০৬ জুলাই ২০২৫, রবিবার, ০৭:৪৬:৩৮ অপরাহ্ন
বাংলাদেশে এআই: অবারিত ব্যবহার, নেই আইনি লাগাম; কতটা নিরাপদ আমরা?
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৬-০৭-২০২৫
বাংলাদেশে এআই: অবারিত ব্যবহার, নেই আইনি লাগাম; কতটা নিরাপদ আমরা?

গত বছর আগস্টে যখন বাংলাদেশের আটটি জেলায় বন্যা হয়, তখন তিন বা চার বছর বয়সী এক শিশুর প্রায় কাঁধ পর্যন্ত বন্যার পানিতে ডুবে থাকার সাদা- কালো একটি ছবি তোলপাড় তোলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এই ছবিটি ফেসবুকে শেয়ার করেছিলেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল ও নায়িকা পরিমনিও।


আবার অনেকেই ফেসবুকে শিশুটির পরিচয় ও সন্ধান জানতে চায়। কিন্তু পরে দেখা গেল সাড়া জাগানো ওই ছবিটি আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এ আই) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে তৈরি করা।


বন্যায় মানুষের মানবেতর জীবন - যাপনের এমন সময়ে ভীত - সন্ত্রস্ত শিশুর ওই ছবি মানুষের হৃদয়ে নাড়া দিয়েছিল, অথচ সেটি আসল ছবি ছিলো না। শুধু বাংলাদেশই নয় বরং বিশ্বের প্রায় সব দেশেই এআই প্রযুক্তির প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে এর ব্যবহার ও অপব্যবহার দুইই বাড়ছে। বিশ্বের অনেক দেশেই এই প্রযুক্তির অপব্যবহার রোধে বিভিন্ন আইনি কাঠামো রয়েছে।(প্রতিবেদনটি বিবিসি বাংলার জান্নাতুল তানভীর)।


দেশগুলোর পূর্ণাঙ্গ আইন, এক্সিকিউটিভ আদেশ, নীতিমালা, পলিসি বা স্ট্রাটেজি, বিল এমন নানা ধরনের আইনি পরিকাঠামো রয়েছে। ফলে সেসব দেশে এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে কোন ছবি, ভিডিও বা কনটেন্ট তৈরির সীমা যেমন রয়েছে তেমনি অপব্যবহার রোধের ব্যবস্থাও রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারের সীমা বা অপব্যবহার রোধে এখনও আইনি কোনও কাঠামো নেই। অর্থাৎ কোনো সমন্বিত গাইডলাইন বা বিধিমালা, পলিসি বা নীতিমালা এমনকি স্ট্র্যাটেজিও নেই বাংলাদেশে। ফলে এআই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশ এখনো পুরোপুরি প্রস্তুত নয় বলে মনে করছেন প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ এবং আইনজীবীরা।


তবে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত এবং অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব জানিয়েছেন পলিসি তৈরিতে কাজ করছে সরকার।


তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, আমাদের একটা টিম ন্যাশনাল এআই পলিসি করার জন্য কাজ করছে। আমরা এখন আরও বেশ কয়েকটি পলিসি নিয়ে কাজ করছি। এই পলিসিগুলো যদি শেষ হয় তখন আমরা ন্যাশনাল এআই পলিসিটাকে এগিয়ে নিয়ে যাব। সেখানেই সংশ্লিষ্ট সবগুলো বিষয়কে আমরা অ্যাড্রেস করবো।


তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য প্রযুক্তি ইন্সটিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক বিএম মইনুল হোসেন মনে করেন, জেনারেটিভ এআই আসার পর যে কারো কণ্ঠ, চেহারা নকল করা হচ্ছে। এটা শুধু আমাদের দেশের জন্যই না বরং সারা বিশ্বের জন্যই এটা উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।


বিএম মইনুল হোসেন বলেন, এআই এর বেশ কিছু কনসার্ন সারা বিশ্বেই যেটা নিয়ে কথা হচ্ছে সেটা হচ্ছে এর এথিকেল ইউজ। এআই কিন্তু ব্যাপকভাবে মিস ইউজ করা যায়। আরেকটা হচ্ছে প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর জন্য। মিস ইনফরমেশন, ডিস ইনফরমেশন এআই আসার পর যে পরিমাণ ছড়ানো যাচ্ছে, এটা আগে কখনো দেখি নাই।


তবে শুধু এআই পলিসি হলেই হবে না বরং এর সঙ্গে সম্পর্কিত আরও কিছু বিষয় যেমন ‘ডেটা প্রোটেকশন অ্যাক্ট, ইনোভেশন ইনডেক্স, ইউজার ডুয়িং বিজনেস’না থাকলে এআই পলিসির সুফল পাওয়া যাবে না বলে মনে করছেন এই অধ্যাপক।


এআই নীতিমালা কি? কেন প্রয়োজন?


