১৯ নভেম্বর ২০২৪, মঙ্গলবার, ১০:১৪:৪১ পূর্বাহ্ন
বারোটা বাজার কাছাকাছি
  • আপডেট করা হয়েছে : ০২-১০-২০২৩
বারোটা বাজার কাছাকাছি

প্রকৃতির সঙ্গে বন্ধুত্ব তৈরি করার কাজটিও তো শুরু হয় ওই শৈশব থেকে। আর দেশপ্রেম? সেটা কি গাছে গাছে ফলে? টুপ করে পেড়ে নিয়ে খাওয়া যায়? দেশপ্রেমের জন্ম হয় সততার সঙ্গে নিজের কাজ করলে, দৃষ্টান্তমূলক কাজের সঙ্গে শিশুকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হলে।


টের পাচ্ছি, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ভবিষ্যৎ নাগরিকদের বারোটা বাজাবে। এগারোটা যে বেজে গেছে, তা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিশ্ব র‍্যাঙ্কিং থেকেই বোঝা যায়। জ্ঞান সৃষ্টির কোনো উদ্যোগ আপাতত খুব একটা চোখে পড়ছে না। খুব কমসংখ্যক শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ে পঠন-পাঠনকে গুরুত্বের সঙ্গে নেন।


বাকিরা শিক্ষকতা করেন, বিনিময়ে বেতন পান। বেতন পাওয়ার জন্য শিক্ষাদান-প্রক্রিয়া বুঝিয়ে দেয় যে জীবনযাপনের চাহিদা মেটানোর সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু এর পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষকের যে কাজ, সেই জ্ঞান সৃষ্টি ও গবেষণা কতটা এগিয়ে নেওয়া হয়, সেই প্রশ্নের যথাযথ উত্তর নেই।


সম্ভবত পরিশ্রম বাদ দিয়ে চ্যাট-জিপিটি ধরনের প্রযুক্তির সাহায্যে আমরা আমাদের পড়াশোনা করব ভবিষ্যতে। একটা সমস্যা দেওয়া হবে মোবাইলে থাকা প্রযুক্তি মহাশয়কে। তিনিই তাঁর তথ্যভান্ডার থেকে তৈরি করে দেবেন একটি সুলিখিত বক্তব্য। করে দেবেন সুখকর গবেষণা। ব্যস! কাজ শেষ।


শিক্ষকদের নিয়ে কথা হয়েছে বিস্তর। তাঁদের গবেষণার মান নিয়েও নিরাশাসূচক লেখালেখি দেখেছি অনেক। যে গবেষণা নতুন ভাবনার দ্বার খুলে দেবে, যে ভাবনা নিয়ে যোগাযোগমাধ্যমে, সমাজে-রাষ্ট্রে উঠবে আলোড়ন, সেই ভাবনার জন্ম কি হচ্ছে আমাদের শিক্ষালয়গুলোয়? আমাদের শিক্ষকেরা টক শোতে যতটা সক্রিয়, নিজ ক্লাসে ততটা আন্তরিক কি না, সে রকম প্রশ্নও তো ওঠে মাঝে মাঝে। শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ধরে রাখার মতো শিক্ষকের সংখ্যা তো কমে গেছে। একজন মানুষ কীভাবে একটি প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠতে পারেন, তার উদাহরণ আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই তো আছে। একটু ইতিহাস ঘেঁটে দেখলেই সে রকম শিক্ষকদের দেখা পাওয়া যাবে। সেই কাহিনিগুলো গর্বের। তাঁদের সমকক্ষ শিক্ষক হয়ে ওঠার তাগিদটাও আজকাল নেই।


কিন্তু কেন এমনটা ঘটছে, সে কথা খুব ভাবা হয়েছে বলে মনে হয় না। ভাবা হলেও তাকে কতটা গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, তারও জবাব পাওয়া যাবে না।


