবাগ বাজার ও গুদারাঘাট কাঁচাবাজার ঘুরে খুচরা বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির পর প্রতিকেজি চাল মোটা চাল ৫৫-৫৬ টাকায় বিক্রি হয়েছে, যা আগে ৪৫-৪৬ টাকা ছিল। প্রতিকেজি মসুর ডাল বিক্রি হয়েছে ১৩৫ টাকা, যা আগে ১৩০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। প্রতিকেজি আলু ৫ টাকা বেড়ে ৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ৪২ টাকায় বিক্রি হওয়া প্রতি হালি ফার্মের ডিম ৫৫-৫৬ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর প্রতিকেজি পাঙাশ বিক্রি হয়েছে ১৮০ টাকা, যা জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির আগে ১৩০-১৪০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। প্রতিকেজি তেলাপিয়া বিক্রি হয়েছে ২২০ টাকা, যা আগে ১৬০ টাকা ছিল।
রাজধানীর কাওরান বাজারে কথা হয় ঠেলাগাড়ি চালক মো. ইমাম হোসেনের সঙ্গে। তিনি আক্ষেপ করে যুগান্তরকে বলেন, ‘আমি সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত মালামাল বহন করে ৪৮০ টাকা আয় করেছি। এই টাকা নিয়ে বাজারে এসেছি। কিন্তু বাজারে সবকিছুর দাম অনেক বেশি। তাই কী দিয়ে কী কিনব তা ভাবতেই কান্না পাচ্ছে। সন্তানরা গরুর মাংস খেতে চায়। কিন্তু কেজি ৭০০ টাকা হওয়ায় কেনার কথা চিন্তাই করতে পারি না। মাছ-মাংস ও সবজির দাম অনেক বাড়ার কারণে ডাল-ভাত, ডিম খেয়েই দিন পার করছি। কিন্তু হঠাৎ করে এগুলোর দাম আবারও বেড়ে গেছে। আগের চেয়ে চাল, ডাল, ডিম, আলু সবকিছুর দাম এখন বেশি। অথচ এগুলো দিয়ে আগে শর্টকাটে বেলা পার করতাম।’ তিনি বলেন, ‘যে টাকা নিয়ে বাজারে এসেছি তা দিয়ে এগুলো এখন কীভাবে কিনব, সেটাই ভাবছি। আমাদের এই বোবাকান্না কেউ শোনে না। কাজ করতে হলে কিছু খেয়ে বাঁচতে হবে। তাই এই টাকার মধ্যে অল্প করেই চাল, ডাল ও ডিম কিনব। মাছ আর আজ কেনা হবে না।’ তিনি জানান, ‘পরিবারে আমার মা, স্ত্রী ও দুই মেয়েসহ মোট পাঁচজন। সবার খোরাকি আমাকে জোগান দিতে হয়। অথচ একদিন গাড়ি পেলে দুদিন বসে থাকতে হয়।’
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান যুগান্তরকে বলেন, ‘সার্বিক মূল্যস্ফীতির কারণে এমনিতেই নিম্ন আয়ের মানুষ কষ্টের মধ্যে আছে। এর মধ্যে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে নিত্যপণ্যের বাজারে প্রভাব পড়েছে। এতে উচ্চশ্রেণির মানুষের ভোগান্তি না হলেও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো কষ্টে দিন কাটাচ্ছে। সবচেয়ে বেশি কষ্টে আছে নিম্ন আয়ের মানুষ। তারা তাদের আয়ের সঙ্গে ব্যয় সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। পণ্যের দাম বেশি হওয়ায় তা দিয়ে তাদের চাহিদা মেটাতে পারছে না। ফলে কেনার সময় অনেকে পরিমাণে কম কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। তাই সংশ্লিষ্টদের উচিত হবে, টিসিবি ও ওএমএসের মাধ্যমে বেশি করে ভর্তুকি মূল্যে পণ্য বিক্রি করা। এতে একটু হলেও কষ্ট দূর হবে।’
মালিবাগ কাঁচাবাজারে কথা হয় ভ্যানচালক মো. হাবিবুল্লাহর সঙ্গে। তিনি যুগান্তরকে বলেন, ‘বাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম বেশি। গরুর মাংস কবে কিনেছি তা মনে নেই। মাসে একবার মুরগির মাংস খেতে পারলেও এখন দাম নাগালের বাইরে। ডাল-ভাত খেতেও বাড়তি টাকা গুনতে হবে। ডিমের দামও নাগালের বাইরে চলে গেছে। সব মিলে আমাদের মতো মানুষের অনেক কষ্টে দিন পার করতে হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘মা-বাবা, স্ত্রী এবং দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে আমার মোট ছয়জনের সংসার। সবার খাবারের জোগান আমাকেই করতে হয়। কিন্তু সীমিত আয় দিয়ে এখন সংসার চালাতে খুবই কষ্ট হচ্ছে।’
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) এএইচএম সফিকুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশও এখন অস্থির সময় পার করছে। পাশাপাশি জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির পর বেশ কিছু পণ্যের দাম বেড়েছে। তাই অধিদপ্তর যতই চেষ্টা করুক না কেন, দাম পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা খুবই কঠিন কাজ। তারপরও বাজারে অভিযান পরিচালনা করে যৌক্তিক দামে পণ্য বিক্রি করার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। তবে ব্যবসায়ীদেরও একটু সহনশীল হতে হবে। অতি মুনাফা করা যাবে না। তা না হলে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।