আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে পরিকল্পিত ছকে সাজানো হয়েছে মাঠ প্রশাসন। তফশিল ঘোষণার আগেই সব চূড়ান্ত করা হয়েছে। তফশিলের পর নির্বাচন কমিশন যদি দুই দফা মাঠ প্রশাসনে রদবদল করে, তাতেও কোনো সমস্যা হবে না। আসন্ন নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিলে মাঠ প্রশাসনে ব্যাপক রদবদল হতে পারে। অল্প সময়ের মধ্যেই মাঠ সাজাতে পারবে ইসি। এ দিকটি মাথায় রেখেই কর্মকর্তাদের তালিকা তৈরি করে রাখা হয়েছে। বিএনপি নির্বাচনে না এলে খুব সামান্য রদবদলেই নির্বাচন শেষ হতে পারে।
জানা যায়, সরকার বেশ আগে থেকেই পরিকল্পিতভাবে প্রশাসন সাজানোর কাজ হাতে নিয়েছে। এর অংশ হিসাবে ১১ মাসের ব্যবধানে সরকার ৯ বিভাগীয় কমিশনার, ১৮ জন অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার, ৬৮ নতুন জেলা প্রশাসক (ডিসি), ১৪৫ জন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এডিসি), ২২১ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়েছে। পুলিশ প্রশাসনের ১৬ জন ডিআইজি, ৩৫ জন অতিরিক্ত ডিআইজি এবং ২৮ জেলার এসপি পদে রদবদল করা হয়েছে। এছাড়া ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকার অধিকাংশ থানার ওসি পদে রদবদল করা হয়েছে। এছাড়া ডিসির ফিটলিস্ট চূড়ান্ত করে প্রশাসন ক্যাডারের ২৪, ২৫ এবং ২৭ ব্যাচের আরও শতাধিক কর্মকর্তাকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। নিরপেক্ষতা প্রমাণে ভোটে অংশ নেওয়া অন্যান্য দলের প্রার্থীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতেও নির্বাচন কমিশনের সুপারিশে রদবদল হবে বলে জানা গেছে। প্রশাসনের অনুকরণে পুলিশ প্রশাসনেও বিকল্প কর্মকর্তা প্রস্তুত রাখা আছে বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) রিটার্নিং অফিসার, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকদের (এডিসি) সহকারী রিটার্নিং অফিসার এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) সহকারী রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব দিয়ে আদেশ জারি করেছে নির্বাচন কমিশন। মাঠে পুলিশ কর্মকর্তারা আইনশৃঙ্খলাসংক্রান্ত বিষয়গুলো দেখভাল করেন। সুতরাং নির্বাচনের মাঠে ডিসি, এসপি, ইউএনও, এএসপি এবং থানার ওসিরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় থাকেন। সরকারি কিংবা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তারা প্রিসাইডিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং কলেজের শিক্ষকরা পোলিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া নির্বাচনি আচরণবিধি দেখভালের জন্য ক্ষমতা দিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে প্রশাসন বিশ্লেষকদের কেউ কেউ বলছেন অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন না হলে যে যেখানে আছে থাকুক। আর নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হলে ভিন্নকথা। পক্ষান্তরে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা বলছেন, এসব প্রশাসনে রুটিন বদলি। এসবের সঙ্গে দলীয় বিবেচনা কিংবা নির্বাচনের কোনো সম্পর্ক নেই।
জানতে চাইলে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার যুগান্তরকে বলেন, সত্যিকার অর্থে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে কি না, সেটি বড় প্রশ্ন। যদি নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হয়, তাহলে প্রশাসনে রদবদলের দরকার আছে। আর যদি নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক না হয়, তাহলে ডিসি, এসপিসহ প্রশাসনে পরিবর্তন করা বা না করা একই কথা। পরিবর্তন করে তেমন কোনো লাভ হবে না।
