১৯ নভেম্বর ২০২৪, মঙ্গলবার, ০৫:২৭:৫৭ অপরাহ্ন
সোনার ছোঁয়ায় সম্পদের পাহাড়
  • আপডেট করা হয়েছে : ০২-১১-২০২৩
সোনার ছোঁয়ায় সম্পদের পাহাড়

পেশায় তাঁরা স্বর্ণের কারবারি। কেউ দোকানি, কেউ স্বর্ণকার বা কর্মচারী, আবার কেউ জুয়েলারি সমিতির নেতা। পেশাগত কারণে আগে থেকেই পরিচিত এসব মানুষ এবার অন্য কারণে যূথবদ্ধ হয়েছেন, লক্ষ্য—জমি কেনা। এরই মধ্যে চট্টগ্রাম নগরীর কয়েকটি নামী এলাকায় অন্তত ১১টি দামি জায়গা কিনেছেন তাঁরা। সোনার ছোঁয়ায় কেনা এসব জমিতে তুলছেন সুউচ্চ অট্টালিকা।


খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চট্টগ্রাম শহরের প্রাণকেন্দ্র কোতোয়ালি এলাকাতেই গত পাঁচ বছরে কয়েক শ কোটি টাকার জায়গা কিনেছে স্বর্ণ দোকানিদের একটি দল। এসব ব্যবসায়ীর কয়েকজনের বিরুদ্ধে সোনা চোরাকারবারে জড়িত থাকার অভিযোগও আছে। কয়েকজনের নাম এসেছে দুই চোরাকারবারির আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে। এতে নড়েচড়ে বসেছে পুলিশ। এই অল্প সময়ে এত টাকার সম্পদ গড়া কীভাবে সম্ভব? এ প্রশ্ন খোদ পুলিশ কর্মকর্তাদেরও।


চট্টগ্রাম নগরীতে ভূমি বেচাকেনার সঙ্গে জড়িত কয়েকজন জানিয়েছেন, গত পাঁচ বছরে শুধু চট্টগ্রাম নগরের প্রাণকেন্দ্র কোতোয়ালি ও পাঁচলাইশ থানা এলাকায় কয়েক শ কোটি টাকার জায়গা কিনে নিয়েছে স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের একাধিক দল। অল্প সময়ের মধ্যে এসব জায়গা অধিক দাম দিয়ে কিনে নেওয়ার কারণে ওই এলাকাগুলোতে জমির দামও বেড়ে গেছে।


কোতোয়ালি ও পাঁচলাইশ ছাড়াও চট্টগ্রাম নগরীর রহমতগঞ্জ, দেওয়ান বাজার, জামালখান, জে এম সেন লেন, পাথরঘাটা, আসকারদিঘীর পাড় ও কাতালগঞ্জের মতো দামি এলাকায় সম্প্রতি ১১টি মূল্যবান জায়গা বেচাকেনা হয়েছে। আনুমানিক আড়াই শ কোটি টাকা মূল্যের এসব জায়গা কিনেছেন স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের একাধিক দল। চট্টগ্রামের শিল্প গ্রুপ স্মার্ট গ্রুপ, ইলিয়াস ব্রাদার্স, বনেদি ব্যবসায়ী শাহ মুরাদসহ বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে এসব জায়গা কেনা হয়।


সরেজমিন পরিদর্শন এবং স্থানীয় ব্যক্তিদের দেওয়া তথ্যমতে, ঘুরেফিরে ১৫০ থেকে ২০০ জন একাধিক জায়গার মালিক। মাস কয়েক আগেও এসব জায়গায় ৩০ থেকে তদূর্ধ্ব স্বর্ণ ব্যবসায়ীর নামসংবলিত সাইনবোর্ড টাঙানো ছিল। স্থানীয়দের মাঝে বেশি আলোচনা হওয়ায় দু-একটি বাদে সব কটি সাইনবোর্ড খুলে ফেলা হয়েছে।


নগরীর কাতালগঞ্জ আবাসিক এলাকায় ২১ কোটি টাকায় জায়গা কিনেছেন ৪২ জন। তাঁদের বেশির ভাগ স্বর্ণ দোকানি। জায়গাটির মালিকানায় বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি, চট্টগ্রাম-এর সাধারণ সম্পাদক প্রণব সাহাও রয়েছেন।


প্রিয়াংকা জুয়েলার্সসহ একাধিক দোকানের মালিক প্রণব সাহা আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা যৌথ উদ্যোগে এই জায়গা নিয়েছি। সবাই স্বর্ণ ব্যবসায়ী। ভিন্ন এক প্রশ্নে তিনি বলেন, স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা এখন একাধিক গ্রুপে বিভক্ত। ওই গ্রুপগুলোই মূলত বিভিন্ন এলাকায় জায়গা কিনছে।


নগরের রহমতগঞ্জে ইলিয়াস ব্রাদার্স পরিবার থেকে কেনা ৩৭ কোটি টাকা মূল্যের একটি জায়গার ওপর এরই মধ্যে ১৫ তলা ভবন উঠে গেছে। ভবনটির নিরাপত্তা তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে থাকা একজন বলেছেন, এই ভবনের মালিক সুধীর বাবুসহ (সুধীর রঞ্জন চৌধুরী) মোট ৮০ জন। তাঁরা পেশায় স্বর্ণ ব্যবসায়ী। সুধীর রঞ্জন চট্টগ্রাম নগরের হাজারী লেনে অবস্থিত চৌধুরী জুয়েলার্সের মালিক। তিনি বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির সদস্যও।


