বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে নিঃশর্ত মুক্তির পাশাপাশি দ্রুত উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠনোর আহ্বান জানিয়েছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। রোববার বিকালে রাজধানীর নয়াপল্টনে এক সমাবেশে সরকারকে এই সময়সীমা বেঁধে দেন তিনি। খালেদা জিয়া অত্যন্ত অসুস্থ-এ কথা বলেই নেতাকর্মীদের সামনে কেঁদে ফেলেন বিএনপি মহাসচিব।
মির্জা ফখরুল বলেন, এত অসুস্থ যে এখন চিকিৎসকরা বলেছেন, বাংলাদেশে তার চিকিৎসা সম্ভব নয়। অবিলম্বে বিদেশে যদি তার উন্নত চিকিৎসা করা না হয়, তাহলে তাকে বাঁচানো দুষ্কর হয়ে যাবে। শনিবারও হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা বলেছেন, আপনাদের যদি কিছু করার থাকে তাহলে করেন, দেশনেত্রীর শারীরিক অবস্থা ভালো নয়। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে মুক্তি এবং উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠাতে হবে। অন্যথায় তার কিছু হলে সব দায়দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে।
সরকারের উদ্দেশে মির্জা ফখরুল বলেন, দেশনেত্রী খালেদা জিয়াকে অবিলম্বে মুক্তি দিয়ে তাকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে উন্নত হাসপাতালে প্রেরণ করুন। এ ক্ষেত্রে যদি কোনো ক্ষতি হয় তাতে নেত্রীর ক্ষতি হবে না, তার পরিবারের ক্ষতি হবে না, বাংলাদেশের বড় ক্ষতি হবে। শুধু বাংলাদেশ নয়, এই এশিয়া উপমহাদেশে যে কজন নেতানেত্রী গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করছেন, তাদের কয়েকজনের মধ্যে আমাদের নেত্রী আছেন। কয়েকদিন আগে বিএনপি অফিসে জার্মান চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স এসে বললেন, ‘তার স্বাস্থ্য নিয়ে তারা খুব উদ্বিগ্ন। আমরা তাকে অন্যভাবে দেখি।’ এই হচ্ছে পাশ্চাত্যের ধারণা। বিদেশে যেতে হলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করতে হবে-আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের এমন বক্তব্যের জবাবে বিএনপি মহাসচিব বলেন, এসব ছলচাতুরি করে কোনো লাভ নেই। পরিবার থেকে চিঠি দেওয়া হয়েছিল। সেই চিঠিতে তার মুক্তির কথা বলা হয়েছিল। একই সঙ্গে তাকে চিকিৎসার জন্য বাইরে যাওয়ার কথা বলা হয়েছিল। আপনারা এখন বেমালুম চেপে গিয়ে মিথ্যা কথা বলছেন। আপনাদের শুভবুদ্ধির উদয় হোক। গণতন্ত্রের মাতাকে মুক্তি দিয়ে এখন প্রমাণ করেন যে, আপনারা গণতন্ত্রের কিছুটা হলে বিশ্বাস করেন।
৭৮ বছর বয়সি খালেদা জিয়া লিভার সিরোসিস, ফুসফুস, হৃদরোগে ভুগছেন। ৯ আগস্ট অসুস্থ অবস্থায় তাকে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অধ্যাপক শাহাবুদ্দিন তালুকদারের নেতৃত্বে ১৯ সদস্যের একটি মেডিকেল বোর্ডের অধীনে তিনি চিকিৎসাধীন।
শনিবার এভারকেয়ার হাসপাতালে খালেদা জিয়াকে দেখতে গিয়েছিলেন বিএনপি মহাসচিব। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যে নেত্রী অত্যন্ত শক্ত মনের জোর নিয়ে সব প্রতিকূলতা কাটিয়ে ওঠেন, যিনি ৫ বছর বন্দি থাকা অবস্থায় কোনোদিনও তার চোখে আমরা পানি দেখিনি; শনিবার তাকে অত্যন্ত অসুস্থ দেখেছি। আমার প্রথমবারের মতো মনে হয়েছে, সত্যি আমাদের ম্যাডাম, আমাদের মাতা অনেক অনেক বেশি অসুস্থ। এ সময় নেতাকর্মীরা স্লোগান দিতে থাকেন-‘খালেদা জিয়ার কিছু হলে, জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে।’
শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, দেশের জনগণও সরকারকে স্যাংশন দিচ্ছে উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল বলেন, অবিলম্বে পদত্যাগ করুন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দিন।
এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে তিনি আরও বলেন, আজ গায়ের মধ্যে আগুন লেগেছে। বাইডেনের সঙ্গে সপরিবারে ছবি তুলে খুব দেখিয়েছিলেন। বলেছিলেন, আর আমেরিকা যাবেন না। অথচ আমেরিকায় থাকা অবস্থায় ভিসানীতি কার্যকর করা হলো। ভিসানীতি বাংলাদেশের মতো একটা স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের জন্য অপমানজনক। আওয়ামী লীগের জন্য তাও আমাদের দেখতে হলো।
নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে খালেদা জিয়ার মুক্তি ও উন্নত চিকিৎসায় বিদেশে পাঠানোর দাবিতে এ সমাবেশ হয়। অন্যদিনের তুলনায় এদিনের সমাবেশে অনেক নেতাকর্মীর অংশগ্রহণ দেখা গেছে। সাধারণত বিএনপির কর্মসূচিতে বিপুলসংখ্যক পুলিশ সদস্যের উপস্থিতি দেখা গেলেও এদিন তেমনটা দেখা যায়নি।
মহানগর নেতারা জানান, যুক্তরাষ্ট্র ভিসা বিধিনিষেধ আরোপ করার কারণে নেতাকর্মীদের মধ্যে একধরনের প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে এসেছে। এছাড়া দলীয় প্রধান খালেদা জিয়া নেতাকর্মীদের কাছে আবেগের জায়গা। তাকে নিয়ে এ সমাবেশ। সবকিছু মিলিয়ে বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মীর পাশাপাশি সাধারণ মানুষও এতে অংশ নেন।
দুপুর ১টা থেকেই মহানগরের বিভিন্ন এলাকা থেকে খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে বিএনপি ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা নয়াপল্টনে এসে জড়ো হতে থাকেন। বিকাল ৩টার আগেই নয়াপল্টনের সড়কসহ আশপাশের এলাকা জনসমুদ্রে পরিণত হয়।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, একই ধরনের মামলায় আওয়ামী লীগের নেতাদের খালাস দিয়ে দেওয়া হলো। কিন্তু খালেদা জিয়াকে জামিনও দেয়নি। এক দেশে দুই ধরনের আইন। এটা কেউ মেনে নেবে না।
যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা বিধিনিষেধ প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, এ নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা নেই। ১৮ সেপ্টেস্বর ধানমন্ডিতে অবসরপ্রাপ্ত আমলা, পুলিশসহ সরকারি কর্মকর্তারা সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত মিটিং করেছেন। তারা আলাপ করেছেন এই আওয়ামী লীগকে রক্তপাতের বিনিময়ে হলেও ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে হবে। এই মিটিং বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হয়েছে বিভিন্ন কুঞ্জে কুঞ্জে। তাদের উদ্দেশ্য বিএনপির আন্দোলন দমন করতে হবে। যারা গোপনে সভা করছেন, তাদের কাছে অনুরোধ, সভা প্রকাশ্যে করেন, গোপনে নয়। জনগণ জানতে চায় আপনারা কারা?
বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, দেশনেত্রী খালেদা জিয়াকে শেখ হাসিনা হিংসা করেন। কারণ, খালেদা জিয়া দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেত্রী। তার অপরাধ-তিনি কোনো অন্যায় করেননি, বিদেশে টাকা পাচার করেননি, গুম-খুন করেননি।
প্রধানমন্ত্রীর আত্মীয়স্বজনসহ ক্ষমতাসীন সরকারের লোকদের বিদেশে অর্থ পাচারের কারণে বাংলাদেশের কোষাগার খালি হয়ে গেছে বলে অভিযোগ করেন গয়েশ্বর। তিনি বলেন, এখন আমাদের আন্দোলন ‘ডু অর ডাই’। লড়াই লড়াই লড়াই চাই-এর মাঝে কোনো কিছু থাকবে না।
স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান বলেন, খালেদা জিয়াকে এই সরকার ভয় পায়। তার কী অপরাধ? তার অপরাধ দেশের মানুষ তাকে ভালোবাসে, তিনি গণতন্ত্রকে ভালোবাসেন এবং গণতন্ত্রের কথা বলেন। কী অপরাধ-তিনি যতবার নির্বাচন করেছেন, ততবারই নির্বাচিত হয়েছেন। এ অবস্থায় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে বিএনপিকে ধ্বংস করতে চায়। এ কারণে তারা মনে করছে, খালেদা জিয়াকে আটক করে রাখলে বিএনপিকে ধ্বংস করা যাবে। কিন্তু এটা সম্ভব নয়।
স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী সরকারের উদ্দেশে বলেন, খালেদা জিয়া কোনোভাবেই আপস করবেন না। তাই দায়িত্ব নিয়ে দেশের বাইরে তার চিকিৎসা করান। না করলে দেশের মানুষের মুখোমুখি হতে হবে। সময় থাকতে খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিন। সময় নষ্ট করবেন না। দেশের প্রতিটি মানুষ ঘণ্টা ও দিন গুনছে কখন খালেদা জিয়া চিকিৎসার জন্য বাইরে যাবেন।
সমাবেশে ছড়াকার আবু সালেহ তার লেখা ‘ধরা যাবে না, বলা যাবে না, ছোঁয়া যাবে না কথা, রক্ত দিয়ে পেলাম শালার আজব স্বাধীনতা’ আবৃত্তি করে শোনান। মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক আব্দুস সালামের সভাপতিত্বে এবং উত্তরের সদস্য সচিব আমিনুল হক ও দক্ষিণের ভারপ্রাপ্ত সদস্য সচিব লিটন মাহমুদের সঞ্চালনায় আরও বক্তব্য দেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন, শামসুজ্জামান দুদু, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ডা. ফরহাদ হালিম ডোনার, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, বিএনপি নেতা শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, কামরুজ্জামান রতন, মহিলা দলের আফরোজা আব্বাস, যুবদলের সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, স্বেচ্ছাসেবক দলের এসএম জিলানি, কৃষক দলের হাসান জাফির তুহিন, মুক্তিযোদ্ধা দলের সাদেক আহমেদ খান, শ্রমিক দলের মোস্তাফিজুল করীম মজুমদার, জাসাসের জাকির হোসেন রোকন, ছাত্রদলের রাশেদ ইকবাল খান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক লুৎফুর রহমান প্রমুখ। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা কাদের গণি চৌধুরী, অধ্যাপক মোর্শেদ হাসান খান প্রমুখ।
এদিকে সমাবেশ চলাকালে ছাত্রদলের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। পরে সিনিয়র নেতাদের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত হয়। এতে কয়েকজন আহত হন।
ধোলাইখাল ও আমিনবাজারে সমাবেশ আজ : সরকারের পদত্যাগসহ নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের একদফা দাবিতে ৫ অক্টোবর পর্যন্ত টানা কর্মসূচি পালন করবে বিএনপি। এর অংশ হিসাবে আজ দুপুর আড়াইটায় ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির উদ্যোগে ধোলাইখাল লিংক রোডে সমাবেশ হবে। এতে প্রধান অতিথি থাকবেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। একই সময়ে ঢাকা জেলা বিএনপির উদ্যোগে সমাবেশ হবে আমিনবাজার চিশতি ফিলিং স্টেশনসংলগ্ন মাঠে। এতে প্রধান অতিথি থাকবেন স্থায়ী কমিটি সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী।