জলবায়ু পরিবর্তনসহ নানা কারণে বাংলাদেশে এখন ছয় ঋতুর বৈচিত্র্য তেমন দেখা না গেলেও প্রকৃতি এখন শীতের বার্তা দিচ্ছে। বিশেষ করে ঢাকার বাইরে ও উত্তরের জেলাগুলোতে শীতের আমেজ শুরু হয়ে গেছে। দিনভর আবহাওয়া গরম থাকলেও বিকাল থেকে সকাল পর্যন্ত ঢেকে যাচ্ছে কুযাশায়। সেই সঙ্গে দেখা দিচ্ছে শীতজনিত মৌসুমি রোগব্যাধি। বিশেষ করে কম রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন শিশু ও বয়স্করা ঠান্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভিড় করছেন। রাজধানী ঢাকা ছাড়াও জেলা-উপজেলার একাধিক চিকিৎসক-নার্স, রোগী ও অভিভাবকের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।
বিশেষজ্ঞরা যুগান্তরকে বলছেন, দক্ষিণ গোলার্ধের বাতাসের গতিপথ পরিবর্তিত হয়ে বাংলাদেশে শীত আগমনের আভাস দিচ্ছে উত্তরের বাতাস। ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে না পেরে অনেকেই কমবেশি ঠান্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। অনেকের কাশি, গলা ব্যথা, নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্ট, জ্বর ও ভাইরাল ডায়রিয়া হচ্ছে। বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন নবজাতক, শিশু ও বৃদ্ধরা। এই রোগীদের বড় একটি অংশ উত্তরাঞ্চলের।
মঙ্গলবার সরেজমিন রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের তৃতীয়তলার ৩১৪ নম্বর নন-পেয়িং শিশু ওয়ার্ডের ৮টা বিছানার বিপরীতে ১২ জন শিশুকে ভর্তি থাকতে দেখা যায়। কর্তব্যরত চিকিৎসক-নার্সরা যুগান্তরকে জানান, এতদিন ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি থাকলেও এখন ঠান্ডাজনিত রোগী আসছে। প্রয়োজনের তুলনায় শয্যা কম থাকায় এক বিছানায় দুজনকে ভর্তি করা হচ্ছে। শিশু ওয়ার্ডের ১৮ নম্বর বিছানায় চিকিৎসা নিতে দেখা যায় সাত মাস বয়সি আসমা এবং দুই মাস বয়সের শিশু ওমর ফারুককে। দুজনকে দুটি সিলিন্ডারে অক্সিজেন ও সঙ্গে স্যালাইন দেওয়া হচ্ছিল।
আসমার মা তাসনূর বেগম যুগান্তরকে বলেন, সপ্তাহখানেক আগে মেয়ের হঠাৎ জ্বর আসে। সেই সঙ্গে শুরু হয় সর্দি, কাশি ও শ্বাসকষ্ট। স্থানীয় ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনে খাওয়ানোর পরও ভালো হচ্ছিল না। সোমবার লক্ষ্মীপুর জেলা সদর হাসপাতালে ভর্তি করি। সেখানকার চিকিৎসকরা এনআইসিইউ (নিউনেটাল ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট) সেবা দরকার বলে জানান। তখন দ্রুত মাইজদী বেসরকারি ফাহিম হাসপাতালের এনআইসিইউতে ভর্তি করি। সেখানেও পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় পরদিন ঢাকায় রেফার করা হয়। এবার অ্যাম্বুলেন্সে অক্সিজেন সাপোর্ট নিয়ে আজ সকালে এখানে ভর্তি করি। কিন্তু শয্যা সংকটে এক বিছানায় দুজনকে রাখা হয়েছে।
