বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তিন কোটি টাকার আলোচনা যেন হাতপাখার পিছু ছাড়ছে না। এ ব্যাপারে হাতপাখার এক অনুসারী মামলা করায় তা আরও বেশি আলোচিত হচ্ছে। এতে মেয়র সাদিক আবদুল্লাহ নামও জড়িয়ে পড়ছে। নৌকার প্রার্থী খোকন সেরনিয়াবাত ও মেয়র সাদিক অনুসারীদের বিরোধও মিটছে না। এর প্রভাব আওয়ামী লীগের প্রার্থী খোকনের নির্বাচনি ইশতেহারেও পড়েছে। বুধবার ঘোষিত খোকনের ইশতেহারের বেশ কিছু দফায় সাদিকের স্পষ্ট বিরোধিতা করা হয়েছে।
এদিকে, আওয়ামী লীগের বিভক্তির সুযোগ নিতে লাঙ্গলের প্রার্থী ইকবাল হোসেন তাপস তৎপর হয়ে উঠেছেন। সরকারের নানা ব্যর্থতা তিনি ভোটারদের সামনে তুলে ধরছেন। ভোটাররাও সেসব লুফে নিচ্ছে। ভোটের দিন তাপস সেনা মোতায়েনের দাবি জানিয়েছেন। সব মিলিয়ে পালটাপালটি অভিযোগ আর তর্কবিতর্কে নির্বাচনি পরিবেশ জমজমাট হয়েছে।
জানা গেছে, খোকন ও সাদিকের অনুসারীদের দ্বন্দ্ব নিরসনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নির্বাচনি টিমের প্রধান হাসানাত আবদুল্লাহ এমপি উদ্যোগ নিয়েছিলেন। উদ্যোগের অংশ হিসাবে গৌরনদীতে দলের বর্ধিত সভায় গিয়েছিলেন খোকন। সেখানে দুই ভাইয়ের আলিঙ্গনের ছবি প্রচার হওয়ার পর নৌকার পালে হাওয়া লাগল ভেবেছিল সবাই। কিন্তু নৌকাকে ঠেকাতে হাতপাখার প্রার্থীকে তিন কোটি টাকা দেওয়ার অভিযোগ করেন আওয়ামী লীগ নেতা ও কাউন্সিলর প্রার্থী আনিসুর রহমান শরীফ। তার এ অভিযোগের পর গোল বাঁধে। ওই বক্তব্য ভাইরাল হলে জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের কমিটি থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়।
এদিকে, মঙ্গলবার রাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল এক ভিডিওতে দেখা যায়-হাতপাখার প্রার্থী মুফতি ফয়জুল করিমকে ভোট দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন ১০নং ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর ও প্রার্থী এটিএম শহিদুল্লাহ কবির। প্রকাশ্যে হাতপাখায় ভোট দেওয়ার ইঙ্গিত করা কবির মহানগর আওয়ামী লীগের সদস্য এবং মেয়র সাদিকের অনুসারী। এ বিষয়ে কথা বলার জন্য কবিরের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দেওয়া হলেও তিনি ধরেননি। এ ব্যাপারে খোকনের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য বরিশাল আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট লস্কর নূরুল হক বলেন, আমরা তো শুরু থেকে বলে আসছি-আমাদের একটি অংশ ও তাদের অনুসারী কাউন্সিলর প্রার্থীরা নৌকার বিপক্ষে কাজ করছেন। এ ঘটনা তারই প্রমাণ।
