১৯ নভেম্বর ২০২৪, মঙ্গলবার, ০৭:২১:৫৮ অপরাহ্ন
সেমিকন্ডাক্টরে ট্রিলিয়ন ডলারের হাতছানি
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৭-০১-২০২৪
সেমিকন্ডাক্টরে ট্রিলিয়ন ডলারের হাতছানি

বাংলাদেশে ইলেকট্রনিকস শিল্পে সেমিকন্ডাক্টর খাতে বিপুল আয়ের বিরাট সম্ভাবনা রয়েছে। বিশাল এই বাজারের কিয়দংশ ধরতে পারলে দেশের পোশাক রপ্তানি আয়কেও ছাড়িয়ে যাবে সেমিকন্ডাক্টর খাত।


এই সুযোগকে কাজে লাগাতে বড় ধরনের বিনিয়োগের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, বিশ্বে সেমিকন্ডাক্টরের ৫৫০ বিলিয়ন ডলারের বাজার রয়েছে, যা ২০২৯ সালের মধ্যে এক ট্রিলিয়ন ডলার (১০০ বিলিয়ন ডলার বা ১১ লাখ কোটি টাকা) ছাড়িয়ে যাবে।


 


ডিজিটাল জগতে সব ডিভাইসের প্রাণ সেমিকন্ডাক্টর বা চিপ। স্মার্টফোন থেকে কম্পিউটার, গাড়ি, ওয়াশিং মেশিনসহ সব ধরনের যন্ত্রই চিপনির্ভর। চিপ উৎপাদনে বৈশ্বিক পর্যায়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও কম্পানি বিনিয়োগ বাড়িয়ে যাচ্ছে।


খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বর্তমানে সারা বিশ্বের ইলেকট্রনিকস ও প্রযুক্তি খাতে সেমিকন্ডাক্টর বা মাইক্রোচিপ ম্যানুফ্যাকচারিং খাত দ্রুত ক্রমবর্ধমান শিল্প হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে।


 


এশিয়ার অনেক দেশ এই বাজার ধরতে বিপুল অঙ্কের বিনিয়োগ করছে। ভারত, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া সেমিকন্ডাক্টর খাত থেকে বিপুল অঙ্কের আয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে, সেখানে দেশে সেমিকন্ডাক্টর ডিজাইন থেকে আয় মাত্র ১০০ মিলিয়ন ডলার। এই আয় ৫০০ মিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে। তবে তা কয়েক বিলিয়ন ডলার করার সুযোগ রয়েছে।


 


এ জন্য বেসরকারি খাতের উদ্যোগের পাশাপাশি সরকারের নীতি সহায়তা প্রয়োজন বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।


 


নেতৃত্ব দিচ্ছে যারা


গত শতকের আশির দশকে সেমিকন্ডাক্টর শিল্পে টেক জায়ান্ট জাপানের বড় ধরনের উত্থান হলেও এ শিল্পে তারা স্থান ধরে রাখতে পারেনি। বর্তমানে সারা বিশ্বে দুই ন্যানোমিটার ক্ষুদ্র আকারের উচ্চ প্রযুক্তির চিপ ডিজাইন ও তৈরির শীর্ষে রয়েছে তাইওয়ান। তাইওয়ানের টিএসএমসি কম্পানি সিলিকন চিপ বা সেমিকন্ডাক্টর ব্যবসার ৬৬ শতাংশ একাই নিয়ন্ত্রণ করে। ৯২ শতাংশ অ্যাডভান্স চিপ এই তাইওয়ানে তৈরি হয়।


 


করোনার সময় এই কম্পানির উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় টেলিকমিউনিকেশন থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য খাত পর্যন্ত সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। টয়োটা, অ্যাপল, ফোর্ট, টেসলার মতো নামিদামি কম্পানির উৎপাদন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বর্তমানে চিপ এখন ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।


 