মাথায় ক্যানুলা ও মুখে অক্সিজেন মাস্ক পরানো অবস্থায় একই বিছানায় চিকিৎসাধীন ওমর ফারুকের নানি খাদিজা বেগম বলেন, নির্ধারিত সময়ের আগেই তার নাতি জন্ম নিয়েছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, হার্ট ও লাং তেমন ডেভেলপমেন্ট হয়নি। কিছুদিন ধরে সকাল ও রাতে শীতের আমেজ থাকায় শ্বাসকষ্ট ও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে। স্থানীয় চিকিৎসকের পরামর্শে এখানে ভর্তি করেছি।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের শিশু বিভাগের মেডিকেল অফিসার ডা. আমিনুল ইসলাম হিমেল যুগান্তরকে বলেন, শীতে সর্দি-কাশি, নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া, হাঁপানি, টনসিলাটাইসিস, ব্রঙ্কিওলাইটিস, সাইনোসাইটিস, সমস্যা দেখা দেয়। এবার ডেঙ্গুর পরেই শিশুরা শীতজনিত রোগে ভুগছে। শিশু বহির্বিভাগে রোগী বাড়ছে। যাদের অধিকাংশই ঠান্ডাজনিত রোগের কথা বলছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে চিকিৎসা দিয়ে বাড়ি পাঠানো হচ্ছে। নিউমোনিয়াজনিত জটিলতা বেশি যাদের, তাদের ভর্তি করা হচ্ছে। ভর্তি রোগীদের বেশিরভাগই ঢাকার আশপাশের জেলা-উপজেলা থেকে আসছে।
একইদিন বাংলাদেশ শিশু হাসপাতালের জরুরি ও বহির্বিভাগে রোগীদের ভিড় দেখা যায়। হাসপাতালের বহির্বিভাগে দেড় বছর বয়সি এক শিশুর কান্না থামানোর চেষ্টা করছিলেন মা ও খালা। জানতে চাইলে শিশুটির খালা তাহমিনা পারুল জানান, তারা সাভার থেকে এসেছেন। গত কয়েকদিন আগে ঠান্ডা লেগে বোনের মেয়ের কোল্ড ডায়রিয়া হয়। ওষুধ ও স্যালাইন খাওয়ানোর পর ডায়রিয়া সারলেও কাশি, সর্দি ও শ্বাসকষ্ট দেখা দিয়েছে। সঙ্গে জ্বরও আছে। স্থানীয় চিকিৎসকের পরামর্শে এখানে নিয়ে এসেছেন।
শিশু হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ডা. ফারহানা আহমেদ স্মরণী যুগান্তরকে বলেন, এখন শিশু হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর চাপ কমছে। কিন্তু শীতকালীন রোগে আক্রান্ত রোগী আসতে শুরু করছে। বর্তমানে শীতজনিত ফ্লু ও আরএস ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছে। অনেকে ইনফ্লুয়েঞ্জা, নিউমোনিয়া, রেসপিরেটরি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন, অ্যাজমাজনিত পালমোনারি প্রবলেম, জ্বর ও ডায়রিয়া নিয়ে আসছে। তবে সংখ্যাটা খুব বেশি নয়। অনেককে অবজারভেশনে রাখা হচ্ছে। পরিস্থিতি বুঝে বহির্বিভাগে চিকিৎসা দিয়েই বাড়িতে পাঠানো হচ্ছে। শিশু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. জাহাঙ্গীর আলম যুগান্তরকে বলেন, শীত-গরম উভয় ঋতুর শুরুতেই শিশুরা মৌসুমি রোগে আক্রান্ত ঝুঁকিতে থাকে। এবারও ঠান্ডাজনিত রোগ নিয়ে শিশু হাসপাতালে রোগী আসতে শুরু করছে। তবে সেই সংখ্যা খুব বেশি নয়। সিজনাল রোগের শিকার শিশুদের জটিলতা কম থাকায় ভর্তি হচ্ছে কম। ভাইরাসজনিত সর্দি-কাশি, জ্বর, নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া, ব্রঙ্কিওলাইটিস দেখা গেছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের চিকিৎসকরা জানান, ঢাকা মেডিকেলের শিশু বহির্বিভাগে দৈনিক গড়ে ৫০০-এর মতো রোগী আসছে। অনেক শিশুর অভিভাবক ঠান্ডাজনিত রোগের কথা বলছে। যাদের জটিলতা বেশি তাদের ভর্তি করা হচ্ছে। অভিভাবকেদের ব্যক্তিগত সচেতনতা। স্বাস্থ্যবিধি মানা। শিশু ও বয়স্কদের প্রতি বাড়তি যত্ন নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।