১৯ নভেম্বর ২০২৪, মঙ্গলবার, ১০:২৬:০৪ পূর্বাহ্ন
হজের প্রতিদান একমাত্র জান্নাত
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৩-০৬-২০২২
হজের প্রতিদান একমাত্র জান্নাত

সামর্থ্যবান নারী-পুরুষের জন্য জীবনে একবার হজ করা ফরজ। সামর্থ্যবান বলতে আর্থিক ও দৈহিক সামর্থ্য উভয় বোঝায়। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, লোকসকল! আল্লাহতায়ালা তোমাদের ওপর হজ ফরজ করেছেন। হজরত আকরা ইবনে হাবিস (রা.) দাঁড়িয়ে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! এটা কি প্রত্যেক বছর ফরজ? উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, আমি যদি হ্যাঁ বলতাম তবে ফরজ হয়ে যেত। আর যদি প্রতি বছর হজ ফরজ হয়ে যেত তবে তা তোমরা সম্পাদন করতে সক্ষম হতে না। হজ জীবনে একবারই ফরজ। কেউ যদি একাধিক করে তবে তা হবে নফল হজ। (বুখারি : ৭২৮৮)।

ইবাদত সাধারণত তিন ধরনের। ১. ইবাদতে বদনি তথা দৈহিক ইবাদত যেমন সালাত, রোজা। ২. ইবাদতে মালি তথা আর্থিক ইবাদত যেমন জাকাত। ৩. ইবাদতে মুশতারিকাহ তথা দৈহিক ও আর্থিক উভয়ের সমষ্টি যেমন হজ। হজে শরীরের সুস্থতা যেমন প্রয়োজন তেমনি আর্থিক সচ্ছলতারও প্রয়োজন। সুতরাং হজের মধ্যে দৈহিক ও আর্থিক উভয় প্রকারের ইবাদত বিদ্যমান। তাই এর গুরুত্ব অপরিসীম।

হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে হজ করল এবং এ সময় অশ্লীল কাজ ও গুনাহের কাজ থেকে বিরত থাকল সে নবজাতক শিশুর মতো নিষ্পাপ হয়ে ফিরে আসবে। (বুখারি : ১৫২১, মুসলিম : ১৩৫০)।

অপর হাদিসে এসেছে, হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, তোমরা হজ ও উমরাহ সঙ্গে সঙ্গে কর, কেননা এ দুটি দারিদ্র্য ও গুনাহ এভাবে দূর করে, যেভাবে হাপর লোহা, স্বর্ণ ও রৌপ্যের ময়লা দূর করে। আর মকবুল হজের বিনিময় জান্নাত ব্যতীত কিছুই নয়। (ইবনে মাজাহ : ২৮৮৭)।

হাজিরা হলেন আল্লাহর মেহমান। মেহমানের চাহিদা পূরণ করা, মেহমানের দোয়া কবুল করা মেজবানের কর্তব্য। হাদিস শরিফে হাজিদের আল্লাহর প্রতিনিধি দল বলা হয়েছে এবং তাদের দোয়া কবুল ও মাগফিরাতের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, হজ ও উমরাহকারীরা হলেন আল্লাহর প্রতিনিধি দল। তারা যদি তাঁর কাছে প্রার্থনা করে তিনি তা কবুল করেন আর তারা যদি তাঁর কাছে ক্ষমা চান তিনি তাদের ক্ষমা করে দেন। (ইবনে মাজাহ : ২৮৯২)।

হজের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা যায়, হজ করলে আল্লাহ বান্দার গুনাহ মাফ করে দেন এবং হাজিরা আল্লাহর নৈকট্য লাভের সুযোগ লাভ করে। বান্দারা হজের মাধ্যমে সর্বোচ্চ সফলতা অর্জন করতে পারে। আর তা হলো জান্নাত লাভের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করা। যেমন হাদিসে এসেছে, হজে মাবরুর তথা মকবুল হজের প্রতিদান হলো একমাত্র জান্নাত। (তারিখুল কবির : ১/১৩৩)।

যেহেতু হজ দ্বারা হাজিরা গুনাহমুক্ত ও নিষ্পাপ হয়ে বাড়ি ফিরেন তাই তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও মুসাফাহা করে তাদের কাছে দোয়া চাইতে হাদিস শরিফে উৎসাহিত করা হয়েছে। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, যখন তুমি কোনো হাজির সাক্ষাৎ পাবে তাকে সালাম করবে, তার সঙ্গে করমর্দন করবে এবং তাকে অনুরোধ করবে যেন তোমার জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা চায়, তার ঘরে প্রবেশের আগে। কেননা হাজিকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছে। (ইবনে হিব্বান, আল-মাজরুহাইন : ২/২৭৪)।

সাধারণত যে কাজে কষ্ট বেশি সে কাজের সাওয়াব ও ফজিলতও বেশি। তাই নবিজি (সা.)-এর প্রতি ইমান আনার পর জিহাদ ও হজকে সর্বোত্তম আমল বলেছেন। যেমন হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.)কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, সর্বোত্তম আমল কোনটি? উত্তরে তিনি বলেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ইমান আনা। প্রশ্ন করা হলো-তারপর কোনটি? উত্তরে তিনি বলেন, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা। পুনরায় প্রশ্ন করা হলো-এরপর কোনটি? উত্তরে তিনি বলেন, হজে মাবরুর তথা মকবুল হজ। (বুখারি : ১৫১৯, মুসলিম : ৮৩)।

