মাদকে ডুবছে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি)। প্রায় ২৯ হাজার শিক্ষার্থীর বাস এ ক্যাম্পাসে।
গাঁজা, ফেনসিডিল ও ইয়াবাসহ বিভিন্ন ধরনের ভয়ংকর মাদক কেনাবেচার অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে মতিহারের সবুজ চত্বর। সম্প্রতি গাঁজার ১২ পুঁটলিসহ ছাত্রলীগের চার নেতা আটকের ঘটনায় ক্যাম্পাসে মাদক কেনাবেচার বিষয়টি আবারও সামনে এসেছে।
রাবি প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলছেন, তারা ক্যাম্পাস থেকে মাদক উচ্ছেদে প্রাণপণ চেষ্টা করছেন। কিন্তু তাদের সীমিত অভিযানের ফাঁকফোকরে ক্যাম্পাসে মাদক ঢুকছে। আড়ালে আবডালে বিক্রি হচ্ছে। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের একটা অংশ রাবি ক্যাম্পাসে মাদক বাণিজ্য ও সেবনে জড়িয়ে যাওয়ায় সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে পারছেন না প্রশাসন।
জানা গেছে, কয়েক বছর ধরে রাবি ক্যাম্পাসে মাদকের আগ্রাসন মাত্রা ছাড়িয়েছে। চার দিক খোলা ক্যাম্পাসে শুধু রাতেই নয়, অবাধে মাদক ঢুকছে দিনের বেলাতেও। অভিযোগ রয়েছে, ছাত্রলীগ নেতারা ক্যাম্পাসজুড়ে তৈরি করেছেন মাদকের শক্ত নেটওয়ার্ক। তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে হিমশিম খাচ্ছেন রাবি প্রশাসন।
এমনকি পুলিশও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অনুমতি ছাড়া ক্যাম্পাসে কোনো অভিযান করতে পারছে না। এ সুযোগে ছাত্রলীগ নেতারা মাদকের অবাধ কারবার জমিয়ে তুলেছেন। দু’হাতে কামাচ্ছেন টাকা। চড়ছেন দামি মোটরসাইকেলে। কিছু ছাত্রলীগ নেতা পড়াশোনা শিকেয় তুলে ক্যাম্পাসে মাদকের অবাধ কারবার চালাচ্ছেন।
রাবি উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তারের ভাষায় ক্যাম্পাসে মাদক পরিস্থিতি সত্যিই ভয়ংকর বলতে হবে। আমরা পুলিশকে বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। রাবির প্রক্টরিয়াল বডি ক্যাম্পাসে মাদক ঠেকাতে প্রাণপণ চেষ্টা করছে। কিন্তু তারাইবা কতটা করবে? মাঝে মাঝে ধরে পুলিশকে দিচ্ছে। একদল ধরা পড়লে আরেক দল কারবারে নামছে।
রাবি প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, ৮ ডিসেম্বর রাবি ক্যাম্পাসের শেখ রাসেল স্কুল মাঠে বসে ১২ প্যাকেট গাঁজা বিক্রি করছিল ছাত্রলীগের চার নেতা। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে রাবি প্রক্টর অধ্যাপক আসাবুল হকের নেতৃত্বে প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যরা তাদের ৩২০ গ্রাম গাঁজাসহ হাতেনাতে আটক করেন। এই চার নেতা হলেন রাবির বঙ্গবন্ধু হল শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সোহানুর রহমান সোহান, শের-ই-বাংলা হল শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক রাজু আহমেদ, শহিদ শামসুজ্জোহা হল শাখা ছাত্রলীগের সাংস্কৃতিকবিষয়ক উপ-কমিটির সম্পাদক আরিফ বিন সিদ্দিক ও জিয়াউর রহমান হল শাখা ছাত্রলীগের পরিবেশবিষয়ক উপ-কমিটির সম্পাদক সাইফুল ইসলাম।
