১৯ নভেম্বর ২০২৪, মঙ্গলবার, ০৩:৩০:১০ অপরাহ্ন
অপার বিস্ময়ের মডেল মসজিদ
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৬-০১-২০২৩
অপার বিস্ময়ের মডেল মসজিদ

সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে ৯ হাজার ৪৩৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ হচ্ছে ৫৬৪ মডেল মসজিদ ♦ ইসলাম প্রচার ও প্রসারে শেখ হাসিনার অনন্য নজির ♦ ইতোমধ্যে ১০০ মডেল মসজিদ উদ্বোধন ♦ জুনের মধ্যে উদ্বোধন হবে সাড়ে ৪ শ ♦ প্রতিদিন ৪ লাখ ৯৪ হাজার ২০০ পুরুষ ও ৩১ হাজার ৪০০ নারীর একসঙ্গে নামাজ আদায়

অতি সম্প্রতি ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু দেখতে গিয়েছিলেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আরাফাত ও ওয়াজেদ নামের দুই বন্ধু। ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে ধরে পদ্মা সেতু পেরিয়ে রাস্তার পাশে তাদের চোখে পড়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গা মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। দৃষ্টিনন্দন মসজিদ দেখে দাঁড়িয়ে যান দুই বন্ধু। ঘুরে ঘুরে দেখেন অপার বিস্ময়ের এই মডেল মসজিদ। এ সময় মসজিদের সামনে তারা ছবিও তোলেন। মসজিদের সামনে এ প্রতিবেদকের কথা হয় আরাফাত ও ওয়াজেদের সঙ্গে। তারা বললেন, ‘সরকারের অর্থায়নে এত সুন্দর দৃষ্টিনন্দন মসজিদ আসলেই কল্পনাতীত। কিন্তু জাতির  পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতোই তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা ইসলামের প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্রে যুগান্তকারী অবদান রেখে চলেছেন, যা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।’ গত ১৬ জানুয়ারি গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সে এ মসজিদের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একই দিন কুষ্টিয়া সদরের কুটিপাড়ায় উদ্বোধন করা হয়েছে আরেকটি মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের। ওই এলাকায় এত সুন্দর ও দৃষ্টিনন্দন মসজিদ দ্বিতীয়টি নেই। এই মসজিদের ইমাম ও খতিবের দায়িত্বে রয়েছেন হাফেজ মাওলানা মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, একসঙ্গে এত দৃষ্টিনন্দন মসজিদ কোনো দেশের সরকার করেছে বলে আমার জানা নেই। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা তা তৈরি করেছেন। ইসলাম প্রচার ও প্রসারে এ এক অনন্য নজির। বুখারি হাদিসে মসজিদ নির্মাণের ফজিলত বর্ণনা দিয়ে এই মাওলানা বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য মসজিদ নির্মাণ করবে, মহান আল্লাহ তার জন্য জান্নাতে অনুরূপ ঘর তৈরি করে দেবেন।’

শুধু ফরিদপুরের ভাঙ্গা বা কুষ্টিয়া নয়, ইতোমধ্যে সারা দেশে এমন দৃষ্টিনন্দন ১০০টি মডেল মসজিদ উদ্বোধন করা হয়েছে। দ্রুত নির্মাণ কাজ এগিয়ে চলেছে আরও ৪৬৪টির। মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স প্রকল্পের একটি সূত্র জানায়, আগামী ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে আরও ৫০টি মডেল মসজিদ উদ্বোধন করা হবে। আগামী জুনের মধ্যে উদ্বোধন করা হবে সাড়ে চার শর মতো মসজিদের নির্মাণ কাজ। এর আগে কোনো মুসলিম শাসক বা সরকারপ্রধান একসঙ্গে এতগুলো মসজিদ নির্মাণ করেননি। ফলে শুধু বাংলাদেশই নয়, বিশ্বের মধ্যে এটিকে একটি অনন্য এবং যুগান্তকারী ঘটনা হিসেবেই দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, মুসলিম বিশ্বে এই প্রথম কোনো দেশের সরকারপ্রধান একসঙ্গে ৫৬৪টি মসজিদ নির্মাণ করছেন।

