বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি ও কক্সবাজারের উখিয়ার পর টেকনাফের সঙ্গে লাগোয়া মিয়ানমারের সীমান্তে এবার সংঘাত ছড়িয়েছে। মিয়ানমারের জান্তা বাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সংঘাতের জেরে গতকাল বুধবার টেকনাফের হোয়াইক্যং সীমান্ত দিয়ে বিজিপির আরও ৬৫ সদস্য এসেছেন। এ নিয়ে ৩২৯ জন বাংলাদেশে আশ্রয় নিলেন। গতকাল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তাঁদের ফেরত পাঠাতে মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। সমুদ্রপথে ফেরত পাঠানো হবে তাঁদের।
এদিকে মিয়ানমারের রাখাইন থেকে সংঘর্ষ শিন রাজ্যেও ছড়িয়েছে। সেখানে জান্তা সরকারের বাহিনীর একটি হেলিকপ্টার ভূপাতিত করেছে বিদ্রোহী আরাকান আর্মি (এএ)। মিয়ানমারের রাখাইনে এই সংঘাতময় পরিস্থিতিতে নিজ নাগরিকদের ফেরার আহ্বান জানিয়েছে ভারত। এ ছাড়া দেশটির সঙ্গে সীমান্তে বেড়া দেওয়ার ঘোষণাও দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার।
এক সপ্তাহ ধরে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি, তমব্রু, ঘুমধুম, উখিয়ার পালংখালী, থাইংখালী, রহমতেরবিল সীমান্তে গোলাগুলি এবং মর্টার শেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে। গতকাল থেকে টেকনাফ সীমান্ত এলাকায় গোলাগুলি শুরু হয়। এতে ওই এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। সেখানকার হোয়াইক্যং মডেল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুর আহমদ আনোয়ারী বলেন, গোলাগুলি শব্দে বাসিন্দারা সীমান্ত এলাকার ঘরবাড়ি ছেড়ে ওপরের দিকে চলে আসে। এর কিছুক্ষণ পর উলুবনিয়া সীমান্ত দিয়ে বিজিপির ৬৫ জন বাংলাদেশে ঢোকেন। বিজিবি তাঁদের নিরস্ত্র করে নিরাপদ আশ্রয় নিয়ে যায়। বিজিবির সদর দপ্তর জানিয়েছে, এ নিয়ে বিজিপির ৩২৯ জন সদস্য বাংলাদেশে ঢুকেছে।
সীমান্ত পরিদর্শনে বিজিবির প্রধান
এদিকে গতকাল নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার তমব্রু ও ঘুমধুম সীমান্ত পরিদর্শন করেছেন বিজিবির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী। সেখানে সীমান্তে দায়িত্বরত বিজিবি সদস্যদের খোঁজখবর নেন এবং তাঁদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। এরপর ঘুমধুম উচ্চবিদ্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, বিজিপির সদস্যদের ফেরত দেওয়ার জন্য দুই দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মধ্যে পত্রালাপ চলছে। মানবিক কারণে তাঁদের আশ্রয় দেওয়া হয়েছিল, যত দ্রুত সম্ভব তাঁদের ফেরত পাঠানো হবে।
সেন্ট মার্টিনে ভ্রমণের বিষয়ে আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী বলেন, ‘আমরা কোস্ট গার্ডের সঙ্গে কথা বলেছি। এই পরিস্থিতিতে প্রয়োজন ছাড়া সেন্ট মার্টিনে পর্যটকদের না যাওয়ার জন্য নিরুৎসাহিত করব। নৌযান চলাচলেও নিষেধ করা হয়েছে। আর কয়েকটি দিন গেলে আমরা বলতে পারব, আসলে কী ঘটছে।’
সীমান্তে এখনো আতঙ্ক
এদিকে গোলাগুলি কমে আসার পর সীমান্তে অল্প কয়েকটি পরিবার বাড়ি ফিরেছে। তবে আতঙ্ক এখনো আছে। উখিয়ার দক্ষিণ রহমতবিলের বাসিন্দা পারভিন আক্তার বলেন, ‘গোলাগুলি শুরুর পর, বালুখালী ভাইয়ের বাসায় গিয়েছিলাম। সেখানেই ছিলাম। এখনো কাপড়চোপড় গুছিয়ে রেখেছি। কোনো ঝামেলা হলে আবার চলে যাব।’
এদিকে ঘুমধুম, তমব্রুসহ নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের আতঙ্কগ্রস্ত ১৩ গ্রামের হাজারো মানুষ এখনো বাড়িছাড়া। মঙ্গলবার দুটি আশ্রয়কেন্দ্রে তমব্রু, ঘুমধুম ও নাইক্ষ্যংছড়ির ২৭ পরিবারের ১৩০ জন বাসিন্দা আশ্রয় নিয়েছিলেন। গতকাল বিকেলে সেখানে গিয়ে জানা যায়, তাঁরা চলে গেছেন। তবে ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান এ কে এম জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন, ঘুমধুম সীমান্তে রবি ও সোমবারের রকেট লঞ্চার-মর্টারশেলের আঘাতে হতাহতের ঘটনা ঘটে। এরপর ঘুমধুম, তমব্রুসহ সীমান্তের লোকজন ভয়ে-আতঙ্কে বাড়ি ছেড়ে যায়। কিছু মানুষ নিজেদের সম্পদ রক্ষায় বাড়ি ফিরে গেছেন।
