২৭ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার, ১২:৫৪:২২ অপরাহ্ন
ফিরে দেখাভয়ে-ভাবনায় রাজনীতির অস্থিরতার বছর
  • আপডেট করা হয়েছে : ৩১-১২-২০২৩
ফিরে দেখাভয়ে-ভাবনায় রাজনীতির অস্থিরতার বছর

ক্ষমতা ধরে রাখা আর ক্ষমতায় যাওয়া নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিরোধী বিএনপির দ্বৈরথে ‘কখন জানি কী হয়’—এই ভয়ে-ভাবনায় কেটে গেল বছরটা। তবে শঙ্কা যতটা ছিল, সেই অর্থে শান্তি ততটা বিঘ্নিত হয়নি। যদিও ভোট মুখে নিয়ে আসা নতুন বছরটাও খুব স্বস্তির সঙ্গে শুরু করা যাচ্ছে না।


টানা চতুর্থবার ক্ষমতায় যেতে চায় আওয়ামী লীগ। সে জন্য নিজেদের চাওয়া অনুযায়ী সাংবিধানিক কাঠামোতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে বছরজুড়ে সচেষ্ট ছিল দলটি। বিপরীতে সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে সমমনাদের সঙ্গে নিয়ে নানাভাবে আন্দোলনের ধারা অব্যাহত রেখেছে বিএনপি।


বিএনপির এই আন্দোলনের সঙ্গে আগের বছরে র‍্যাবের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পরে এ বছরে দেশটির পক্ষ থেকে আসা ভিসা নীতি লক্ষ্যপূরণের পথে চ্যালেঞ্জের মুখেই ফেলে আওয়ামী লীগকে। বছরের মাঝামাঝি এসে এক দফার ঘোষণা দিয়ে বিএনপির নেতৃত্বে বিরোধীদের আন্দোলনের নতুন যাত্রা শুরু হলে বেশ চাপেই পড়ে সরকার। অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত রাজপথের লড়াইয়ে দুই পক্ষই ছিল সমানে সমান।


তবে ২৮ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশকে ঘিরে প্রাণঘাতী সংঘর্ষের পর পাল্টে যায় দৃশ্যপট। গণহারে গ্রেপ্তার-মামলায় দলের নেতা-কর্মীদের নিষ্ক্রিয়তায় এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি বিএনপি ও বিরোধীরা। দফায় দফায় হরতাল-অবরোধ ডেকেও মাঠ গরম করতে পারছে না তারা। এমনকি অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণা এলেও তার বাস্তবায়ন নিয়ে রয়েছে সংশয়। রাজনীতির মাঠে ক্ষমতাসীনেরা দৃশ্যত এগিয়ে থাকলেও মাঠ ছাড়েনি বিরোধীরা। 


আগামী ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দ্বারপ্রান্তে এসে অতীতের মূল্যায়ন এবং ভবিষ্যৎকে সামনে রেখে নানা কথা বলেছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, ক্ষমতায় যাওয়া নিয়ে দেশে যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, সেখানে মানবিকতা, সহিষ্ণুতার পরিবর্তে সংঘাত ও সহিংসতা দানা বেঁধেছে। বিদায়ী বছরের রাজনীতির পথ পরিক্রমায় এই প্রবণতা আরও প্রকট হয়েছে। সেই পথ থেকে ফিরে আসতে দুস্তর পথ পাড়ি দিতে হবে।


ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে দুই পক্ষের অমীমাংসিত লড়াইকে সামনে এনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘২০২৩-এ এসে রাজনৈতিকভাবে আমরা আরও পেছনে ফিরে গেছি। চারটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে মোটামুটি শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর হলো। সেই জায়গা থেকে আমরা পিছিয়ে গেলাম। ২০২৩ আমাদের সেই অসম্পূর্ণতাকে আরও শক্তিশালী করল।’ তিনি আরও বলেন, ‘রাজনীতিতে সহিষ্ণুতার জায়গাটা আরও নষ্ট হয়ে গেছে। রাজনৈতিক দলগুলো যদি এটা উপলব্ধি না করে, তাহলে আমরা তিমিরেই থেকে যাব।’ 


বিএনপিবিহীন আগামী ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পরে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে বলে মনে করছেন অনেকে। এর ফলে দেশের রাজনীতি দীর্ঘমেয়াদি অনিশ্চয়তার পথে যেতে পারে বলে মনে করছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক শামছুল আলম। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘দুই পক্ষই যে যার অবস্থানে অনড় রয়েছে। এর ফলে সমাধানের পথ কঠিন হয়ে যাচ্ছে এবং সংঘাতের আশঙ্কা ঘনীভূত হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে দেশের রাজনীতি একটা অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে যাচ্ছে।’ 

সব দিক বিবেচনা করে আগামী দিনের রাজনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশার কথা শোনালেন বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সাবেক অধ্যাপক দিলারা চৌধুরীও। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘২০২৩-এর রাজনীতি আমাদের সমাজকে যে অবস্থায় নিয়ে গেছে, তাতে রাজনীতির জন্য ভবিষ্যতে ভালো কিছু দেখতে পাচ্ছি না।’ 


যদিও তেমনটা না হওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন কেউ কেউ। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক কে এম মহিউদ্দিন মনে করেন, ‘সহিংস পরিস্থিতি সৃষ্টির আশঙ্কা খুবই কম।’ তাঁর ভাষায়, ‘বিএনপি চেষ্টা করবে। কিন্তু তারা সেটা পারবে কি না, সে নিয়ে সন্দেহ আছে। কারণ, তারা জনগণকে সম্পৃক্ত করতে পারেনি।’


অধ্যাপক মহিউদ্দিন মনে করেন, ২০২৩ সাল দুই দলের জন্যই চ্যালেঞ্জিং ছিল। আওয়ামী লীগ মোকাবিলা করতে পারলেও চ্যালেঞ্জ উতরাতে পারেনি বিএনপি। তবে নির্বাচনের পর দাতাগোষ্ঠী কোনো চাপ প্রয়োগ করলে তা কীভাবে সরকার মোকাবিলা করে, সেই চ্যালেঞ্জটা আসতে পারে বলেও মনে করছেন তিনি। 


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক গোবিন্দ চক্রবর্তী বলেন, ‘সবার অংশগ্রহণে একটা নির্বাচন হবে—এমন প্রত্যাশা থাকলেও তা শেষ পর্যন্ত হয়নি। বিদায়ী বছরে দেশের রাজনীতিতে অস্থিরতা ছিল। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনকে ঘিরে সুস্পষ্ট ছিল রাজনৈতিক বিভাজন।’


রাজনীতিতে সংঘাত-সহিংসতা নয়, তাই নতুন বছরে শুভসূচনারও আশা করছেন কেউ কেউ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘নির্বাচনে সব পক্ষ যোগ দেয়নি। ভোটটা সুন্দর হচ্ছে না। তবে নির্বাচনটা যদি অবাধ, নিরপেক্ষ এবং সহিংসতামুক্ত করা যায়, তাহলে হয়তো স্থিতিশীলতা আসবে। এর মধ্য দিয়ে নতুন বছরে একটা শুভসূচনা হতেও পারে।’


শেয়ার করুন