ভাবার কোনো কারণ নেই, শিক্ষকদের কথা বলার সময় সাংবাদিকদের দায়িত্বের কথা ভুলে যাচ্ছি। সংবাদপত্রের বড় কাজ হলো সত্য প্রকাশ করা। অনিয়মের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো। জনগণকে অনিয়মের ব্যাপারে অবহিত করা। আমাদের দেশের সংবাদপত্রগুলো তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব কতটা পালন করছে, সেটা দেশের জনগণ দেখতে পাচ্ছে। ফলে অবক্ষয়টা শুধু শিক্ষালয়ে সীমাবদ্ধ, এ রকম ভাবার কোনো কারণ নেই। সাংবাদিকদের ব্যাপারে খাম-সংস্কৃতির যে কথা শোনা যায়, তা নিয়ে লজ্জা পেতে পারি আমরা, কিন্তু সত্যিই এর প্রতিকার কি করতে পারি?


সংবাদ প্রকাশ করার জন্য অথবা প্রকাশ না করার জন্য শিকারের কাছ থেকে টাকা আদায়ের যে তথ্যগুলো ভেসে বেড়ায়, তা নিশ্চয়ই শুধু গুজব নয়। ঢাকার বাইরে থেকে সংবাদপত্রের একটি পরিচয়পত্র পাওয়ার জন্য যাঁরা তৎপর হন, তাঁদের মধ্যে এমন অনেকেই থাকেন, যাঁরা শুধু পরিচয়পত্র সম্বল করেই টিকে থাকতে পারেন। বেতন-ভাতার দরকার পড়ে না। কোন উপায়ে তাঁদের সংসার চলে, তা নিয়ে কি কোনো অনুসন্ধিৎসু সংবাদ তৈরি করা যায় না?


কাক কাকের মাংস খায় না বলে এই সংবাদগুলো সৃষ্টি হয় না। একশ্রেণির সাংবাদিকের এই লোভের কথা এখন সমাজে প্রতিষ্ঠিত, ফলে যারা তাঁদের দিয়ে নিজের স্বার্থ উদ্ধার করতে চায়, তারা সেটা পারে। তখন সত্যিকার তথ্য সংবাদমাধ্যমে আসে না। সত্য প্রকাশের জন্য অঙ্গীকারের তখন কোনো মানে থাকে না। শিক্ষকদের নিয়ে কথা বলব বলে সাংবাদিকদের এই চরিত্রহীনতার কথাও বলে নিলাম।প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে পড়ছে বললে যেন বোঝা যায়, এই সারিতে সাংবাদিকেরাও আছেন।


সর্বত্র এই অনৈতিক অবস্থানের একটা বড় কারণও কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থার দুর্বলতা। ছোট থেকে বড় হওয়ার শিক্ষাটাই হাওয়া হয়ে গেছে। তাঁরা যে শিক্ষা নিয়ে কর্মজীবনে প্রবেশ করেছেন, তার মধ্যকার ফাঁকি আর দুর্বলতা চোখে পড়ার মতো। সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে খোদ রাজধানীতে আখের গুছিয়ে নেওয়া সাংবাদিকের সংখ্যাও কি কম?


দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে পড়লে তার বিপজ্জনক ফল শুরুতে পাওয়া যায় না। পাওয়া যায় কিছুদিন পর। একটি প্রতিষ্ঠান ডোবে জাহাজের মতো। টাইটানিক জাহাজটি যেভাবে একটু একটু করে ডুবেছে, ঠিক তেমনি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় যে শিক্ষা নিয়ে মগজ পূর্ণ করে একজন শিক্ষার্থী, তার সঙ্গে কি আদৌ ভালো মানুষ হয়ে ওঠার বীজ লুকিয়ে আছে?