বর্তমানে বিশ্বের দুই জায়ান্ট যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে বাণিজ্যযুদ্ধ চলছে তার মূল্যে রয়েছে ফাইভজি ও সেমিকন্ডাক্টর শিল্পের বাজার দখলের প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতায় আমেরিকা ও চীন যে যার মতো করেই এগিয়ে যাচ্ছে।


উচ্চ প্রযুক্তিনির্ভর সেমিকন্ডাক্টর ম্যানুফ্যাকচারিং কম্পানি হিসেবে মার্কিন টেক জায়ান্ট ইন্টেল বিগত দুই দশকের বেশি একক শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রেখেছে। তবে ইন্টেলের পাশাপাশি দক্ষিণ কোরিয়ার টেক জায়ান্ট স্যামসাং, জাপানের মিত্সুবিশি কম্পানি এবং চীনের বেশ কিছু প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানও মাইক্রো ও ন্যানো চিপ ডিজাইন ও ম্যানুফ্যাকচারিংয়ে এগিয়েছে। পাশাপাশি ভারতে বেশ কিছু সেমিকন্ডাক্টর বা চিপ ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্ডাস্ট্রি গড়ে উঠলেও ভারত তার মোট সেমিকন্ডাক্টর চাহিদার ৭০ শতাংশ পর্যন্ত আমদানি করে থাকে। তবে চিপ আমদানি নির্ভরশীল কমাতে এই খাতে ভারত বড় আকারের বিনিয়োগ শুরু করেছে।


ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস, সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের (সিএসআইএস) শল চেয়ার উইলিয়াম এ রাইনশ বলেন, বর্তমানে মার্কিন কম্পানিগুলো তাদের সরবরাহ চেইন থেকে চীনা পণ্য সরিয়ে ফেলতে চাইছে। এ পরিস্থিতি থেকে এশীয় দেশগুলোর লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।


তার বিকল্প হিসেবে এই কম্পানিগুলো ভিন্ন উৎস খুঁজবে। এ ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়া একটি চমত্কার উৎস হতে পারে, তবে এই অঞ্চলের কোন দেশ এই সুযোগ কতটা কাজে লাগাতে পারবে, তা দেশগুলোর সক্ষমতার ওপর নির্ভর করবে।


 


সেমিকন্ডাক্টরে বাংলাদেশের যাত্রা


উল্কাসেমির প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এনায়েতুর রহমানকে দেশে এই শিল্প প্রতিষ্ঠার একজন অগ্রদূত বলা যায়। তিনি এমন একটি বাজার ধরার উদ্যোগ নেন, যা তার কম্পানিটি শুরুর দেড় দশকের মধ্যেই ৬০ হাজার কোটি ডলারে রূপ নিয়েছে।


বাংলাদেশে এ পর্যন্ত একটি বাজার তৈরিতে উল্কাসেমি, নিউরাল সেমিকন্ডাক্টর, প্রাইম সিলিকন ও টোটোন ইলেকট্রনিকসের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো দেশের সেমিকন্ডাক্টর শিল্প এগিয়ে নিচ্ছে। দেশের দুটি বড় কম্পানি ওয়ালটন ও এসিআই এই শিল্পে প্রবেশের উদ্যোগ নিচ্ছে। ওয়ালটন এরই মধ্যে কালিয়াকৈরে বঙ্গবন্ধু হাই-টেক সিটিতে জায়গা করে নিয়েছে।


ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য-প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেন, ‘বাংলাদেশ সেমিকন্ডাক্টর যুগে প্রবেশ করেছে। দেশেই মাইক্রোচিপ থেকে ন্যানো চিপ ইকো সিস্টেম তৈরি হচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবটিকস, মাইক্রোচিপের নকশা এবং সাইবার নিরাপত্তা প্রযুক্তিতে আমরা আমাদের সক্ষমতা উন্নয়নের মাধ্যমে রিসোর্স ট্যালেন্টপুল তৈরি করছি। ফলে আগামী ১০ বছরে ভালোভাবেই বৈশ্বিক সমস্যা সমাধানে অংশ নিতে পারব।’


