ফুটপাতে চাঁদাবাজি করতেন (লাইনম্যান) বাবা। এখন ছেলে। এমনকি চাঁদাবাজের তালিকায় আছে জামাই-শ্বশুরের নামও। আবার কয়েকটি এলাকার লাইনম্যানরা চাঁদা তোলেন কয়েক ভাই মিলে। ফুটপাত চাঁদাবাজিতে এভাবে সপরিবারে নাম লিখিয়েছেন অনেকে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, চাঁদা তুলতে পেশাদার লাইনম্যানরা নিয়োগ দিয়েছেন একাধিক বেতনভুক্ত কর্মচারী।
হকার্স সংগঠনগুলো বলছে, রাজধানীতে প্রায় দুলাখ হকারের ওপর চাঁদাবাজি করেন অন্তত দুশতাধিক লাইনম্যান। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের কিছু নেতা এদের প্রধান শক্তি। যারা গডফাদার হিসাবে পরিচিত। এছাড়া চাঁদার টাকা যায় পুলিশ, মস্তান এবং এলাকাভিত্তিক কিশোর গ্যাংয়ের হাতে। রাজধানীর ফুটপাত চাঁদাবাজির এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে আসে যুগান্তরের সরেজমিন অনুসন্ধানে।
মতিঝিল : আইডিয়াল স্কুলের সামনে থেকে আরামবাগ পীরজঙ্গী মাজার পর্যন্ত বিস্তীর্ণ ফুটপাতে প্রতিদিন বিকালে রীতিমতো হাট বসে। মাছ, মাংস, তৈরি পোশাক থেকে শুরু করে গৃহস্থালির দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় সবকিছু মেলে এখানকার ফুটপাতে। প্রতিদিন এখানে অন্তত ৫শ হকার পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেন। তবে শুক্রবার হকার সংখ্যা দেড়-দুহাজার ছাড়িয়ে যায়। হকারপ্রতি চাঁদার অংক ৩শ থেকে ৫শ টাকা।
হকার নেতারা বলছেন, সাইফুল মোল্লা নামের স্থানীয় এক প্রভাবশালী আইডিয়ালের ফুটপাত নিয়ন্ত্রণ করেন। তার গ্রামের বাড়ি জামালপুরের সরিষাবাড়ী থানার বগারপাড়া। আগে তিনি বাসস’র (বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা) সামনের সড়ক থেকে চাঁদা তুলতেন। কিন্তু ভাগবাটোয়ারা নিয়ে বিরোধের জেরে পল্টন ছেড়ে মতিঝিল চলে যান।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন হকার যুগান্তরকে বলেন, দীর্ঘ ২০ বছরের বেশি সময় ধরে ফুটপাতে চাঁদাবাজি করেন সাইফুল। চাঁদার টাকায় বর্তমানে তিনি কোটিপতি। সম্প্রতি জুরাইন এলাকায় কয়েক কোটি টাকায় জমি কিনেছেন। চাঁদা তোলার জন্য সাইফুলের নিজস্ব কর্মচারী আছে। তবে মাঝে মাঝে সাইফুল নিজেও মাঠে নামেন। এ সময় তার মাথায় থাকে লম্বা পাগড়ি।
স্থানীয়রা জানান, সাইফুল আগে পুলিশের সোর্স (ফরমা) ছিলেন। এক সময় বিএনপি করতেন। তবে এখন সাইফুল নিজেকে আওয়ামী লীগ নেতা বলে পরিচয় দেন। ঢাকা দক্ষিণ সিটির ১০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মারুফ আহমেদ মুনসুরের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা ওপেন সিক্রেট। এছাড়া সাইফুলকে শেল্টার দেন সরকারি দলের স্থানীয় কিছু অসাধু নেতা। অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ওয়ার্ড কাউন্সিলর মারুফ আহমেদ মুনসুর বুধবার যুগান্তরকে বলেন, তিনি কোনোদিনই সাইফুল মোল্লাকে শেল্টার দেননি। কমিশনার কার্যালয়ে তার ঢোকা নিষিদ্ধ। তবে সাইফুল মোল্লার পেছনে অন্য অনেকের হাত রয়েছে বলে দাবি করেন তিনি। এ বিষয়ে বক্তব্য জানার জন্য সাইফুল মোল্লার মোবাইলে একাধিবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের উত্তর পাশের বিশাল ফুটপাতে চাঁদা তোলেন স্থানীয় লাইনম্যান হারুন ওরফে হেরোঞ্চি হারুন। তিনি সাবেক কাউন্সিলর মমিনুল হক সাইদের লোক হিসাবে পরিচিত। এছাড়া সোনালী ব্যাংকের সামনের সড়ক নিয়ন্ত্রণ রয়েছে জাতীয় শ্রমিক লীগের মতিঝিল থানা কমিটির কিছু নেতার হাতে। তাদের পক্ষ থেকে লাইনম্যানের কাজ করেন মকবুল নামের স্থানীয় এক চাঁদাবাজ।
