২৭ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার, ১০:৪৬:২৫ অপরাহ্ন
আ.লীগের কোন্দল ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৫-০১-২০২৪
আ.লীগের কোন্দল ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে

নির্বাচনের পর থেকেই সারা দেশে আওয়ামী লীগ ও দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থীদের অনুসারী কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ লেগে আছে। ঝিনাইদহে নৌকার সমর্থক ও নোয়াখালীতে স্বতন্ত্র প্রার্থীর এজেন্টকে কুপিয়ে হত্যা করেছে প্রতিপক্ষরা। বিএনপি ও তাদের মিত্রদের বর্জনের মুখে সংসদ নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করতে দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ করে দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। এই সিদ্ধান্ত এখন দলটির নীতিনির্ধারকদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। জাতীয় সংসদ নির্বাচন-পরবর্তী এক সপ্তাহে দেশের বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ ও বিবাদের ঘটনা দেখে আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন দলটির নীতিনির্ধারকরা। 


এদিকে ভোটের দিন প্রকাশ্যে ব্যালটে সিল মারাসহ কারচুপির অভিযোগ তুলেছেন নির্বাচনে পরাজিত প্রার্থীদের অনেকে। তাদের মধ্যে আওয়ামী লীগ ও দলটির স্বতন্ত্র ছাড়াও জাতীয় পার্টি এবং সরকারের সমর্থক হিসাবে পরিচিত নতুন রাজনৈতিক দলগুলোর প্রার্থীও রয়েছেন। তারা নির্বাচনের দিন থেকেই নানা অনিয়মের অভিযোগ তুলতে শুরু করেন। শনিবার পর্যন্ত আওয়ামী লীগ, দলীয় স্বতন্ত্র, নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করা ১৪ দলের শরিক ও জাতীয় পাটির কমপক্ষে ২৬ প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটগ্রহণের দিন কারচুপি এবং অনিয়মের অভিযোগ তুলেছেন। আওয়ামী লীগের ৪ জন, শরিক দলের (নৌকা প্রতীকের) ২ জন এবং আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র ১৬ জন প্রার্থী এই তালিকায় রয়েছেন। বাকিরা অন্য রাজনৈতিক দলের। 


কয়েকজন প্রার্থী নির্বাচন কমিশনে অনিয়ম-কারচুপির বিষয়ে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। শনিবার রাতে নোয়াখালী-২ আসনে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী আতাউর রহমান ভূঁইয়ার নির্বাচনি এজেন্ট শাহেদুজ্জামান পলাশকে কুপিয়ে হত্যা করেছে প্রতিপক্ষ দুর্বৃত্তরা। সোনাইমুড়ী উপজেলার নাটেশ্বর ইউনিয়নের পূর্ব মির্জানগর গ্রামের এই হত্যাকাণ্ডকে নির্বাচনি বিরোধ বলে দাবি করেছেন আতাউর রহমান ভূঁইয়া। তবে 

প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের বিজয়ী প্রার্থী (সংসদ-সদস্য) মোরশেদ আলম এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। 

ঝিনাইদহে নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতায় পরাজিত নৌকা প্রার্থী তাহজীব আলম সিদ্দিকীর কর্মী বরুণ কুমার ঘোষকে কুপিয়ে হত্যা করেছে প্রতিপক্ষ সন্ত্রাসীরা। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ঝিনাইদহ শহরের ঘোষপাড়া এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। বরুণ শহরের ঘোষপাড়া এলাকার নরেন ঘোষের ছেলে। স্বজনদের দাবি, ঝিনাইদহ-২ আসনের নৌকা প্রতীকের প্রার্থী তাহজীব আলম সিদ্দিকীর পক্ষে বরুণ নির্বাচন করেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী নাসের শাহরিয়ার জাহেদীর লোকজন তাকে কুপিয়ে হত্যা করেছে। আওয়ামী লীগের প্রার্থী তাহজীব আলম সিদ্দিকী সাংবাদিকদের বলেন, বরুণ নৌকার কর্মী ছিলেন। তিনি ভোটের আগে তার কাছে এসে জানিয়েছিলেন, একটি বিশেষ মহল তাকে নৌকার ভোট না করতে হুমকি-ধমকি দিচ্ছে। তখন ভয়ের কিছু নেই বলে বরুণকে আশ্বস্ত করেছিলেন তিনি।