প্রতিমন্ত্রী বলেন, দেশের মেধাবী প্রকৌশলীরা তাঁদের কাজের মাধ্যমে দেশে উৎপাদিত ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ চিপ রপ্তানি করে ২০৩১ সালের মধ্যে আয় করবেন ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ দেশের মেধাবী তরুণরা মেধা ও সৃজনশীলতায় কারো চেয়ে পিছিয়ে নেই, তার অন্যতম উদাহরণ উল্কাসেমি।


 


বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন


উল্কাসেমির প্রতিষ্ঠাতা, সিইও মোহাম্মদ এনায়েতুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, বৈশ্বিক সেমিকন্ডাক্টর শিল্প প্রায় ৬০০ বিলিয়ন ডলারের। বিপুল সম্ভাবনার এ বাজারে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ একেবারেই সামান্য। সরকারের যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতা পেলে বাংলাদেশ হয়ে উঠতে পারে এ শিল্পের অন্যতম বড় প্রতিযোগী। এ শিল্পে আমাদের অংশগ্রহণ একেবারেই সীমিত, আমরা শুধু আইসি চিপের ডিজাইন তৈরি করি। কিন্তু আমরা যদি সেমিকন্ডাক্টর ইকোসিস্টেমে প্রবেশ করতে পারি, যার মধ্যে রয়েছে সিলিকন ওয়েফার উৎপাদন, আইসি চিপ বানানো, আইসি চিপ প্যাকেজিং, সংযোজন ও পরীক্ষাকরণ এবং পণ্যগুলোর মধ্যে একীভূতকরণ। তাহলে সেমিকন্ডাক্টর শিল্প থেকে বাংলাদেশের যে রাজস্ব আসবে, তা হবে তৈরি পোশাক শিল্প থেকে বর্তমান আয়ের সমান।


এই উদ্যোক্তা বলেন, সেমিকন্ডাক্টর শিল্পও যদি সরকারের বিশেষ মনোযোগ পায় এবং এ খাতে নীতি সহায়তা দেওয়া হয়, তবে এ খাত খুব দ্রুত সরকারের লক্ষ্যকে অতিক্রম করে যাবে। সরকারের লক্ষ্য আগামী ২০৩১ সালের মধ্যে সেমিকন্ডাক্টর শিল্পকে ১০ বিলিয়ন ডলারের শিল্পে পরিণত করা।


বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির সভাপতি সুব্রত সরকার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সেমিকন্ডাক্টর শিল্পে বিশাল কর্মযজ্ঞ রয়েছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে ডিজাইনিং। আমাদের দেশের তরুণ প্রকৌশলীরা সেমিকন্ডাক্টর ডিজাইন করতে পারবে। কিন্তু এখানে যদি ফ্যাব্রিকেশন করতে হয়, তাহলে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ লাগবে। এখানে বেসরকারি উদ্যোগ থাকতে হবে, যেখানে সরকার সহায়তা করতে হবে।’


তিনি বলেন, ‘ইন্টেল, এএমডির মতো বিশ্বের বড় বড় কম্পানির যারা সেমিকন্ডাক্টর ফ্যাব্রিকেশন ও সেমিকন্ডাক্টর ম্যাটারিয়াল নিয়ে কাজ করছে, তাদের এখানে ফ্যাসিলিটেট করতে হবে। আমাদের প্রতিবেশী দেশে এই শিল্পকে প্রণোদনা দিতে এক হাজার কোটি ডলারের প্রকল্প নিয়েছে সরকার। আমরা ফ্যাব্রিকেশন যদি নাও করতে পারি, শুধু যদি ডিজাইনটাও করি তাহলেও বিপুল অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব। যদি ভিয়েতনামে হতে পারে তাহলে বাংলাদেশেও সেমিকন্ডাক্টরের ফ্যাব্রিকেশন ইন্ডাস্ট্রি গড়া সম্ভব। আমাদের যেসব তরুণ চিপ ডিজাইন করছে আমরা তাদের ধরে রাখতে পারিছ না।’


শেয়ার করুন