রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে ফসলি জমিতে চলছে পুকুর খনন। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, জনপ্রতিনিধি ও অর্থনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা এর উদ্যোক্তা। পুলিশ ও উপজেলা প্রশাসনের সঙ্গে ‘মৌখিক সমঝোতা’ করে ফসলি খেতের মাটি কাটছেন তাঁরা। পরে তা নেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন ইটভাটায়।
বেশ কয়েকজন উদ্যোক্তা ‘সমঝোতা’ করে পুকুর কাটার কথা স্বীকার করেছেন। তবে প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারা তা অস্বীকার করেছেন। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, যেখানে-সেখানে পুকুর খনন করায় ফসলি জমির শ্রেণি পরিবর্তন হচ্ছে। সেচকাজ বাধাগ্রস্ত হয়ে কমছে ফসলের উৎপাদন। তা ছাড়া পুকুরের মাটি বহনকারী ট্রাক্টর চলায় গ্রামীণ সড়ক ও খেতের সীমানাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
২০২২ সালের জরিপের বরাত দিয়ে উপজেলা সহকারী কৃষি কর্মকর্তা খ ম জামাল উদ্দিন জানান, পুঠিয়ায় কৃষিজমির পরিমাণ ৯ হাজার ৬২৯ হেক্টর। এর মধ্যে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২৭০ হেক্টরে পুকুর খনন হয়েছে। এসব পুকুর খননের জন্য কৃষি অফিস থেকে কোনো অনুমতি নেওয়া হয়নি।
গত বৃহস্পতিবার ঘুরে দেখা গেছে, বেলপুকুর ইউনিয়নের বেলপুকুর গ্রামে প্রায় ৫০ বিঘা জমিতে পুকুর খনন করছেন উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক সুমনউজ্জামান সুমন। শিলমাড়িয়া ইউনিয়নের কাচুপাড়া এলাকায় কয়েকজন কৃষকের প্রায় ৭০ বিঘা জমি ইজারা নিয়ে খননকাজ শুরু করেছেন পচামাড়িয়া ওয়ার্ড যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুর রহমান। ভালুকগাছি ইউনিয়নে ২০ বিঘা জমিতে পুকুর খনন করছেন জিউপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য জুয়েল হোসেন। নন্দনপুর এলাকায় ১০ বিঘা জমিতে পুকুর খনন করছেন ওই এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত জাহাঙ্গীর আলম।
পুকুর খননের বিষয়ে সুমনউজ্জামান সুমন বলেছেন, তিনি এর সঙ্গে জড়িত না। দলের কিছু `ছেলেপেলে’ (নেতা-কর্মী) এটি (পুকুর খনন) করছে। সাইদুর রহমান বলেছেন, সবাইকে `ম্যানেজ’ করেই পুকুর খনন করছেন। এর জন্য আলাদা করে অনুমতির প্রয়োজন নেই। আর জনপ্রতিনিধি জুয়েল হোসেন ও নন্দনপুরের বাসিন্দা জাহাঙ্গীর আলম অনুমতির বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি।
এদিকে পুকুর খননের উদ্যোক্তাদের দেওয়া নানা প্রতিশ্রুতিতে জমি ইজারা দিয়েছেন মালিকেরা। বেলপুকুর এলাকায় খননকৃত পুকুরে জমি আছে আবুল হোসেনের। তিনি বলেন, বছর শেষে যুবলীগ নেতা সুমন জমি ইজারার টাকা মালিকদের পরিশোধ করবেন বলে একটা চুক্তি হয়েছে। ওই পুকুরের মাটি তিনি (সুমন) বিভিন্ন ইটভাটায় বিক্রি করেছেন।
কাচুপাড়া এলাকার সাজেদুর রহমান বলেন, যুবলীগ নেতা সাইদুর বলেছেন বছরে প্রতিবিঘা জমির জন্য ২০ হাজার টাকা দেবেন। কোনো প্রকার চাষাবাদ করা ছাড়াই টাকা আয় হবে। এ কারণে তিনিসহ কমপক্ষে ২১ জন কৃষক তাঁদের জমিতে পুকুর খনন করতে দিয়েছেন।
স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চলতি বছরের শুরু থেকে এসব পুকুর খনন চলছে। কিন্তু জমির শ্রেণি পরিবর্তন ঠেকাতে প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এ নিয়ে জেলা প্রশাসকসহ বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন উপজেলা পরিষদের মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান মৌসুমী রহমান। এরপরও প্রশাসন নীরব।
জানতে চাইলে মৌসুমী রহমান বলেন, এবার বর্ষায় বৃষ্টিপাত না হওয়ায় গত সপ্তাহ থেকে বিভিন্ন এলাকায় আবারও পুকুর খনন শুরু হয়েছে। মূলত নানা প্রলোভনে সাড়া দিয়ে মালিকেরা জমি দিচ্ছেন। এভাবে পুকুর খনন করা হলে ভবিষ্যতে ফসলি জমি রক্ষা করা কঠিন হয়ে যাবে।
মৌসুমী রহমানের অভিযোগ, কোনো অনুমতি ছাড়াই খননকারীরা বিভিন্ন দপ্তরকে `ম্যানেজ’ করে রাতের অন্ধকারে পুকুর খনন করছেন। তাঁরা কোনো বাধাই মানছেন না। এতে জমির উপরিভাগের উর্বর মাটি চলে যাচ্ছে বিভিন্ন ইটভাটায়।
এদিকে সমঝোতার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) একেএম নুর হোসেন নির্ঝর ও পুঠিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফারুক হোসেন। ওসি বলেন, কয়েক দিন ধরে একটি মহল রাতের অন্ধকারে আবারও কয়েকটি স্থানে পুকুর খনন করছে। থানা-পুলিশ পুকুর খনন বন্ধে মাঝেমধ্যেই অভিযান চালায়। তখন খননযন্ত্র ও ট্রাক্টরের ব্যাটারিসহ বিভিন্ন যন্ত্রাংশ খুলে আনা হয়। আইনগত ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হচ্ছে।
ইউএনও বলেন, পুকুর খনন বন্ধে প্রশাসন কঠোর অবস্থানে আছে। খননকারীরা গভীর রাতে কাজ করেন। দিনে অভিযানে গেলে তাঁদের কাউকে পাওয়া যায় না। আর রাতে অভিযান চালালে নানা জটিলতা দেখা দেয়।