কুষ্টিয়া-৪ আসনে নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতায় আহত হয়েছে ৬ জন। এদের মধ্যে দুজনকে মাথায় ও কোমরে কুপিয়ে আহত করা হয়েছে। কুমারখালীতে কয়েকটি স্থানে সংঘর্ষে তারা আহত হন। কুষ্টিয়া-৪ (কুমারখালী ও খোকসা) আসনের বিজয়ী আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী আবদুর রউফ ও পরাজিত দলীয় প্রার্থী সেলিম আলতাফ জর্জের সমর্থকদের মধ্যে এসব সংঘর্ষ হয়।


খুলনা-৪ আসনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী ছিলেন শিল্পপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী। তার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী এসএম মোর্তজা রশিদী দারা। তিনি (দারা) আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ-সদস্য মোস্তফা রশিদী সুজার ভাই। মোর্তজা রশিদী দারার হয়ে নির্বাচনে কাজ করেছিলেন কুদলা গ্রামের রিলি বেগম ও তার স্বামী মোহাম্মদ এসকেন্দ শেখ। নির্বাচনের দিন ভোট গণনা শুরুর কিছুক্ষণ পর তাদের ওপর হামলা হয়। এতে এসকেন্দ শেখ ও তার স্ত্রী রিলি বেগম আহত হন।


খুলনা-৫ আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেন নারায়ণ চন্দ্র চন্দ। এ আসনে ঈগল প্রতীকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন ফুলতলা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান শেখ আকরাম হোসেন। নির্বাচনে আকরাম হোসেনের হয়ে কাজ করেছিলেন শোভনা ইউনিয়নের আবদুর রহিম ও তার স্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিন। ভোটের পরদিন সোমবার আবদুর রহিমের বাড়িতে হামলা করে নৌকার সমর্থকরা। তারা আবদুর রহিমকে বাড়িতে না পেয়ে তার স্ত্রীকে মারধর করে। সাবিনা ইয়াসমিন বর্তমানে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।


স্বতন্ত্র প্রার্থী আকরাম হোসেন সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করে বলেন, নির্বাচনের পর ডুমুরিয়ার বিভিন্ন এলাকায় তার সমর্থক নেতাকর্মীদের ওপর একের পর এক হামলা হচ্ছে। বাড়িঘর ভাঙচুর করা হয়েছে। মানুষ ভয়ে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। 


নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতার ঘটনায় প্রতিকার চেয়ে শনিবার সিরাজগঞ্জ-৫ আসনে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী সাবেক মন্ত্রী আবদুল লতিফ বিশ্বাস সংবাদ সম্মেলন করেছেন। বেলকুচির কামারপাড়া মহল্লায় নিজ বাড়িতে এই সংবাদ সম্মেলনে তিনি নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতা বন্ধের দাবি জানান। তিনি বলেন, ভোটের পরে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আবদুল মমিন মন্ডলের ছত্রছায়ায় তার কর্মী-সমর্থকদের ওপর হামলা হয়েছে। 


হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত সবাই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী। চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে নির্বাচন-পরবর্তী হামলা, সহিংসতা অব্যাহত রয়েছে। ভয়ে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী ডা. জামাল উদ্দিন চৌধুরীর সমর্থকরা বাড়িঘর ছেড়ে চট্টগ্রামে পাড়ি জমিয়েছেন। ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগ, যুবলীগসহ বিভিন্ন পর্যায়ের ৩৬ নেতাকর্মীর নামে মামলা করা হয়েছে। জরুরি অবস্থা বিবেচনায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে সন্দ্বীপে। শুক্রবার থেকে চট্টগ্রাম জেলা গোয়েন্দা পুলিশের একাধিক টিম সন্দ্বীপে অভিযান শুরু করেছে। এসব অভিযানে বেশ কয়েকজন সন্ত্রাসী ও নৌকার সমর্থক গ্রেফতার হলেও ওপর মহলের চাপে তাদের অনেকেই মুক্তি পেয়েছে। এসব কারণে সন্দ্বীপজুড়ে বিরাজ করছে থমথমে অবস্থা। 


