০৬ জুলাই ২০২৫, রবিবার, ১০:৪৫:২৪ অপরাহ্ন
রাজশাহীতে বাড়ছে স্ক্যাবিস-ফাঙ্গাসজনিত চর্মরোগ
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৬-০৭-২০২৫
রাজশাহীতে বাড়ছে স্ক্যাবিস-ফাঙ্গাসজনিত চর্মরোগ

রাজশাহীর পবা উপজেলার দুয়াড়ি উত্তরপাড়ার চা দোকানদার সিরাজুল ইসলাম। চা বিক্রির ফাঁকে ফাঁকে হাতে-পায়ের কয়েকটি স্থানে মাঝে মাঝেই চুলকাতে থাকেন সিরাজুল। কিছুক্ষণ চুলকানে পরে আরাম পাওয়ার গেলে কাজে মনোযোগ দেন। কিন্তু একটু পরেই আবারও চুলকাতে শুরু করেন। যেন চুলকানি থেকে নিস্তার নেই তাঁর। বাস্তবেই সিরাজুলের জীবনে প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে এমন ঘটনা।


প্রায় ৮ মাস ধরে হাতে-পয়ের চুলকানি রোগে ভূগছেন তিনি। চুলকানি এতোটায় বেশি যে হাতে-পায়ের বিভিন্ন স্থানে ছোপ ছোপ পুরু (মোট) দাগ জমে গেছে। যে কেউ এক নজরে দেখেইে বলবে এটি চর্মরোগ।


এই চর্মরোগের জন্য সিরাজুল ইসলাম গ্রামের পানিপড়া পান থেকে শুরু করে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজের বর্হিবিভাগ, বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকের কাছে চিকিৎসা, লতা-পাতার রস ব্যবহার থেকে শুরু করে নানাভাবে চেষ্টা করে চলেছেন। কিন্তু চুলকানি ভালো হচ্ছে না তাঁর। ফলে অনেকটায় নিরাস হয়ে পড়েছেন তিনি। এতে করে গত প্রায় দুই মাস ধরে আর কোনো ওষুধ সেবনও করছেন না।


অনুসন্ধানে জানা গেছে, শুধু সিরাজুল ইসলামই নন, রাজশাহীর এরকম শত শত রোগী জটিল চর্মরোগে ভূগছেন। কেউ নতুন আক্রান্ত হচ্ছেন, আবার কেউ দুই বছর-তিন বছর বা তারও বেশি সময় ধরেও চর্মরোগে ভূগছেন। আক্রান্ত মানুষদের মধ্যে কেবল রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের (রামেক) বর্হিবিভাগে গড়ে প্রতিদিন প্রায় এক হাজার রোগী আসছেন চর্মরোগের চিকিৎসা নিতে। তাঁদের মধ্যে নারীর সংখ্যা বেশি। এর পরে আছে শিশুদের সংখ্যা। হাসপাতালে প্রতিদিন যে পরিমাণ চর্মরোগী আসছেন, তার দ্বিগুন আসছেন নারী। যাদের মধ্যে বেশির ভাগই আক্রান্ত স্ক্যাবিস ও ফাঙ্গাস জাতীয় রোগে।


বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আবহাওয়ার পরিবর্তন, করোনার টিকার পাশর্^প্রতিক্রিয়া, বাতাসে দূষণের মাত্রা বেশি থাকা, সচেতনতার অভাব, বর্জ্যযুক্ত পানির ব্যবহারের ফলে চর্মরোগীর সংখ্যা দিন দিন মারাত্মক হারে বাড়ছে।


গতকাল এ হাসপাতালের বর্হিবিভাগের চিকিৎসা নিতে আসা পুঠিয়ার আসমা খাতুন (৪৫) নামের এক নারী বলছিলেন, ‘গত প্রায় এক বছর ধরি গোটা শরীলে চুলকানি রোগে ভূগতিছি। গোটা শরীরে ঘামচির মুতন লাল দাগ হয়, আর প্রচুর চুলকায়। র‌্যাতে বেশি চুলকায়। চুলকানির জ¦ালাতে ঠিকমুতন ঘুমাতেও পারি না। অনেক খারাপ লাগে। এতো ওষুধ খ্যাচ্ছি, তাও ভালো হওয়ার কুনো লক্ষ্যনই দেখিতে প্যাচ্ছি না। ওষুধ খ্যালে ইকটু কমে। আবার দুইদিন পরে বাড়ে। তাও অ্যাসছি ডাক্তারের কাছে। ওষুধ না খায়ে থ্যাকতে তো পারি ন্যা।’


রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বর্হিবিভাগ সূত্র মতে, এই বিভাগে গত ১ জুলাই যেসব রোগী চিকিৎসা নিতে আসেন তার মধ্যে চর্মরোগে আক্রান্ত রোগী আসেন ৯১০ জন। এর মধ্যে নারী রোগী ছিলেন ৫৮১ জন এবং পুরুষ (শিশুসহ) ৩২৯ জন। গত ২ জুলাই একই রোগে আক্রান্ত রোগী ছিলেন ৯৯০ জন। এর মধ্যে নারী ছিলেন ৬৫৪ জন এবং পুরুষ (শিশুসহ) ছিলেন ৩৩৬ জন। গত ৩ জুলাই এ রোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর সংখ্যা ছিল ৮০২ জন। তবে গতকাল শনিবার ছিল প্রায় এক হাজারের কিছু বেশি জন। সবমিলিয়ে গড় প্রতিদিন প্রায় এক হাজার চর্ম রোগী আসছেন রামেক হাসপাতালের বর্হিবিভাগেই চিকিৎসা নিতে। এর বাইরে রাজশাহীর পপুলার ডায়াগোনস্টিক সেন্টার, ইসলাম ব্যাংক হাসপাতাল, ইবনে সিনা, ল্যাবএইড হাসপাতালসহ বিভিন্ন বেসরকারী হাসপাতাল এবং চর্ম ও যৌন রোগ বিশেষজ্ঞদের ব্যক্তিগত কার্যালয় (চেম্বার) গড়ে প্রতিদিন আরও অন্তত এক হাজার রোগী আসছেন চিকিৎসা নিতে। ফলে প্রতি মাসে রাজশাহী হাসপাতালে শুক্রবার ও ছুটির দিন বাদে গড়ে অন্তত ৫০ হাজার চর্মরোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। যাদের অধিকাংশই স্ক্যাবিস ও ফাঙ্গাস (দাদ) জাতীয় রোগে আক্রান্ত।


রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মুখপাত্র ডাক্তার শংকর কে বিশ^াস বলেন, ‘রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে যেসমস্ত চর্মরোগী আসছেন চিকিৎসা নিতে তাঁদের অধিকাংশই হলেন নারী। এর পরে আছে শিশু। সাম্প্রতিক সময়ে বিশেষ করে ২০২৩ সাল থেকে চরর্মরোগে আক্রান্তের হার বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। এর অন্যতম কারণ হলো আবহাওয়ার পরিবর্তন, করোনার টিকার পাশর্^প্রতিক্রিয়া, বাতাসে দূষণের মাত্রা বেশি থাকা, সচেতনতার অভাব, বর্জ্যযুক্ত পানির ব্যবহারের ফলে চর্মরোগীর সংখ্যা দিন দিন মারাত্মক হারে বাড়ছে। তবে আমরা সাধ্যমতো রোগীদেও চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছি।’


রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজের চর্ম ও যৌন রোগের চিকিৎসক আলমগীর রেজা বলেন, ‘আমি আমার ব্যক্তি চেম্বারের বিকেলে রোগী দেখি। সেখানেও প্রচুর রোগী আসে প্রতিদিন। বিশেষ করে নারীদের স্যংখ্যায় বেশি। এদের মধ্যে স্ক্যাবিস ও ফাঙ্গাস বা দাদ জাতীয় রোগে আ্রকান্ত রোগীর সংখ্যা বেশি। এ দুটি রোগ ছোঁয়াচে বা সংক্রামক। একে অপরের শরীর থেকে দ্রুত ছড়ায় এবং নিরাময়ে মানুষের মাঝে সচেতনতারও অভাবও রয়েছে। দেখা যাচ্ছে বাড়ির একজনের শরীওে প্রথমে দেখা দিল, সে কিছুদিন ভালো হয়ে গেলো। কিন্তু সচেতন না হওয়ায় পরিবারের অন্য সদস্যের শরীরের জমে থাকা জার্ম আবার ওই ব্যক্তির শরীরে আক্রমণ করে। ফলে কিছুদিন ভালো থাকলেও পরবর্তিতে আবার আক্রমণের হার বেশি হয়। একজনের পোশাকথেকে আরেক জনের শরীরেরও ছোড়ায় এসব রোগ।’


তিনি আরও বলেন, একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ও নির্দিষ্ট মাত্রায় এসব রোগের ওষুধ সেবন করতে হয়। কিন্তু আমাদের দেশের রোগীরা এ দুটি নিয়মই অনেকে মানেন না। কিছুদিন ভালো থাকলেই মনে হয় ভালো হয়ে গেছে। এর পর আবার আক্রমণ হয় ছোঁয়াচে স্ক্যাবিস ও ফাঙ্গাস জাতীয় রোগের। ফলে এ দুটি রোগের পরিমাণ বাড়ছেই।’


শেয়ার করুন