মতিঝিল রূপালী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের সামনের ফুটপাতে বেদখল হয়েছে অনেক আগে। সেখানে এখন নিয়মিত মাছ, মাংস ও তরিতরকারির দোকান বসে। দীর্ঘদিন ধরে এখানে চাঁদাবাজি করেন স্থানীয় বিএনপি নেতা তাজুল ইসলাম তাজ ও তার ছেলে বাবলু। ছিন্নমূল হকার সমিতি নামের অবৈধ সংগঠনের ব্যানারে চাঁদাবাজি করেন তারা। এছাড়া নেপথ্যের কারিগর কামাল সিদ্দিকী নামের জনৈক হকার নেতা।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং জীবন বীমার মাঝের সড়কে চাঁদাবাজি করেন লাইনম্যান আজাদ। পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী নাসির ওরফে ফেন্সি নাসির তার গডফাদার। এছাড়া আলিকো (আমেরিকান লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি) ভবনের সামনের ফুটপাত থেকে চাঁদা তোলেন স্থানীয় লাইনম্যান ছাদেক। স্থানীয় হকারদের ভাষ্য অগ্রণী ব্যাংকের সামনে চাঁদা তোলেন অবৈধ সংগঠন ইসলামী হকার্স শ্রমিক আন্দোলনের নেতা আবুল কালাম ওরফে জুয়েল এবং মান্নান। তবে তাদের নেপথ্যের শেল্টারদাতা আবুল হোসেন নামের এক বামপন্থি নেতা। আবুল হোসেন নিজেও হকার্স সংগ্রাম পরিষদ নামের সংগঠন খুলে চাঁদাবাজি করতেন। কিন্তু আদালত কর্তৃক সংগঠনটি নিষিদ্ধ হলে ভিন্ন পথ বেছে নেন তিনি।
পল্টন : বায়তুল মোকাররমের পূর্ব পাশের গেট থেকে ভিআইপি রোড পর্যন্ত বিশাল ফুটপাত নিয়ন্ত্রণ করেন দুলাল ওরফে মাদারীপুরের দুলাল, তার ছেলে শুভ এবং ছোট ভাই শরীফ। চাঁদা তুলতে রীতিমতো বাহিনী গড়ে তুলেছেন দুলাল। চাঁদাবাজির জন্য স্থানীয় একাধিক কিশোর গ্যাংয়ের যোগাযোগ রাখেন তার ভাই শরীফ। এছাড়া পেশাদার মাদক ব্যবসায়ী দুলাল পুলিশের তালিকাভুক্ত।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, বাসস’র (বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা) সামনের ফুটপাতে কয়েকশ দোকান। পাজামা, পাঞ্জাবি, জুতা, সেন্ডেল কী নেই। পূর্ব ও পশ্চিমে বিস্তৃত ফুটপাতের পুরোটাই হকারদের দখলে। কয়েকটি হকার সংগঠনের নামে এখান থেকে চাঁদা ওঠে। এর মধ্যে বাংলাদেশ হকার্স ইউনিয়নের নামে চাঁদা তোলেন জনৈক আবুল হাসেম ওরফে কবির ও হযরত আলী। এছাড়া জিপিও’র দক্ষিণ পাশের ফুটপাতে চাঁদা তোলেন লাইনম্যান সালাম ওরফে দাড়িওয়ালা সালাম। স্থানীয় থানার সোর্স দুলালের ভাই শহীদ তার অন্যতম সহযোগী।
জাসদ অফিসের সামনের ফুটপাতও হকারদের দখলে। এমনকি ফুটপাত ছেড়ে হকারদের অনেকে এখন রাস্তায় নেমে এসেছে। ফুটপাতের বেশ কিছু জায়গা স্থায়ী দোকান করে ভাড়া দিয়েছেন বিএনপি নেতা এমএ হান্নান। তিনি ঢাকা মহানগর কমিটির সহসাংগঠনিক সম্পাদক ও রমনা থানা বিএনপির সাবেক সভাপতি।
স্থানীয়রা বলছেন, বিএনপি আমলে হান্নান বেপরোয়া ছিলেন। এলাকার বিস্তীর্ণ ফুটপাতের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ ছিল তার হাতে। কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তিনি অনেকটাই কোণঠাসা। তবে তার চাঁদাবাজি থেমে নেই। এখন প্রকাশ্যে না এলেও নিজস্ব লোক দিয়ে চাঁদা তোলেন হান্নান। এছাড়া ইত্যাদি হোটেলের সামনে থেকে আওয়ামী লীগ অফিস পর্যন্ত দীর্ঘ ফুটপাতে চাঁদাবাজি করেন সালাম ওরফে জুয়াড়ি সালাম।
বায়তুল মোকাররম : চারপাশে অগণিত ফুটপাত জাতীয় মসজিদের চারপাশ ঘিরে ধরেছে অক্টোপাসের মতো। রাস্তা ছাড়িয়ে হকারদের অনেকে এখন মসজিদ চত্বরেও উঠে গেছেন। ফুটপাতের সংখ্যা দিন দিন আরও বাড়ছে। ফলে ফুটপাত ঘিরে বাড়ছে চাঁদাবাজের সংখ্যা। স্থানীয় হকারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একাধিক লাইনম্যান বায়তুল মোকাররম এলাকায় চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করেন। এর মধ্যে দক্ষিণ গেটে খলিল ওরফে মোটকা খলিল, পশ্চিম পাশে কোটন ওরফে ফুট কোটন এবং স্বর্ণ মার্কেটের সামনে চাঁদা তোলেন হারুন ওরফে চাঁটগাইয়া হারুন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক হকার নেতা যুগান্তরকে বলেন, আগে বায়তুল মোকাররমে চাঁদাবাজি করতেন তমিজ নামের এক লাইনম্যান। কিন্তু বনিবনা না হওয়ায় পল্টন থানার তৎকালীন ওসি শহিদুল হক তমিজকে হটিয়ে দেন। পরে এলাকার ফুটপাতের দায়িত্ব পান হারুন। পুলিশের ইশারায় তমিজের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা করেন হারুন। এ নিয়ে দ্বন্দ্বের এক পর্যায়ে হকার্স ফেডারেশনের নেতা বনে যান হারুন। এছাড়া বায়তুল মোকাররমের সামনের ফুটপাতে চাঁদাবাজি করে মিতালী সমিতি নামের এক হকার সংগঠনের নেতারা।