বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী ফারদিন নূর পরশ (২৪) হত্যা রহস্যের জট এখনো খোলেনি। হত্যাকাণ্ডের সুস্পষ্ট কোনো কারণের কথাও এখনো জানাতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তবে সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ, গোয়েন্দা তথ্য ও তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় পাওয়া বেশ কিছু বিষয় নিয়ে কাজ করছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। নিখোঁজ হওয়ার রাতে (৪ নভেম্বর) ফারদিন তার বান্ধবী আমাতুল্লাহ বুশরাকে রামপুরায় নামিয়ে দেওয়ার পর কেন তিনি বিভিন্ন জায়গায় ছোটাছুটি করছিলেন এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে গোয়েন্দারা। রিমান্ডে বুশরাকে দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন ডিবি সদস্যরা। এছাড়াও আরও দুই বন্ধুকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ডিবি হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদে বুশরা খুব স্বাভাবিক অবস্থায় আছেন। তার চেহারা বা চোখেমুখে কোনো আতঙ্ক বা ভয়ের ছাপ নেই। ফারদিন হত্যাকাণ্ডে নিজের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে এখনো কোনো তথ্য দেননি তিনি। তাকে বিভিন্ন বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। কোনোটির সঠিক উত্তর দিলেও অনেক প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছেন না।
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের প্রধান খন্দকার গোলাম ফারুক যুগান্তরকে বলেন, ফারদিন হত্যার বিষয়ে তেমন কোনো তথ্য আমার কাছে নেই। বিষয়টি নিয়ে আপনি গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের প্রধানের সঙ্গে কথা বলতে পারেন।
ডিবি প্রধান হারুন অর রশীদ যুগান্তরকে বলেন, আমরা এখনো রহস্য বের করতে পারিনি। তদন্তে বলার মতো কোনো অগ্রগতিও হয়নি। রিমান্ডে বুশরা উল্লেখযোগ্য কোন তথ্য দিতে পারেননি। কিছু বিষয়ে তিনি কথা বলেছেন। সেগুলোর সঙ্গে হত্যাকাণ্ডের যোগসূত্র আছে বলে মনে হচ্ছে না। তারপরও ডিবি সর্বোচ্চ পেশাদারিত্ব রেখেই তদন্তকাজ এগিয়ে নিচ্ছে।
ফারদিনের বাবা কাজী নূরুদ্দিন অভিযোগ করেছেন, প্রকৃত ঘটনাকে ধামাচাপা দিতে পরিকল্পিতভাবে কাল্পনিক কাহিনি সাজানো হচ্ছে। তার দাবি, ফারদিন কোনোদিন সিগারেটও স্পর্শ করেনি। আমি নিজে ধূমপান করে ঘরে ঢুকলে যে ছেলে গন্ধ সহ্য করতে পারত না, সে ছেলেকে মাদকসেবী বানানো হচ্ছে। নুরুদ্দিন বলেন, সন্তান মাদকসেবী হলে বাবা-মায়ের তা লোকজনের কাছে আড়াল করতে চাইতেই পারেন। কিন্তু ওই ধরনের বাবা নই। চেহারা, আচার-আচরণে মাদকসেবী চেনা যায়। আমার ছেলেকে কখনোই সে রকম মনে হয়নি। প্রকৃতপক্ষে ফারদিন মাদকসেবী ছিল না। ফারদিন হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে কোনো হাইপ্রোফাইল লোক জড়িত থাকতে পারে। যাকে বাঁচাতে নাটক সাজিয়ে ঘটনা ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টা চলছে।
কাজী নুরুদ্দিন বলেন, ফারদিন যদি মাদকসেবী হয়ে থাকে তাহলে সে মাদক কিনতে রূপগঞ্জের চানপাড়ায় কেন যাবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েটের আশপাশে তো মাদকের আখড়া। সেখান থেকে অনায়াসে মাদক সংগ্রহ করে বুয়েটের হলে যেতে পারত।
তদন্তের ক্ষেত্রে কোন বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, বেশ কয়েকটি বিষকে সামনে রেখে তদন্ত চলছে। ফারদিনের কাছের কোনো বন্ধুর সঙ্গে পূর্বশত্রুতা ছিল কি না তা জানার চেষ্টা চলছে। নারীঘটিত কোনো বিষয় আছে কি না খতিয়ে দেখছি। ফেসবুক ও ল্যাপটপের সূত্র ধরে কিছু বিষয় জানার চেষ্টা চলছে। মাদকসংশ্লিষ্ট কোনো বিষয় আছে কি না তাও জানার চেষ্টা চলছে। প্রকৃত অর্থে ফারদিনকে কোথায় হত্যা করা হয়েছে সেটি আগে বের করার চেষ্টা চলছে।