তমব্রু পশ্চিমকুলে বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন বলেন, তিনি ভয়ে ভয়ে বাড়ি পাহারা দিচ্ছেন। তাঁর গ্রামে অন্তত ২ হাজার মানুষের বসবাস। তাদের মধ্যে কয়েকজন বাড়ি ফিরেছে। বাকিরা আতঙ্কের কারণে আসছে না।
বিজিপির সদস্যরা ফেরত যাচ্ছেন
এদিকে মিয়ানমারের রাখাইনে সংঘর্ষের সময় বিজিপির যেসব সদস্য পালিয়ে বাংলাদেশে এসেছেন, তাঁদের সমুদ্রপথে ফেরত পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে।
সীমান্ত নিরাপত্তা বিষয়ে গতকাল বুধবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এক আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠকের পর পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন সাংবাদিকদের এ সিদ্ধান্তের কথা জানান।
পররাষ্ট্রসচিব বলেন, মিয়ানমার বাহিনীর সদস্যদের কীভাবে ফিরিয়ে দেওয়া যায়, সেটি হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সবচেয়ে ভালো হতো যদি তাঁদের আকাশপথে ফেরত পাঠানো যেত। তবে মিয়ানমার তাঁদের সমুদ্রপথে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি ভাবছে।
গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ৩২৯ জন অনুপ্রবেশ করেছেন, এমন তথ্য দিয়ে পররাষ্ট্রসচিব বলেন, আরও শ খানেক আসতে পারেন। তাঁদের সবাইকে নিরাপদে ও দ্রুততম সময়ে পাঠানোটাই সরকারের অগ্রাধিকার।
শিনে হেলিকপ্টার ভূপাতিত
এদিকে মিয়ানমারের সংবাদমাধ্যম দ্য ইরাবতীর অনলাইন সংস্করণে গতকাল এক খবরে বলা হয়, আরাকান আর্মির সদস্যরা শিন রাজ্যের পালেতোয়া টাউনশিপে জান্তা বাহিনীর একটি হেলিকপ্টার ভূপাতিত করার তথ্য নিশ্চিত করেছে। এই এলাকাও বাংলাদেশের সঙ্গে লাগোয়া। সেখানে গত বছর থেকে জান্তা বাহিনীর সঙ্গে লড়াই করছে আরাকান আর্মি।
নাগরিকদের সতর্ক করল ভারত
এদিকে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গত মঙ্গলবার বলেছে, যেসব ভারতীয় এখনো রাখাইনে রয়েছেন, তাঁদের শিগগির ওই এলাকা ছাড়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে আপাতত রাখাইন ভ্রমণ না করার পরামর্শও দিয়েছে মন্ত্রণালয়।
এ প্রসঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধির জয়সোয়াল বলেন, ‘মিয়ানমারের পরিস্থিতি খারাপ হওয়ায় আমরা উদ্বিগ্ন। এর প্রভাব সরাসরি আমাদের ওপর পড়ছে।’
এদিকে ভারতের সংবাদমাধ্যম দ্য হিন্দুর খবরে বলা হয়েছে, মিয়ানমার সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ মঙ্গলবার এক্সে (সাবেক টুইটার) এক বার্তায় জানিয়েছেন, ভারত-মিয়ানমারের ১ হাজার ৬৪৩ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্তের পুরো অংশে এই বেড়া নির্মাণ করা হবে।
টুইটে অমিত শাহ বলেন, ‘মোদি সরকার দুর্ভেদ্য সীমান্ত নির্মাণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সরকার পুরো ১ হাজার ৬৪৩ কিলোমিটার ভারত-মিয়ানমার সীমান্তে বেড়া নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আরও ভালো নজরদারির সুবিধার্থে সীমান্তে একটি টহল ট্র্যাক তৈরি করা হবে।’
ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী টুইটে আরও বলেছেন, ‘মোট সীমান্ত দৈর্ঘ্যের মধ্যে মণিপুরের মোরেতে ১০ কিলোমিটার সীমান্তে এরই মধ্যে বেড়া দেওয়া হয়েছে। হাইব্রিড সার্ভেইল্যান্স সিস্টেম (এইচএসএস) ব্যবহার করে বেড়া তৈরির দুটি পাইলট প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন।’