যাদের ওপর হজ ফরজ হয়েছে যত দ্রুত সম্ভব হজ আদায় করা উত্তম। কারণ, হজ বছরে নির্দিষ্ট সময়ে একবার আদায় করতে হয়। যেখানে মানুষের হায়াত-মউতের এক সেকেন্ডেরও বিশ্বাস নেই, সেখানে দীর্ঘ এক বছর অনেক লম্বা সময়। রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি হজ করার ইচ্ছা করেছে সে যেন তাড়াতাড়ি হজ করে নেয়। (সুনানু আবি দাউদ : ১৭৩২)।

হজ দৈহিক ও আর্থিক উভয়ের সমষ্টি ইবাদত। এতে বিনা কারণে প্রতিনিধিত্ব জায়েজ নেই, তবে ওজর থাকলে প্রতিনিধি হিসাবে অন্য কেউ আদায় করে দিলে হয়ে যাবে। আর এ ওজরটি স্থায়ী হতে হবে। যেমন যার ওপর হজ ফরজ হয়েছে সে যদি স্থায়ী রোগে আক্রান্ত হয় কিংবা মৃত্যুবরণ করে এমতাবস্থায় তার পক্ষে অন্য কেউ হজ আদায় করতে পারবে। এ বিষয়ে হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, খাসআম গোত্রের এক মহিলা জিজ্ঞেস করল, ইয়া রাসূল্লাল্লাহ! আমার বৃদ্ধ পিতার ওপর হজ ফরজ হয়েছে। বাহনের ওপর বসার ক্ষমতা নেই। আমি কি তার পক্ষে হজ আদায় করতে পারব? উত্তরে তিনি বললেন, হ্যাঁ, পারবে। আর এ ঘটনাটি ঘটেছে বিদায় হজের সময়। (বুখারি : ১৫১৩, মুসলিম : ১৩৩৪)।

অপর হাদিসে এসেছে, হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে এসে বলল, আমার বোন হজ করার মানত করেছিল। কিন্তু হজ করার আগে ইন্তেকাল করেছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, তার ওপর যদি ঋণ থাকত তাহলে তুমি কি তা আদায় করতে? সে বলল, হ্যাঁ আদায় করতাম। রাসূল (সা.) বললেন, তাহলে আল্লাহর ঋণ আদায় কর। কারণ তার হক আদায় করা অধিক প্রয়োজন। (বুখারি ও মুসলিম, সূত্র : মিশকাত শরিফ, পৃষ্ঠা-২২১, হাদিস নং-২৩৮৮)।

হজ ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। বিনা কারণে পরিত্যাগ করা মারাত্মক গুনাহ। হজ পরিত্যাগকারী সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন এবং নবিজি (সা.)ও এ ব্যাপারে সতর্ক করেছেন। যেমন হজরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি বাইতুল্লায় পৌঁছার পথ খরচের মালিক হয়েছে, অথচ হজ করল না, সে ইহুদি হয়ে মৃত্যুবরণ করুক অথবা নাসারা হয়ে এতে কিছু আসে যায় না। (তিরমিজি : ৮১২, আদ-দুয়াফাউল কবীর : ৪/৩৪৮)।

অনেক ধনাঢ্য ব্যক্তিকে দেখা যায় তারা বিভিন্ন অজুহাতে হজে বিলম্ব করে কিংবা হজ থেকে বিরত থাকে। কেউ বলে আগে একটা বাড়ি করি তারপর হজ করব। কেউ বলে আগে ছেলেমেয়েদের বিয়ে দিয়ে পরে হজ করব আবার কেউ বলে এত তাড়াতাড়ি হজ করলে রাখতে পারব না, বয়স হোক তারপর হজ করব ইত্যাদি। কিন্তু এসব অজুহাত শরিয়তে গ্রহণযোগ্য নয়। বরং ধন, স্বাস্থ্য হায়াত চিরস্থায়ী নয় বিধায় যথাসম্ভব হজ তাড়াতাড়ি আদায় করা উত্তম। (মাজমাউদ জাওয়ায়েদ, তাবরানি কবির, আত-তারগিব ওয়াত তারহিব)।

হজ মহান আল্লাহ পাকের নির্দেশ এবং মুসলমানদের গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। কোনোভাবেই এ মহান ইবাদতকে পরিত্যাগ করা উচিত নয়। তাই, যাদের ওপর হজ ফরজ হয়েছে তারা যেন দ্রুত হজ আদায় করে নেয়। বিভিন্ন অজুহাতে হজকে বিলম্ব করা মোটেও উচিত নয়। দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণে হজ আদায় করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা মুমিন-মুসলমানদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। আল্লাহ পাক আমাদের জীবনে একবার হলেও হজ আদায় করার তৌফিক দান করুন, আমিন।

লেখক : সহকারী মাওলানা, চরণদ্বীপ রজভীয়া ইসলামিয়া ফাজিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসা, বোয়ালখালী, চট্টগ্রাম।

শেয়ার করুন