এদিকে এ চার ছাত্রলীগ নেতাকে প্রক্টর দপ্তরে আনা হয়। কিন্তু টয়লেটে যাওয়ার কথা বলে রাজু ও সোহান সটকে পড়েন। সাইফুল ও আরিফকে ঘটনার দিনই মতিহার থানায় সোপর্দ করে তাদের বিরুদ্ধে মাদক নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা দিয়ে আদালতে চালান করা হয়। তবে এ চার ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে কোনো সাংগঠনিক পদক্ষেপ নেয়নি রাবি শাখা ছাত্রলীগ।
জানা গেছে, রাজু ও সোহান রাবি শাখা ছাত্রলীগ সভাপতি গোলাম কিবরিয়ার ঘনিষ্ঠ। তদবির ও রাবি প্রশাসনের ওপর চাপ দিয়ে এ দুই ছাত্রলীগ নেতাকে ছাড়িয়ে নেওয়া হয়। ঘটনার দিন সন্ধ্যায় তাদের রাবি ছাত্রলীগ সভাপতির সঙ্গে ক্যাম্পাসের টুকিটাকি চত্বরে ঘুরতেও দেখা গেছে।
এ বিষয়ে ছাত্রলীগ সভাপতির দাবি আমি টুকিটাকি চত্বর থেকে হলের দিকে যাচ্ছিলাম। এ সময় তারা কখন আমার পেছন পেছন মোটরসাইকেলে এসেছে আমি খেয়াল করিনি।
এদিকে সরেজমিন জানা গেছে, রাবি ক্যাম্পাসে প্রবেশের নয়টি ফটক রয়েছে। এর মধ্যে প্রধান ফটক ও কাজলা গেট ছাড়া বাকি সাতটি ফটকই পুরোপুরি অরক্ষিত। নেই কোনো রক্ষী বা পুলিশ। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এসব গেট দিয়ে মোটরসাইকেলে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করছে বহিরাগতরা। তারা ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থানে বসে অবাধে মাদক সেবন করছে।
মাদক বিক্রেতারাও মোটরসাইকেলে ক্যাম্পাসে ঢুকছে আর মাদক হস্তান্তর করে বেরিয়ে যাচ্ছে। মাদকসেবীদের একটা বড় অংশ রাবির শিক্ষার্থী বলে ক্যাম্পাসের সূত্রগুলো থেকে জানা গেছে।
জানা গেছে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাটি আরএমপির মতিহার থানার আওতাধীন। মতিহার থানার পদ্মা পাড়ের জাহাজঘাট, কাজলা, মিজানের মোড়, ডাঁশমারী, বিনোদপুর প্রভৃতি এলাকায় রীতিমতো মাদকের হাট বসে সন্ধ্যার পর। স্থানীয়দের অভিযোগ এসব হটস্পটে পুলিশের নাকের ডগায় গভীর রাত পর্যন্ত চলে মাদক কেনাবেচা ও সেবন। এসব মাদকের একটি বড় অংশ চলে যায় রাবি ক্যাম্পাসে। ফোনে ফোনে ক্যাম্পাসে চলে মাদক সরবরাহের কাজ।
এ ব্যাপারে রাবি উপাচার্য ড. গোলাম সাব্বির সাত্তার যুগান্তরকে বলেন, আমি পুলিশকে বারবারই বলেছি তারা যেন ক্যাম্পাসে আসা মাদকের উৎস বন্ধে ব্যবস্থা নেয়। ক্যাম্পাসে নিয়মিত অভিযান করতেও বলেছি। কিন্তু পুলিশ সেটি করছে না। ক্যাম্পাসে মাদকের ছড়াছড়ি চলছে।
রাবি উপাচার্যের বক্তব্য প্রসঙ্গে রাজশাহী মহানগর পুলিশ কমিশনার (আরএমপি) আবু কালাম সিদ্দিক শনিবার দুপুরে বলেন, আমি উপাচার্যকে কয়েকবারই বলেছি আমরা ক্যাম্পাসে মাদকবিরোধী একটা বড় সমাবেশ করব শিক্ষার্থীদের নিয়ে। তিনি সাড়া দেননি। রাবি স্বায়তশাসিত প্রতিষ্ঠান। পুলিশ চাইলেও যখন তখন মাদকবিরোধী অভিযান করতে পারে না। রাবি কর্তৃপক্ষ আমাদের অনুমতি দিলে দ্রুত সময়ে ক্যাম্পাস থেকে মাদক উচ্ছেদ করতে পারব আশা করি।