জানা গেছে, আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী ইসলামের প্রচার ও প্রসার এবং মসজিদকে জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে দেশের প্রতিটি জেলা-উপজেলায় একটি করে মোট ৫৬৪টি মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণ করছে বর্তমান সরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২১ সালের ১০ জুন প্রথম ৫০টি মডেল মসজিদ উদ্বোধন করেন। দ্বিতীয় ধাপে ২০২২ সালের ১৬ জানুয়ারি আরও ৫০টি মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র উদ্বোধন করেন তিনি। ২০১৭ সালে এই প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশন এই প্রকল্পটির বাস্তবায়ন করছে। প্রকল্প হাতে নেওয়ার সময় এর অনুমিত খরচ ছিল ৯ হাজার ৬২ কোটি ৪১ লাখ টাকা। এই খরচের ৯০ শতাংশ অনুদান হিসেবে সৌদি আরব থেকে আসার কথা ছিল। কিন্তু এক বছরেরও বেশি সময় অপেক্ষা করেও সেই সহায়তা পাওয়া যায়নি। বিদেশি সহায়তা না মিললেও এই প্রকল্প থেকে সরে যায়নি সরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় সরকারের নিজস্ব তহবিলের মাধ্যমে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। ২০১৮ সালের ২৬ জুন প্রকল্পের খরচ ৩৪০ কোটি টাকা কমিয়ে ৮ হাজার ৭২২ কোটি করা হয় এবং বাস্তবায়নের সময়সীমা ২০১৯ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়। ভূমি অধিগ্রহণে দেরি হওয়া, করোনার আঘাত, নির্মাণ সামগ্রীর দাম বৃদ্ধির কারণে প্রকল্পের ব্যয়ও বেড়ে যায়। প্রকল্পটির নতুন মেয়াদকাল ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত এবং এর জন্য মোট খরচ হবে ৯ হাজার ৪৩৫ কোটি টাকা।

মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) মো. নজিবুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এ প্রকল্পের আওতায় এরই মধ্যে ১০০টি মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স নির্মাণের কাজ শেষ। আগামী ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে আরও ৫০টি মডেল মসজিদ উদ্বোধন করা হবে। চলতি অর্থ বছরের শেষের দিকে অর্থাৎ জুনের মধ্যে মোট সাড়ে চার শ মসজিদ উদ্বোধন করতে সক্ষম হব বলে আশা করছি।’ নজিবুর রহমান আরও বলেন, ‘এটি গতানুগতিক কোনো মসজিদ নয়। এটি আরব বিশ্বের মসজিদ কাম ইসলামিক কালচারাল সেন্টারের আদলে করা। এই মসজিদ ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে থাকছে নারী ও পুরুষদের পৃথক অজু ও নামাজ আদায়ের সুবিধা, লাইব্রেরি, গবেষণা ও দীনি দাওয়াত কার্যক্রম, পবিত্র কোরআন হেফজ এবং শিশু শিক্ষাসেবা, অতিথিশালা, বিদেশি পর্যটকদের আবাসন, লাশ গোসলের ব্যবস্থা, হজযাত্রীদের নিবন্ধন ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, ইমামদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং ইমাম-মুয়াজ্জিনের আবাসনসহ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য অফিসের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।’ জানা গেছে, জেলা-উপজেলা পর্যায়ে ৪০ শতক জায়গায় অপার বিস্ময়ের এই মডেল মসজিদ নির্মাণ করা হচ্ছে। জেলা পর্যায়ে ও উপকূলীয় এলাকায় দৃষ্টিনন্দন চার তলা মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র এবং উপজেলার জন্য তিন তলা মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে। ৫৬৪টি মডেল মসজিদে সারা দেশে প্রতিদিন ৪ লাখ ৯৪ হাজার ২০০ জন পুরুষ ও ৩১ হাজার ৪০০ জন নারী একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারবেন।

‘এ’ ক্যাটাগরিতে ৬৪টি জেলা শহরে এবং সিটি করপোরেশন এলাকায় ৬৯টি চার তলা বিশিষ্ট মডেল মসজিদ নির্মিত হচ্ছে। এ মসজিদগুলোর প্রতি ফ্লোরের আয়তন ২ হাজার ৩৬০ দশমিক ০৯ বর্গমিটার। ‘বি’ ক্যাটাগরিতে উপজেলা পর্যায়ে ৪৭৫টি মডেল মসজিদ নির্মাণ করা হচ্ছে। এগুলোর প্রতি ফ্লোরের আয়তন ১ হাজার ৬৮০ দশমিক ১৪ বর্গমিটার। ‘সি’ ক্যাটাগরিতে উপকূলীয় এলাকায় ১৬টি মসজিদ নির্মাণ করা হচ্ছে। এগুলোর প্রতি ফ্লোরের আয়তন ২ হাজার ৫২ দশমিক ১২ বর্গমিটার। উপকূলীয় এলাকার মসজিদগুলোতে আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবে এর নিচ তলা ফাঁকা থাকবে। একেকটি মসজিদ নির্মাণ করতে ব্যয় হচ্ছে জেলা শহর ও সিটি করপোরেশন এলাকায় ১৫ কোটি ৬১ লাখ ৮১ হাজার টাকা, উপজেলা পর্যায়ে ১৩ কোটি ৪১ লাখ ৮০ হাজার টাকা এবং উপকূলীয় এলাকায় ১৩ কোটি ৬০ লাখ ৮২ হাজার টাকা। জেলা সদর ও সিটি করপোরেশন এলাকার মডেল মসজিদগুলোতে একসঙ্গে ১ হাজার ২০০ মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারবেন। উপজেলা ও উপকূলীয় এলাকার মডেল মসজিদগুলোতে একসঙ্গে ৯০০ মুসল্লির নামাজ আদায়ের ব্যবস্থা থাকছে।

