ইসরায়েলি মানবাধিকার সংস্থা বেতসেলেম ২৭ জুলাই এক বিস্তৃত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যেখানে তারা গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধকে গণহত্যা হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। তবে, এ ধরনের একটি অভিযোগ আনতে এই বিলম্ব একটি উদ্বেগজনক বিষয়, যা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের একটি দীর্ঘস্থায়ী সমস্যাকে সামনে নিয়ে আসে। এসব পদক্ষেপ ইসরায়েলি যুদ্ধাপরাধগুলো দীর্ঘায়িত করেছে।
প্রতিবেদনটি জানায়, ইসরায়েল একটি সরকারি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে নাগরিক জীবন ধ্বংস করেছে এবং দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করেছে, যার মাধ্যমে তারা জাতিগত নিধনের ইচ্ছা ও পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছে।
এটি এক অর্থে ফিলিস্তিনিদের দীর্ঘদিনের অভিযোগের সঙ্গে মিল রেখেছে— যা হলো, ইসরায়েলের কর্মকাণ্ড গাজায় গণহত্যার সমতুল্য।
বিশেষ করে বেতসেলেম একটি ইসরায়েলি সংস্থা হওয়ায় এই প্রতিবেদন আরো গুরুত্বপূর্ণ। এটি একটি ‘ভিতরের কণ্ঠ’ থেকে উঠে আসা অভিযোগ, যা গাজায় ঘটে যাওয়া নৃশংস হত্যাকাণ্ড এবং দুর্ভিক্ষের দায় সরাসরি ইসরায়েল সরকারের ওপর চাপায়। এতে এই ভিত্তিহীন যুক্তিও ভেঙে পড়ে যে, ইসরায়েলকে গণহত্যাকারী বলা মানেই অ্যান্টি-সেমিটিজম বা ইহুদি বিদ্বেষ।
পশ্চিমা মিডিয়া এই প্রতিবেদনে বিশেষভাবে আগ্রহ দেখিয়েছে, যদিও দীর্ঘদিন ধরেই ফিলিস্তিনি নাগরিকদের সরাসরি রিপোর্ট বা তদন্ত সাধারণত উপেক্ষিত হয়ে এসেছে বা গুরুত্ব পায়নি। এই দ্বৈত মানদণ্ড মিডিয়ার ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গির একটি দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা।
ফিলিস্তিনিদের যুদ্ধাপরাধ সংক্রান্ত অভিযোগ দীর্ঘকাল ধরে মূলধারার মিডিয়া ও একাডেমিতে অবহেলিত হয়েছে। ১৯৪৮ সালের তান্তুরা গণহত্যা, ১৯৮২ সালের লেবাননে সাবরা ও শাতিলা গণহত্যা, কিংবা ২০০২ সালের পশ্চিম তীরে জেনিন গণহত্যার ঘটনাগুলো বারবার অস্বীকৃত হয়েছে বা গুরুত্ব পায়নি।
ফিলিস্তিনিদের বয়ান তখনই কিছুটা বৈধতা পায়, যখন তা কোনো ইসরায়েলি বা পশ্চিমা উৎস থেকে সমর্থন পায়।
এই দৃষ্টিকোণ থেকে, বেতসেলেমের সর্বশেষ প্রতিবেদন ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়— এত সহজ ও স্পষ্ট একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে তাদের দুই বছর সময় লাগল কেন? ইসরায়েলি মানবাধিকার সংগঠন হিসেবে তাদের সেনাবাহিনীর কর্মকাণ্ড, রাজনীতিবিদদের বক্তব্য এবং হিব্রু মিডিয়ার ওপর আরো বেশি প্রবেশাধিকার থাকার কথা। তাহলে এই সিদ্ধান্ত তারা দুমাসে নিতে পারত, দুই বছরে কেন?
