দেশে বাড়ছে অপ্রয়োজনীয় সিজার। শহরের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে এই হার বেশি। সেভ দ্য চিলড্রেনের তথ্যমতে, ২০১৮ সালে এক বছরে বাংলাদেশে অপ্রয়োজনীয় সিজার হয়েছে ৮ লাখ ৬০ হাজার। মানুষের পকেট থেকে বেড়িয়ে যাচ্ছে মোটা অংকের টাকা।
দেশে সরকারি হাসপাতালেও ডেলিভারি করাতে মানুষের পকেট থেকে খরচ হয় ৬৫ শতাংশ অর্থ। বেসরকারিতেও শতভাগ নিজেদের টাকা। ‘ম্যাসিভ বোম অব সি-সেকশন ডেলিভারি ইন বাংলাদেশ: এ হাউজহোল্ড লেভেল এনালাইসিস ২০০৪-২০১৮’ শীর্ষক জরিপ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য। প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস)।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দিকনির্দেশনা হচ্ছে- একটি দেশে অপারেশন বা সিজার ১৫ শতাংশ হতে পারে। কিন্তু ২০১৭-১৮ সালের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে সেটি ৩২ দশমিক ২২ শতাংশ। যেটি ২০০৩-২০০৪ সালের দিকে ছিল ৩ দশমিক ৯৯ শতাংশ। এ ছাড়া গ্রামাঞ্চলে ওই সময়ে সিজার করে বাচ্চা হওয়ার হার ছিল ১ দশমিক ৯৭ শতাংশ, যেটি ২০১৭-১৮ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ২৯ দশমিক ১৮ শতাংশে।
এদিকে শহরে আগে থেকেই এই হার বেশি ছিল। ওই সময় শহরে সিজার করা হতো ১১ দশমিক ৭২ শতাংশ। এখন করা হয় ৪৪ দশমিক ২৪ শতাংশ।
বুধবার রাজধানী ঢাকার আগারগাঁও বিআইডিএস সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত সেমিনার সভাপতিত্ব করেন সংস্থাটির মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেন। জরিপের প্রতিবেদন তুলে ধরেন বিআইডিএসের পপুলেশন স্টাডিজ ডিভিশনের ড. আবদুর রাজ্জাক সরকার।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে বছরে যেভানে ৩২ দশমিক ২২ শতাংশ ডেলিভারি হয় সিজারে। সেখানে একই সময়ে ভারতে ২২ শতাংশ, পাকিস্তানে ২২ শতাংশ, নেপালে ১৬ ও মিয়ানমারে তা ১৭ শতাংশ।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে-বিডিএইচএস ২০০৪ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে অপারেশন করা নারীদের থেকে তথ্য নেওয়া হয়েছে। ২৭ হাজার ৩২৮ হাজার নারীর মধ্যে এ জরিপ চালানো হয়। তাদের বয়স ১৫ থেকে ৪৯ বছরের মধ্যে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সিজারের মাধ্যমে সন্তান জন্ম দিতে বেসরকারি হাসপাতালে সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় সিলেটে ও সবচেয়ে কম বরিশালে।
সেভ দ্য চিলড্রেনের তথ্য তুলে ধরে ড. আবদুর রাজ্জাক বলেন, ২০১৮ সালে এক বছরে বাংলাদেশে অপ্রয়োজনীয় সিজার হয়েছে ৮ লাখ ৬০ হাজার। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে সরকারি হাসপাতালে রোগীদের নিজেদের পকেট থেকে খরচ হয় ৬৫ শতাংশ অর্থ। বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিকে শতভাগই তাদের পকেট থেকে যায়। বাংলাদেশে সরকারি ডাক্তাররাই বেসরকারি হাসপাতালে চাকরি করছেন, অপারেশন করছেন। ডেলিভারিতে ধনী-গরিব সবার সমান অর্থ ব্যয় হয়। কেননা প্রত্যেকেই নিজের সবকিছু বিক্রি করে হলেও সন্তানকে ভালো রাখতে চায়।
আবদুর রাজ্জাক আরও বলেন, গ্রামে সিজারের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। তার মূল কারণ হচ্ছে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো গ্রামের দিকে মোড় নিচ্ছে। এক শ্রেণির দালাল এক্ষেত্রে প্রভাবিত করে। চিকিৎসকরাও বুঝে হোক না বুঝে হোক বা যেকোনো কারণে হোক মানুষদের সিজারে উৎসাহিত করছে।
সেমিনারে বক্তারা বলেন, বর্তমানের ডাক্তাররা স্বাভাবিক ডেলিভারি করাতে চান না। তাদের সময় বেশি চলে যায়। এজন্য তারা দ্রুত সিজার করে। সময়ও বাঁচে আবার টাকাও বেশি আয় হয়। তারা ভাবে স্বাভাবিক ডেলিভারির চেয়ে অপারেশনে সময় কম লাগে এবং অল্প সময়ে অনেকগুলো সিজার করা যায়। কতজন নারী সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে জীবিত থাকছে বা মারা যাচ্ছে, তাদের অপারেশনের পর সার্বিক অবস্থা বেশি একটা জানা যাচ্ছে না। অপারেশনের পর মা ও সন্তানের ওপর কী ধরনের প্রভাব পড়ছে- তা চিহ্নিতও করা যাচ্ছে না। আমাদের দেশের ধাত্রী প্রথা ছিল। সেটি হারিয়ে গেছে। অথচ সন্তান জন্ম নেওয়ার আগের লক্ষণগুলো এসব ধাত্রী ভালোভাবে ধরতে পারতেন। আবার অনেক সময় দেখা যায় ডাক্তারকে অগ্রিম টাকা দিতে হয়। না হলে তারা আসতে চান না। কিন্তু কোনো ধাত্রীর ক্ষেত্রে এমন অবস্থা তৈরি হয়নি যে, অর্থ না দিলে মাঝরাতে তিনি আসবেন না।
ড. বিনায়ক সেন বলেন, বাড়িতে ডেলিভারি এখন আর হয় না। আমরা প্রাতিষ্ঠানিক হচ্ছি। কিন্তু কোথায় যাওয়া হচ্ছে। দেখা যায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিকে নেওয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে অর্থনৈতিকভাবে মানুষ যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তেমনি শারীরিকভাবেও নানা ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। মায়েদের কর্মক্ষমতা কমে যায়। এ বিষয়ে গবেষণা করে দেখতে হবে। কেন অপ্রয়োজনীয় সিজার বাড়ছে।
পরকল্পনা কমিশনের সাবেক সদস্য (সচিব) ড. আব্দুস সাত্তার মন্ডল বলেন, আগে দেখা যেত গ্রামের টাকা শহরে চলে যেত মামলা মোকদ্দমার কারণে। এখন সেই জায়গা দখল করে নিয়েছে ডেলিভারির অপারেশন। যেকোনোভাবে মানুষ টাকা সংগ্রহ করেই হোক সিজার করাচ্ছেন। এতে করে মানুষের পকেট থেকে প্রচুর অর্থ হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে।