বর্তমান সরকারের যোগাযোগ অবকাঠামোর আরেকটি মাইলফলক ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে (উড়াল সড়ক)। দেশের সবচেয়ে বড় উড়াল সড়কটি আগামী ২ সেপ্টেম্বর খুলে দেওয়া হচ্ছে। এই সড়কে প্রতিটি গাড়ির সর্বনিম্ন গতিবেগ থাকবে ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটার। তবে র্যাম্প ব্যবহারের সময় গতি থাকবে ঘণ্টায় ৩০-৪০ কিলোমিটার। উড়াল সড়কটি চালু হলে মাত্র ১০ মিনিটেই উত্তরা থেকে ফার্মগেট পৌঁছানো যাবে। ফলে রাজধানীর উত্তরা থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত বিমানবন্দর সড়কের ৩০ শতাংশ যানজট কমে যাবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
রাজধানীর উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের জন্য ১৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার দীর্ঘ উড়াল সড়কটি নির্মাণ করা হচ্ছে। যানজট নিরসনে রাজধানীর বিমানবন্দরের কাওলা থেকে যাত্রাবাড়ীর কুতুবখালী পর্যন্ত নির্মাণ করা হচ্ছে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। এর মধ্যে কাওলা থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত সাড়ে ১১ কিলোমিটার অংশটি আগামী শনিবার আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উদ্বোধন উপলক্ষে আগামী ২ সেপ্টেম্বর বিকেল ৩ টায় রাজধানীর শেরে-বাংলা নগরে পুরাতন বাণিজ্যমেলার মাঠে সুধী সমাবেশে বক্তব্য রাখবেন প্রধানমন্ত্রী। ইতোমধ্যে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাওলা-ফার্মগেট অংশের কাজ শেষ হয়েছে। সর্বশেষ উড়াল সড়কের বিভিন্ন স্থানে লাইটিং বসানোর কাজ শেষ হয়েছে। আগামী দুই/একদিনের মধ্যে সড়কবাতিতে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হবে বলে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান।
তবে এই সড়কে মোটরসাইকেল ও সিএনজিসহ কোনো থ্রি হুইলার চলাচল করতে পারবে না। শুধু বাস, মিনিবাস, প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস, পণ্যবাহী ট্রাক ও পিকআপসহ ৮ ধরনের গাড়ি চলাচল করতে পারবে। উড়াল সড়কে উঠলেই দিতে হবে টোল। এর মধ্যে প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস, পিকআপ ও হাল্কা ট্রাকের টোল ৮০ টাকা, যাত্রাবাহী বাস ও মিনিবাস ১৬০, মাঝারি ট্রাক (৩ টনের বেশি) ৩২০ টাকা ও ভারি পণ্যবাহী ট্রাকের টোল ৪০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। সড়কে ওঠার সময় টোল পরিশোধ করতে হবে এসব পরিবহনকে। তাই, টোলপ্লাজাগুলো ডিজিটাল করার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের। তা না হলে উড়াল সড়কে ওঠা ও নামার সময় যানজটের আশঙ্কা করছেন তারা।
এ বিষয়ে গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ ও স্থপতি ইকবাল হাবিব জনকণ্ঠকে বলেন, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে শুধু পাইভেটকার, মাইক্রোবাস, যাত্রীবাহী বাস ও পণ্যবাহী ট্রাক চলাচল করতে পারবে। এজন্য নির্দিষ্ট পরিমাণের টোল পরিশোধ করতে হবে। ফার্মগেট পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের একটি অংশ চালু হলে উত্তরা-ফার্মগেট সড়কে প্রাইভেটকারের চাপ কিছুটা কমবে। কারণ, ওই সড়কে প্রাইভেটকারের চাপ একটু বেশি থাকে। তাই স্বাভাবিকভাবে বলা যায়, উড়াল সড়ক চালু হলে ওই সড়কের ৩০ শতাংশ যানজট কমতে পারে। কিন্তু উড়াল সড়কের ওঠা ও নামার র্যাম্পে ভালোভাবে ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট করতে হবে। এছাড়া টোলপ্লাজাগুলো ডিজিটাল করতে হবে। যাতে গাড়ি দ্রুত টোলপ্লাজা অতিক্রম করতে পারে। তা না হলে উড়াল সড়কে গাড়ি ওঠা ও নামার সময় যানজটের সৃষ্টি হতে পারে বলে জানান তিনি।