জানতে চাইলে সুধীর রঞ্জন চৌধুরী আজকের পত্রিকাকে বলেন, তিনি শেয়ারের (অংশীদারত্ব) মাধ্যমে জায়গাটি কিনেছেন। যাঁরা জায়গাটির শেয়ারে আছেন, তাঁদের বেশির ভাগ স্বর্ণ দোকানি।


সুধীর বাবুদের ভবন থেকে প্রায় ২০০ গজ দূরে রহমতগঞ্জে আসর কমিউনিটি সেন্টার-সংলগ্ন একটি জায়গায় ১৮ তলা ভবন নির্মাণের কাজ চলছে। ভবনের ভিত তোলার কাজ সেখানে শেষ পর্যায়ে রয়েছে। ওখানকার তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে থাকা মুন্না ধর আজকের পত্রিকাকে বলেন, ভবনটির মালিক ৭০ জন। মালিকানায় স্বর্ণ দোকানি ছাড়াও ব্যাংকার ও অন্যান্য ব্যবসায়ী রয়েছেন। নারায়ণ নামের এক মালিক এটা দেখাশোনা করেন। তিনি পেশায় স্বর্ণ ব্যবসায়ী। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নারায়ণ কর্মকার নামের ওই ব্যক্তি হাজারী লেনে এন কে জুয়েলারি ওয়ার্কশপ নামের একটি স্বর্ণ মেরামত কারখানার মালিক।


চট্টগ্রাম নগরের দেওয়ান বাজারে মূল সড়কের পাশে একটি মূল্যবান জায়গা কিনেছে স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের গ্রুপটি। জায়গাটি এখনো খালি পড়ে আছে। তাঁর চারপাশে বাউন্ডারি দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে।


খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জায়গাটির মালিকানায় আছেন ৩২ জন। মালিকদের একজন সুজন কুমার ধর আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমি জায়গাটি শেয়ারে আছি।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘জুয়েলার্স সমিতির সাধারণ সম্পাদকসহ আরও অনেকের এই জায়গায় শেয়ার রয়েছে। আমি তো চুনোপুঁটি। ওনাদের সাথে কথা বলেন।’ জানা যায়, সুজন কুমার ধরের চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলায় এ ডি জুয়েলার্স নামের একটি স্বর্ণের দোকান রয়েছে।


দেওয়ান বাজারে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর-সংলগ্ন আরেক জায়গায় ১৫ তলা ভবন উঠে গেছে। ওখানকার নিরাপত্তায় দায়িত্বে থাকা একজন বলেছেন, ভবনটির মালিক ৮০ জন। তাঁরা বেশির ভাগই স্বর্ণ ব্যবসায়ী। এ ছাড়া জামালখানে দুটি জায়গার মধ্যে একটিতে ১০ তলা ভবন ও পাথরঘাটা এলাকায় ২০ তলার ভবনের কাজ নির্মাণাধীন রয়েছে। পাথরঘাটায় ৪৩ কোটি টাকা দিয়ে জায়গাটি বিক্রি করেছিলেন স্মার্ট গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুজিবুর রহমান। তিনি স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের কাছে জায়গা বিক্রি করে দেওয়ার বিষয়টি আজকের পত্রিকাকে নিশ্চিত করেছেন। 


চোরাচালানে অভিযুক্তরাও গড়ছেন সম্পদের পাহাড় চট্টগ্রামের কর্ণফুলী থানা এলাকায় একটি বাংলো বাড়ি আছে কৃষ্ণ কর্মকার নামের এক স্বর্ণ ব্যবসায়ীর। এই বাড়ি মেজর সিনহা হত্যাকাণ্ডে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশের ছিল। এ ছাড়া জামালখান, দেওয়ান বাজারে আর কে আবাসন, জে এম সেন লেন, রহমতগঞ্জের একাধিক জায়গায় তাঁর মালিকানার বিষয় নিশ্চিত হওয়া গেছে। তাঁর সঙ্গে আরেক স্বর্ণ ব্যবসায়ী বিধান ধরও পার্টনার হিসেবে রয়েছেন। এই দুজনের বিরুদ্ধে স্বর্ণ চোরাচালানে যুক্ত থাকার অভিযোগ আছে। গত ১৬ জুন কর্ণফুলী থানা-পুলিশ যাত্রীবাহী বাস থেকে সাড়ে ৯ কেজি স্বর্ণের চালান জব্দ করে। এ সময় দুই নারীসহ চারজনকে আটক করে মামলা দেওয়া হয়।


মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) রবিউল ইসলাম আজকের পত্রিকাকে বলেন, দুই আসামি স্বীকারোক্তিতে এসব স্বর্ণের চালান হাজারী গলি ও নিউমার্কেটের স্বর্ণ ব্যবসায়ী কৃষ্ণ কর্মকার ও বিধান ধরের কাছে নেওয়ার কথা উল্লেখ করেন।


শেয়ার করুন