র্যাব-১ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল আব্দুল্লাহ আল মোনেম যুগান্তরকে বলেন, ফারদিন হত্যার সঙ্গে কেউ কেউ বৃহস্পতিবার রূপগঞ্জের চনপাড়ায় বন্দুকযুদ্ধে নিহত মাদক ব্যবসায়ী শাহিন মিয়া ওরফে সিটি শাহীনের যোগসূত্র মেলানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু আমাদের কাছে এ ধরনের কোনো তথ্য নেই। দুটি হত্যা মামলাসহ ২৩টি মামলার আসামি শাহিনকে আমরা আগে থেকেই চোখে চোখে রেখেছিলাম। নিছক মাদকবিরোধী অভিযানের অংশ হিসেইে আমরা চনপাড়ায় অভিযান চালিয়েছি। শাহিনকে গ্রেফতার করতে গেলে র্যাবকে লক্ষ্য করে গুলি চালাতে থাকে। আত্মরক্ষার্থে র্যাব গুলি চালালে শাহিন গুরুতর আহত হয়। পরে তার মৃত্যু হয়।
তিনটি কারণে বুশরাকে সন্দেহ করছেন উল্লেখ করে ফারদিনের বাবা বলেন, শুক্রবার বিকাল থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত আমার ছেলে বুশরার সঙ্গে ছিল। বুশরাকে সে তার মেসে পৌঁছে দিয়েছে। এর এক ঘণ্টা পর আমার ছেলে নিখোঁজ, তারপর লাশ হলো। তার মানিব্যাগ, হাতঘড়ি, মোবাইল সব আছে। তার মানে এটা ছিনতাইকারীর কোনো কাজ না। তাদের বন্ধুত্ব বা প্রেমের সম্পর্কের মধ্যে কোনো ঝামেলা চলছিল। প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে বুশরা কাউকে দিয়ে খুন করিয়েছে। দ্বিতীয় কারণ সম্পর্কে ফারদিনের বাবা বলেন, আমার ছেলে বুশরার সঙ্গে প্রায়ই হয়তো রামপুরা যেত। স্থানীয় বখাটে কেউ হয়তো বুশরাকে পছন্দ করত বা বুশরার সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে। তারাও এই হত্যাকাণ্ডটি ঘটাতে পারে।
তৃতীয় কারণ হিসাবে ফারদিনের বাবা বলেন, ফারদিন নিখোঁজের পর আমরা বাসায় থাকায় তার ল্যাপটপ ওপেন করে ফেসবুক আইডি ওপেন পাই। সেখান থেকে আমার ছোট ছেলে বুশরাকে ফেসবুক মেসেঞ্জারে নক দিই। নিখোঁজের কথাটি জানাই। কিন্তু বুশরা কোনো উত্তর দেয়নি। এরপর তার নম্বর সংগ্রহ করে অন্যভাবে ফোন করে তাকে জানানো হয়। কিন্তু সে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। তাদের চার বছরের বন্ধুত্ব, ঘনিষ্ঠতা, অথচ বন্ধুকে হারিয়ে তার কোনো প্রতিক্রিয়া নেই।
নূর উদ্দীন আরও বলেন, বুশরাকে রামপুরা থানার ওসি রফিকুল ইসলাম থানায় ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন, তখনও সে স্বাভাবিক ছিল। বন্ধুকে হারানোর কোনো অভিব্যক্তি তার মুখে ছিল না। ৭ নভেম্বর তার লাশ উদ্ধার হলো, তারপরও তার মধ্যে কোনো দুঃখবোধ দেখিনি। সে ডিবি হেফাজতে বসে বই পড়েছে, পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়েছে। এত কাছের বন্ধু, তার এমন মর্মান্তিক মৃত্যুতে বুশরা ছিল স্বাভাবিক। তার আচার-আচরণ সন্দেহজনক। তাই তাকে মামলার আসামি করা হয়েছে।
গত ৪ নভেম্বর দুপুর ৩টার দিকে ফারদিন বুয়েটের উদ্দেশে বাসা থেকে বের হন বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ফারদিন। এরপর থেকে তার কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। ৫ নভেম্বর বিকালে তার বাবা নুরুদ্দিন রামপুরা থানায় জিডি করেন। ৭ নভেম্বর সন্ধ্যায় নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে শীতলক্ষ্যা নদী থেকে নৌ-পুলিশ সদস্যরা তার লাশ উদ্ধার করে। এ ঘটনায় বৃহস্পতিবার একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হলে পুলিশ ফারদিনের বান্ধবী বুশরাকে গ্রেফতার করে ৫ দিনের রিমান্ডে নেয়।