আওয়ামী লীগের একাংশের দাবি-সাদিক অনুসারীদের কাছ থেকে সুবিধা নিয়ে নৌকার প্রার্থীকে হারাতে মাঠে নেমেছেন হাতপাখার প্রার্থী মুফতি ফয়জুল করিম। তবে এ অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে ফয়জুল সাংবাদিকদের বলেন, এটা একটা ষড়যন্ত্র। আমাদের অবস্থান ভালো দেখে গুজব ছড়ানো হচ্ছে। এদিকে, বুধবার হাতপাখার পক্ষ থেকে বরিশালের সাইবার ট্রাইব্যুনালে মামলা হয়েছে। হাতপাখার অনুসারী আরিফুর রহমানের করা মামলায় আনিসুর রহমান শরীফকে একমাত্র আসামি করা হয়েছে। মামলার বিষয়কে সহজভাবে নিচ্ছে না অনেক ভোটার। ১৮নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা ফারুক বলেন, এ যেন ঠাকুর ঘরে কেরে, আমি কলা খাইনি। অভিযোগকারী ও অভিযুক্ত দুজনই যেখানে আওয়ামী লীগের সেখানে হাতপাখার লোকজন কেন মামলা করল? অভিযোগ সত্যি না হলে এ নিয়ে তো তাদের মাথাব্যথা থাকারু কথা নয়। মামলা করে তারা নিজেরাই জানান দিল-‘ডাল মে কুছ কালা হ্যায়।’
বুধবার নির্বাচনি ইশতেহার ঘোষণা করেছেন নৌকার প্রার্থী খোকন সেরনিয়াবাত। ৩৫ দফার ইশতেহারের অধিকাংশ স্থানে মেয়র সাদিকের নেওয়া নানা উদ্যোগের বিরুদ্ধে অবস্থান মিলেছে। সাদিকের সবার কাছে দুষ্প্রাপ্য হয়ে থাকা, হোল্ডিংসহ বিভিন্ন ধরনের ট্যাক্স বৃদ্ধি, প্ল্যান অনুমোদনে জটিলতা এবং অন্য যেসব বিষয়ে নগরবাসীর বিরাগভাজন ছিলেন সাদিক। ইশতেহারের দফাগুলোয় সেসব সমস্যা সমাধানের বর্ণনা রয়েছে। নিু আয়ের মানুষের জন্য মেয়র হিরনের সময় চালু সিডিসি প্রকল্প সাদিক বন্ধ করেছিলেন, সেটিও আবার চালুর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন খোকন। মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আমিন উদ্দিন মোহন বলেন, সাদিকের অনিয়মতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডে সৃষ্ট মানুষের ক্ষোভ আজকে খোকনের পক্ষে গণজোয়ারের সৃষ্টি করেছে। এসব বিষয় মাথায় রেখে এগোচ্ছেন আমাদের প্রার্থী।
এদিকে, আওয়ামী লীগের বিভক্তি আর হাতপাখার জটিলতার সুযোগ নিতে লাঙ্গলের প্রার্থী ইকবাল হোসেন তাপস মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছেন। সাধারণ ভোটারদের সমর্থন পেতে তিনি এসব ইস্যুকে কাজে লাগাচ্ছেন। নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি, বিদ্যুতের লোডশেডিং এবং আওয়ামী লীগের একাংশের সঙ্গে হাতপাখার সখ্যতার অভিযোগ তিনি তুলে ধরছেন। পাশাপাশি নির্বাচনি মাঠে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড না থাকার অভিযোগও তিনি তুলছেন। পক্ষপাতিত্বের অভিযোগে তিনি রিটার্নিং কর্মকর্তার প্রত্যাহারও দাবি করেছেন। ভোটের দিন সেনা মোতায়েনের দাবি তার। তিনি বলেন, নগরে বহিরাগতদের আনাগোনা বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি কালো টাকার খেলা শুরু হয়েছে। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে পুরো বিভাগের নেতাকর্মীদের বরিশালে এসে নৌকার পক্ষে কাজ করতে বলা হচ্ছে। অথচ নির্বাচনি এলাকায় বহিরাগতদের থাকার কথা নয়। সরকারের বিভিন্ন বিভাগও নৌকার পক্ষে কাজ করছে। এমন অবস্থায় সেনা মোতায়েন করা না হলে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না।