এই ইচ্ছাকৃত বিলম্ব একটি বৈশ্বিক প্রবণতার অংশ, যেখানে বহু আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান, সংগঠন এবং প্রভাবশালী ব্যক্তি গণহত্যার সত্যতা মেনে নিতে বা প্রকাশ করতে রাজনীতিসচেতন হিসেবে বিলম্ব করেছে। যার ফলে গাজায় ইসরায়েলের অপরাধ আরো দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ, আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) ২০২৪ সালের ২৬ জানুয়ারি এক ঐতিহাসিক রায়ে বলেছিল যে দক্ষিণ আফ্রিকার অভিযোগের ভিত্তিতে গাজায় গণহত্যা ঘটার যুক্তিসঙ্গত প্রমাণ রয়েছে। তবুও, এতদিনেও আদালত কোনো চূড়ান্ত রায় দিতে পারেনি। যদি তারা দ্রুত রায় দিত, তবে তা ইসরায়েলের ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করত এবং হয়তো এই হত্যাযজ্ঞ বন্ধ হতো।
বর্তমানে আদালত ইসরায়েলকে নিজের বিরুদ্ধে নিজেই তদন্ত করার কথা বলেছে—যা একেবারেই অবাস্তব, বিশেষ করে যখন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তার চরমপন্থী মন্ত্রীদের আশ্বস্ত করছেন যে গাজা থেকে জনগণকে উচ্ছেদ করা হবে।
একই রকম সমালোচনা করা যায় আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি)-এর দিকেও। তারা ২০২৪ সালের ২১ নভেম্বর নেতানিয়াহু এবং তার সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রীর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করলেও আজ পর্যন্ত কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। বরং আদালতের প্রধান কৌঁসুলি করিম খান এখন মার্কিন সরকার ও মিডিয়ার চাপে পড়েছেন, শুধুমাত্র তার সাহসিক তদন্ত চালিয়ে যাওয়ার জন্য।
এমনকি ব্যক্তিরাও—যারা বিপ্লবী রাজনীতির মুখ বলে পরিচিত—তাদের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। মার্কিন কংগ্রেস সদস্য আলেকজান্দ্রিয়া ওকাসিও-কার্তেজ গত বছরের ২২ মার্চ স্পষ্ট করে বলতে অস্বীকার করেছিলেন যে গাজায় গণহত্যা হচ্ছে। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি একটি সম্ভাব্য গণহত্যার ঘটনা উদ্ঘাটন হতে দেখছি,’ কিন্তু এখনো নিজে শব্দটি ব্যবহার করতে প্রস্তুত নন।
সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স, যিনি অনেক সময় নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে জোরালো বক্তব্য দিয়েছেন—৩১ জুলাই এক সাক্ষাৎকারে তাকে ‘ঘৃণিত মিথ্যাবাদী’ বলে উল্লেখ করেন—তিনিও শুরু থেকে নানা নৈতিক বিচ্যুতির শিকার হয়েছেন। যখন অপেক্ষাকৃত অনেক কম র্যাডিক্যাল রাজনীতিক ‘গণহত্যা’ শব্দটি ব্যবহার করেন, তখন স্যান্ডার্স আয়ারল্যান্ডের এক বক্তৃতায় বলেন এই শব্দটি তাকে ‘বমি বমি ভাব এনে দেয়’, এবং সবাইকে ‘সাবধান’ হয়ে শব্দটি ব্যবহারের অনুরোধ করেন।
এসব দেরি, দ্বিধা এবং রাজনীতিক অপারগতা শুধু নৈতিক ব্যর্থতা নয়—এগুলো ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডে সরাসরি প্রভাব ফেলেছে। বিশ্বব্যাপী সরকারের, আন্তর্জাতিক আদালতের, মানবাধিকার সংগঠনের এবং মিডিয়ার সময়মতো হস্তক্ষেপ হলে যুদ্ধের গতিপথ পাল্টে যেত। হাজার হাজার প্রাণ বাঁচানো যেত।
এই রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ এবং ন্যায়বিচার প্রদানে বিলম্বই ইসরায়েলকে সময় ও সুযোগ দিয়েছে গণহত্যা চালিয়ে যেতে। তারা জানে, বিশ্ব এখনো দ্বিধায়। এই আইনি ও নৈতিক অনিশ্চয়তার সুযোগে, ইসরায়েল নির্বিচারে গাজায় হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে।
এই অবস্থা পাল্টাতে হবে। ফিলিস্তিনিদের দৃষ্টিভঙ্গি, তাদের যন্ত্রণা এবং সত্যকে কোনো ইসরায়েলি বা পশ্চিমা উৎসের অনুমোদনের অপেক্ষা ছাড়াই স্বীকৃতি দিতে হবে। তাদের কণ্ঠকে অগ্রাধিকার দিতে হবে—শুধু রাজনৈতিক বক্তৃতায় নয়, বাস্তবিকভাবে, প্রতিদিন।
আর যারা এখনো পর্যন্ত গণহত্যার বিষয়ে স্পষ্ট অবস্থান নেননি—তাদের কোনো যুক্তিই আর গ্রহণযোগ্য নয়। ইতিহাস তাদের বিচার করবে—আর গাজার সেই সমস্ত মা-বাবার আর্তনাদ, যারা শেষ পর্যন্ত নিজেদের সন্তানকে ইসরায়েলি বোমা আর গুলির হাত থেকে বাঁচাতে পারেননি, তাঁদের কান্নাই সেই বিচারকের আসনে বসবে।