প্রযুক্তির ব্যবহার যেমন জীবনকে সহজ করে, তেমনি এর অপব্যবহারে দুর্বিষহও হয়ে ওঠে। বিশেষজ্ঞ ও আইনজীবীরা মনে করেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য আইনি কাঠামো থাকা উচিত।


সাধারণভাবে বলা যায়, ধরুন- কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি ব্যবহার করে এমন একটি ভিডিও বা ছবি তৈরি করা যায়, যার সাথে বাস্তবের কোন মিল নেই এবং অন্য কোনো ব্যক্তির ক্ষতির কারণ হতে পারে। এ ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করে অপরাধ রোধ করতে প্রয়োজন গাইড লাইন অথবা সুনির্দিষ্ট আইনি কাঠামো। প্রযুক্তি কতটুকু ব্যবহার করা যাবে আর কতটুকু যাবে না, সেটির সীমা নির্ধারিত থাকতে হবে বলে মনে করেন আইনজীবীরা।


সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী রাশিদা চৌধুরী নিলু বিবিসি বাংলাকে বলেন, কোনো জিনিস যখন আমি অ্যাপ্লিকেশন করবো সেটার সীমাবদ্ধতাটাও কিন্তু আমাকে নির্ধারণ করতে হবে। এই নির্ধারণের জন্য এআই’য়ের যেমন প্রসার বাড়ছে তেমনি এটার লাগাম কোথায় টেনে ধরতে হবে সেটাও জানা প্রয়োজন।


কম্পারিটেক সাইবার সিকিউরিটি ইনডেক্স অনুযায়ী, সাইবার নিরাপত্তার দিক থেকে বিশ্বের সবচেয়ে কম সুরক্ষিত অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। যদিও আইটিইউ গ্লোবাল সাইবার সিকিউরিটি ইনডেক্স, এ অবস্থান থেকে উত্তরণের প্রচেষ্টার কারণে সাইবার নিরাপত্তায় মধ্যম অবস্থানে রেখেছে বাংলাদেশকে। অর্থাৎ কোন ব্যক্তির শুধু শারীরিক নিরাপত্তা নয়, সাইবার নিরাপত্তাও যে কতটা জরুরি তা এই ইনডেক্সই প্রমাণ করে।


আইনজীবীরা বলছেন, প্রযুক্তির ব্যবহার যখন করা হবে তখন এটির সীমাবদ্ধতাও নির্ধারণ করতে হবে। যখন আপনি জানবেন এটা (নেতিবাচক উপায়ে) বানানোর পর আইনের আওতায় পড়বো এবং ব্যবহারের সীমাবদ্ধতা নির্ধারণ করা থাকবে, তখন ওই ব্যক্তি কতটুকু করতে পারবে বা ক্ষতিকর দিক সেটা তার মাথায় থাকবে। সেজন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সংক্রান্ত আইন খুবই জরুরি।


বাংলাদেশে বিদ্যমান কোন আইনে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারের সীমা বা অপব্যবহার রোধ বা প্রতিকার পাওয়ার উপায় নেই বলে জানিয়েছেন মিজ নিলু।


আইনজীবী মিজ নিলু বলেন, যখন কোন ব্যক্তি মানুষ কোন অপরাধ করে, তখন তাকে চিহ্নিত করে অপরাধ অনুযায়ী মানদণ্ড নির্বাচন করে তার শাস্তির ব্যবস্থা করা যায়। এআই দিয়ে যেমন অনেক কাজ সহজ করা যাচ্ছে, তেমনি টুলগুলো ব্যবহার করে অন্যের ক্ষতিসাধন করার জন্য অনেক কিছু তৈরি করতে পারছি। প্রযুক্তির মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত এই ব্যক্তির প্রতিকার পাওয়ার জন্যই সুনির্দিষ্ট আইন বা আইনি কাঠামো প্রয়োজন। কিন্তু এই মুহূর্তে কোনো আইনেই তা নেই।


শেয়ার করুন