জানতে চাইলে সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান যুগান্তরকে বলেন, সরকারের অধীনে নির্বাচন হচ্ছে। সুতরাং সরকার যাদের ডিসি, এসপি নিয়োগ দিয়েছে, তাদের পরিবর্তন করার দরকার নেই। কোনো কারণ ছাড়া একজন কর্মকর্তাকে কেন পরিবর্তন করতে হবে। তিনি আরও বলেন, সংলাপ হলে, প্রশাসনে পরিবর্তিত পরিস্থিতি তৈরি হলে বিভিন্ন পদে রদবদলের সম্ভবনা ছিল। এখন নেই। তিনি আরও বলেন, তবে ডিসি কিংবা এসপি পদে রদবদল করতে পারে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন কমিশন যদি মনে করে, পুল থেকে নতুন ডিসি-এসপি দিয়ে নির্বাচন করব, তাহলে সেটি হবে গুড প্র্যাকটিস। জনগণের আস্থা অর্জনের জন্য নির্বাচন কমিশন তা করতে পারে। তবে সেই রিস্ক নির্বাচন কমিশন নেবে কি না, সেটি তাদের বিষয়।
জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মেজবাহ উদ্দীন চৌধুরী সোমবার যুগান্তরকে বলেন, প্রশাসন এখন নির্বাচন কমিশনের অধীনে। নির্বাচন কমিশন যেভাবে যে নির্দেশনা দেবে, আমরা তা প্রতিপালন করব। এর বাইরে তিনি কোনো মন্তব্য করতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
তবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুগান্তরকে বলেন, যাদের বদলির সময় হয়, তাদের প্রত্যাহার করে নতুন ডিসি নিয়োগ দেওয়া হয়। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের মধ্যে যারা এডিসি হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেন, তাদের প্রত্যাহার করে নতুন কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়। এসব রদবদলের সঙ্গে নির্বাচনের কোনো সম্পর্ক নেই। রদবদল প্রশাসনের রুটিন কাজ। মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী কিংবা সচিবদের পিএসদের মধ্য থেকে কেন ডিসি নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন হলো, এর বাইরে থেকে কি দেওয়া যেত না-এমন প্রশ্নের জবাবে ওই কর্মকর্তা বলেন, মেধাবী কর্মকর্তাদের মন্ত্রীদের পিএস হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়। আবার ডিসি হিসাবে নিয়োগের আগেও একবার তাদের যোগ্যতা যাচাই করা হয়। সুতরাং তারা মেধাবী এবং বিশেষ যোগ্যতাসম্পন্ন কর্মকর্তা। তাদের দলীয় বিবেচনায় নিয়োগের দাবি করার সুযোগ নেই।
সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক একেএম শহীদুল হক যুগান্তরকে বলেন, নির্বাচন কমিশন চাইলে প্রশাসনে রদবদল করতেই পারে। তবে ঢালাওভাবে না করে যাদের বিরুদ্ধে অতিমাত্রায় দলীয় সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে, তাদের বদলি করা উচিত। এছাড়া যারা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত-এমন কর্মকর্তাদের মাঠ থেকে সরানো দরকার। তিনি আরও বলেন, এসব করতে পারে নির্বাচন কমিশন। তারা সিদ্ধান্ত নেবে। তিনি ঢালাওভাবে রদবদলের বিপক্ষে মত দেন।
ডিসি পদে নিয়োগ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হয় বেশি। সর্বশেষ গত জুলাইয়ে নিয়োগে ডিসিদের মধ্যে আটজনই বিভিন্ন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী ও সচিবের একান্ত সচিব (পিএস)। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, জনপ্রশাসন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে কর্মরতদের মধ্য থেকে ১১ জনকে সর্বশেষ জেলা প্রশাসক করা হয়েছে। জুলাইয়ে দেওয়া সর্বশেষ ডিসি পদে নতুন করে ২৭তম বিসিএস-এর কর্মকর্তাদেরও পদায়ন করা হয়। এছাড়া ২৪ ও ২৫তম বিসিএস-এর কিছুসংখ্যক কর্মকর্তাও ডিসি হিসাবে মাঠে আছেন। তবে সবাই যে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ পেয়েছেন, এমন নয়। অনেকে যোগ্যতায়ও ডিসি হিসাবে নিয়োগ পেয়েছেন। এছাড়া ডিসির ফিটলিস্টে ২৪, ২৫ ও ২৭ ব্যাচের আরও শতাধিক কর্মকর্তার নাম রয়েছে। পরিস্থিতি বুঝে তাদের যে কোনো সময় সরকার নিয়োগ দিতে পারবে।