ধর্মপ্রতিমন্ত্রী মো. ফরিদুল হক খান সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এ বিষয় বলেন, বাংলাদেশে সাড়ে ৩ লক্ষাধিক মসজিদ রয়েছে। এসব মসজিদের সিংহভাগই স্থানীয় জনগণের আর্থিক সহায়তায় প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত হচ্ছে। বাংলাদেশের জেলা-উপজেলা পর্যায়ে আধুনিক সুবিধাসংবলিত দৃষ্টিনন্দন মসজিদ বা ইসলামী স্থাপনা নেই বললেই চলে। এসব বিবেচনায় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইসলামী মূল্যবোধের উন্নয়ন এবং ইসলামী সংস্কৃতি বিকাশের উদ্দেশে দেশের প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় একটি করে মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন।

তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে ইসলামী মূল্যবোধের উন্নয়ন এবং ইসলামী সংস্কৃতি বিকাশের উদ্দেশে প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় একটি করে মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম কোনো সরকার দেশীয় অর্থায়নে একসঙ্গে ৫৬৪টি মডেল মসজিদ ও ইসলামী সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মাণ করছে।

এ ছাড়া আওয়ামী লীগের ধর্মবিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট সিরাজুল মোস্তফা এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেছেন, তাবলিগ জামাতের জন্য কাকরাইলে মসজিদ ও টঙ্গীতে ইজতেমার জায়গা দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাদরাসা শিক্ষার প্রসারে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। কওমি মাদরাসার সনদ দিয়েছেন, আলিয়া মাদরাসার জন্য স্বতন্ত্র আরবি বিশ্ববিদ্যালয় করে দিয়েছেন। ইসলামিক সংস্কৃতির প্রসারে সারা দেশে ৫৬৪টি মডেল মসজিদ নির্মাণ করছেন। এটাই হচ্ছে বিশ্বে প্রথম কোনো সরকারের একই সময়ে একসঙ্গে এত বিপুলসংখ্যক মসজিদ নির্মাণের ঘটনা, যা বিশ্বে বিরল। ইসলামের প্রচার ও প্রসারে অনন্য নজির।’ তিনি বলেন, ‘মডেল মসজিদগুলোতে দীনি দাওয়াত কার্যক্রম ও ইসলামী সংস্কৃতি চর্চার পাশাপাশি মাদক, সন্ত্রাস, যৌতুক, নারীর প্রতি সহিংসতাসহ বিভিন্ন সামাজিক ব্যাধি রোধে সচেতনতা কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। মডেল মসজিদগুলো শুধু নামাজ পড়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। এখানে ইসলামী সংস্কৃতি চর্চার পাশাপাশি জ্ঞান অর্জন ও গবেষণা সুযোগ থাকবে, প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকবে। এতেই প্রমাণ হয়, আওয়ামী লীগ তথা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইসলাম প্রচার ও প্রসারে কীভাবে ভূমিকা রাখছেন। যা অতীতে কেউ রাখেনি।’ 

আলেম সমাজের নেতৃস্থানীয় বিশিষ্টজনেরা বলছেন, ইসলামের প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্রে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর সুযোগ্যকন্যা ‘কওমি জননী’ উপাধিপ্রাপ্ত জননেত্রী শেখ হাসিনার যুগান্তকারী অবদান ইতিহাসে চিরদিন স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। তাঁর সরকার কওমি মাদরাসাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। করোনাকালে মসজিদের ইমাম ও মুয়াজ্জিনদের কোটি কোটি টাকা অনুদান দেওয়া হয়েছে। এ জন্যই দেশের মানুষ সত্যিকার ইসলাম অনুরাগী নেত্রী ও সরকারপ্রধানকে তাদের অন্তরের অন্তস্তলে ঠাঁই দিয়েছে।

শেয়ার করুন