কথাগুলো বলতে হলো নিতান্তই কষ্ট থেকে। শিক্ষার বীজ বপন করা হয় পরিবারে, সেই বীজকে লালন ও প্রতিপালন করে শিক্ষালয়, আর চারদিকের পরিবেশ, পারিপার্শ্বিকতা সেই বীজকে গাছ হয়ে উঠতে সাহায্য করে। শুরুতেই পরিবার আর শিক্ষালয়ের ভূমিকা রয়েছে। এ সময় স্লেটের মতো পরিষ্কার থাকে শিশুর মগজ। সেই মগজে যা ঢোকানো হয়, সেটাই সে সারা জীবন লালন করে। আমরা কি সেই শিক্ষার সঙ্গে আমাদের সন্তানদের পরিচয় করাচ্ছি?


একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থীর জীবনের রুটিনে আর যা-ই থাকুক, মানবতার কোনো স্থান নেই। পরিবারের সাংস্কৃতিক আবহের মধ্যে প্রতিযোগিতাকেই মুখ্য করে তোলা হচ্ছে। অথচ যে দেশগুলো শিক্ষা নিয়ে গবেষণা করে, তারা শুরুতেই জোর দেয় শিশুর ওপর। শিশু যেন সামাজিক আচরণে নিজেকে দয়ালু, মানবিক করে তোলে, সে শিক্ষাই মূল শিক্ষা।


আমি ঢাকা শহরে থাকি। মোহাম্মদপুরের যে এলাকায় পাঁচটি ভালো স্কুল কাছাকাছি অবস্থান করছে, সেই এলাকা থেকেই কাজে বেরিয়ে পড়তে হয় আমাকে। সকালে স্কুলের সময় দুই মিনিটের পথ পাড়ি দিতে কখনো কখনো লাগে আধা ঘণ্টা, কখনো চল্লিশ মিনিট। গাড়িতে করে শিক্ষার্থীরা আসে, তাদের নামিয়ে দেওয়া হয় স্কুলের সামনে, তারপর কোনো গাড়ি চলে যায়, কোনোটা রাস্তার বাঁ পাশে দাঁড়িয়ে সংকুচিত করে দেয় রাস্তা।


অথচ পুরো পরিস্থিতি পাল্টে যেত যদি স্থানীয় শিক্ষার্থীদের দিয়ে স্কুলগুলো চালানো হতো। তাহলে বহুদূর থেকে গাড়িতে করে আসতে হতো না। আবার যদি স্কুলবাস বাধ্যতামূলক করে দেওয়া হতো, তাহলেও কিন্তু রাস্তায় এই অনাকাঙ্ক্ষিত জ্যামের সৃষ্টি হতো না। আমরা আমাদের শিশুদের সে রকমভাবে তৈরি করতে পারিনি। একেবারে ছোটবেলা থেকে গাড়িতে অভ্যস্ত করে তুলছি। যাদের গাড়ি নেই, তাদের সঙ্গে জীবনের শুরুতেই একটা দূরত্ব সৃষ্টি করে দিচ্ছি।


এ ব্যাপারটা আমাদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়। কোনো এক লেখায় পড়েছিলাম, জাপানে নির্দিষ্ট এলাকার স্কুলেই ভর্তি হতে হবে। অন্য এলাকায় ভালো স্কুল আছে, মা-বাবার পকেটে অনেক টাকা আছে, তাহলেই সে স্কুলে ভর্তি হওয়া যাবে না। ভর্তি হতে হবে নিজের এলাকার স্কুলে।শিখতে হবে দাঁত ব্রাশ করা, টয়লেট ব্যবহার করা, ব্যাগের বই গুছিয়ে নেওয়া, রান্না করা, মেহমান এলে তাঁর সঙ্গে সঠিক আচরণ করা। পরিচ্ছন্নতা শেখানো হবে। যেখানে-সেখানে কাগজপত্র ও থুতু ফেলা যাবে না।