প্রকল্প সূত্র জানায়, রাজধানীর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের দক্ষিণে কাওলা-কুড়িল-বনানী-মহাখালী-তেজগাঁও-মগবাজার-কমলাপুর-সায়েদাবাদ-যাত্রাবাড়ী-ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক (কুতুবখালী) পর্যন্ত উড়াল সড়কটি নির্মাণ করা হচ্ছে। মূল উড়াল সড়কের দৈর্ঘ্য ১৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার। তবে সড়কে ওঠা-নামার জন্য ২৭ কিলোমিটার দীর্ঘ ৩১ টি র্যাম্প নির্মাণ করা হচ্ছে। র্যাম্পসহ প্রকল্পের মোট দৈর্ঘ্য ৪৬ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার। প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৮ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে ঢাকা শহরের যানজট অনেকাংশে কমে যাবে এবং ভ্রমণের সময় ও খরচ হ্রাস পাবে। ঢাকা শহরের উত্তর-দক্ষিণ অংশের সংযোগ ও ট্রাফিক ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। উত্তর ও দক্ষিণ গেটওয়ের সংযোগ উন্নত হবে। পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) মাধ্যমে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে সেতু কর্তৃপক্ষ। তাই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে সার্বিকভাবে যোগাযোগ ব্যবস্থার আধুনিকায়ন ও দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলবে বলে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান।
এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক এ এইচ এম শাখাওয়াত আকতার জনকণ্ঠকে বলেন, তিনটি অংশে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পটি। এর মধ্যে প্রথম অংশ: বিমানবন্দরের দক্ষিণে কাওলা থেকে বনানী রেলস্টেশন পর্যন্ত মোট দৈর্ঘ্য ৭ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার। এ অংশের অগ্রগতি ৯৮ শতাংশ। দ্বিতীয় অংশ: বনানী রেলস্টেশন থেকে মগবাজার পর্যন্ত ৫ দশমিক ৮৫ কিলোমিটার। এই অংশের অগ্রগতি ৫৮ শতাংশ। তৃতীয় অংশ: মগবাজার-যাত্রাবাড়ী হয়ে কুতুবখালী পর্যন্ত দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ৬৩ কিলোমিটার। এ অংশের অগ্রগতি ৬ শতাংশ। সার্বিকভাবে এ পর্যন্ত প্রকল্পের ৬৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে।
সরেজমিনে রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় দেখা গেছে, সরকারি তেজগাঁও কলেজের সামনে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের একটি র্যাম্প নামানো হয়েছে। এই র্যাম্প ব্যবহার করে উড়াল সড়ক থেকে গাড়ি নিচের সড়কে নামতে পারবে। র্যাম্পটির নির্মাণের সকল কাজ শেষ হয়েছে। কিছুদিন আগে কার্পেটিং ও লাইটিং বসানোর কাজ শেষ হয়েছে। ৩০ মিটার দূরত্বে একেকটি বৈদ্যুতিক বাতি বসানো হয়েছে। সকল প্রস্তুতি শেষে এখন উদ্বোধনের অপেক্ষা বলে নির্মাণ শ্রমিকরা জানান।
আমিন নামের এক নির্মাণ শ্রমিক জনকণ্ঠকে বলেন, ফার্মগেট এলাকায় গাড়ি নিচে নামার জন্য শুধু এই র্যাম্প ব্যবহার করতে পারবে। গাড়ি উড়াল সড়কে ওঠার জন্য র্যাংগস ভবনের সামনের ফ্লাইওভার ব্যবহার করতে হবে। এই দুটি র্যাম্প দিয়ে উড়াল সড়কে গাড়ি ওঠা-নামা করতে পারবে। উত্তরা-ফার্মগেট পর্যন্ত উড়াল সড়কে গাড়ি ওঠা-নামার জন্য ১৫ টি র্যাম্প রয়েছে বলে জানান তিনি।
প্রকল্প সূত্র জানায়, উত্তরা-যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত চার লেনের এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মূল লেনের দৈর্ঘ্য ১৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সংলগ্ন কাওলা থেকে তেজগাঁও রেলগেট পর্যন্ত দৈর্ঘ্য সাড়ে ১১ কিলোমিটার। পুরো প্রকল্পটির কাজ শেষ হলে বিমানবন্দর থেকে মাত্র ১৫-২০ মিনিটেই যাত্রাবাড়ী যাওয়া যাবে। বিমানবন্দর থেকে ফার্মগেট অংশের সঙ্গে সম্পৃক্ত সংযোগ সড়কের কার্পেটিং শেষ করা হয়েছে। এরই মধ্যে রাস্তায় বৈদ্যুতিক বাতি বসানোর কাজ শেষ হয়েছে।