আর শিক্ষক? শিক্ষককে তো হতে হবে শিক্ষার্থীর প্রকৃত বন্ধু। তিনি এমন মনকাড়াভাবে বিষয়বস্তুর সঙ্গে শিক্ষার্থীর পরিচয় ঘটাবেন, যেন এর চেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় আর কিছুই নেই! প্রকৃতির সঙ্গে বন্ধুত্ব তৈরি করার কাজটিও তো শুরু হয় ওই শৈশব থেকে। আর দেশপ্রেম? সেটা কি গাছে গাছে ফলে? টুপ করে পেড়ে নিয়ে খাওয়া যায়? দেশপ্রেমের জন্ম হয় সততার সঙ্গে নিজের কাজ করলে, দৃষ্টান্তমূলক কাজের সঙ্গে শিশুকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হলে।


কথাগুলো বলতে হলো বেহাল উচ্চশিক্ষার কথা বলতে গিয়েই। নানা ধরনের প্রলোভনের কাছে উচ্চশিক্ষা বিড়ম্বিত হচ্ছে। পড়াশোনার সঙ্গে পঠিত বিষয়টি আত্মস্থ করার কোনো সংযোগ নেই। সামনে ঝুলছে নম্বরের মুলো। সেটাই কাঙ্ক্ষিত শুধু।


তবে এ কথা বলার সময় একবারও ভুলি না, আমাদের শিক্ষায় বাজেটের বরাদ্দের কথা। শিক্ষার জন্য যে বাজেট, তার সঙ্গে তুলনা করুন অন্য অনেক অগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের। দেখতে পাবেন, সবচেয়ে প্রয়োজনীয় শিক্ষা খাতটি কতটা অবহেলিত। একই স্তরের একজন সরকারি আমলা, সামরিক অফিসার এবং একজন শিক্ষকের সুযোগ-সুবিধাগুলোর দিকে তাকালেই বোঝা যাবে, শিক্ষাকে মর্যাদা দেওয়ার কোনো চেষ্টা নেই।


যে শিক্ষক তাঁর সমপর্যায়ের অন্য চাকুরেদের থেকে সব দিক থেকে পিছিয়ে থাকেন, তাঁকে কেন সম্মান করবে মানুষ? যখন মান-মর্যাদার সঙ্গে অর্থের একটা ‘অর্থবোধক’ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, তখন অসৎ পথে আয় করা ধনী লোকটিকে শিক্ষকের তুলনায় অনেক বড় বলে মনে হতে পারে।


এই শিক্ষক তাই শিক্ষার্থীকে ‘মানুষ’ করার কথা ভাববেন না। তিনি শিক্ষার্থীর মনে জিজ্ঞাসার জন্ম দেবেন না। ক্লাসঘরটাকে পরিণত করবেন নীরস এক পাঠকক্ষে। নম্বরপ্রাপ্তির জন্য যন্ত্রের মতো ক্লাসে যাবেন আর আসবেন। শিক্ষার্থীরা এবং যৌক্তিকভাবে ভাবতে শিখবে না বলে সমাজের কোনো বিষয়ই তাদের আলোড়িত করবে না।


শুরুতেই বলেছিলাম, এগারোটা বেজে গেছে শিক্ষার। আসলে এই লেখা তৈরি হতে হতেই তা সাড়ে এগারোটায় পৌঁছে গেছে। এ কথা মনে রেখে আমরা বলতে পারি, কেন ব্যাংক থেকে হাজার কোটি টাকা লোপাট হলে কারও গায়ে লাগে না, কেন কেউ দুর্নীতির বিরুদ্ধে উচ্চ রব তোলে না, কেন রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তির মাধ্যমে সম্পদশালী হতে চায় মানুষ, কেন মানুষকে আর মানুষ বলে ভাবতে চায় না তথাকথিত শিক্ষিত মানুষ।


বারোটা বাজার সংকেত শোনার জন্য অপেক্ষা করার মতো ভয়াবহ আর কী হতে পারে?


শেয়ার করুন