নওগাঁ-১ আসনে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী খালেকুজ্জামান তার কর্মীদের মারধর, বাড়িঘর ও দোকানপাটে হামলার অভিযোগ করেছেন। এ আসন থেকে নির্বাচিত সংসদ-সদস্য ও খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের অনুসারীরা এসব হামলা চালিয়েছেন বলে তার দাবি। শুক্রবার সকালে নওগাঁ শহরের একটি রেস্তোরাঁয় সংবাদ সম্মেলন করে এসব অভিযোগ করেন স্বতন্ত্র প্রার্থী খালেকুজ্জামান। নিয়ামতপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য খালেকুজ্জামান এবারের নির্বাচনে স্বতন্ত্র (ট্রাক) প্রার্থী হিসেবে অংশ নিয়ে পরাজিত হয়েছেন।


রংপুর-২ (বদরগঞ্জ-তারাগঞ্জ) আসনের ভোট রাত ৩টার দিকে হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী ও কৃষক লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বিশ্বনাথ সরকার ওরফে বিটু। নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পর শনিবার বিকালে বদরগঞ্জের মোস্তফাপুর সরকারপাড়া গ্রামে নিজ বাড়িতে কর্মী সমাবেশে তিনি এ অভিযোগ করেন। বিশ্বনাথ সরকার ট্রাক প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেন। এ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আবুল কালাম মো. আহসানুল হক ওরফে ডিউক চৌধুরী নির্বাচিত হয়েছেন। নাটোর-১ আসনে আওয়ামী লীগের পরাজিত প্রার্থী শহিদুল ইসলাম অভিযোগ করে বলেন, প্রশাসনের যোগসাজশে নৌকার জয় ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। 


বৃহস্পতিবার দুপুরে বাগাতিপাড়ায় নিজ বাড়িতে সংবাদ সম্মেলন করেন শহিদুল ইসলাম। শহিদুল ইসলামকে ২ হাজার ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম (ঈগল প্রতীক)। তিনি (আবুল কালাম) সাবেক সংসদ-সদস্য এবং নাটোর জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। ভোটের দুই দিন পর সংবাদ সম্মেলন করে মাদারীপুর-৩ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আবদুস সোবহান গোলাপ অভিযোগ করে বলেন, সূক্ষ্ম কারচুপি ও ষড়যন্ত্রের কারণে তিনি পরাজিত হয়েছেন। ঢাকা-৪ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সানজিদা খানম ৮ জানুয়ারি প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) বরাবর পৃথক আবেদনে একই অভিযোগ করেন। মঙ্গলবার হাইকোর্টে রিট করেন তিনি। ওই আসনে জয় পেয়েছেন আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী ড. মো. আওলাদ হোসেন। 


নির্বাচনের দুই দিন পর মঙ্গলবার এক কর্মী সভায় মানিকগঞ্জ-২ আসনের আওয়ামী লীগ প্রার্থী মমতাজ বেগম অভিযোগ করেন, কয়েকটি কেন্দ্রে কারচুপি করে তাকে হারানো হয়েছে। বরগুনা-১ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু পরাজিত হওয়ার পর কারচুপি ও অনিয়মের অভিযোগ করেছেন। পাবনা-৩ আসনে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী ও জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য আবদুল হামিদ কেন্দ্র দখল, ভোট কারচুপিসহ অনিয়মের নানা অভিযোগ করেছেন।


অন্যদিকে আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকদের বিরুদ্ধে ভোটারদের ভয়ভীতি দেখানো, এজেন্ট বের করে দেওয়া, জাল ভোটসহ নানা অভিযোগ করেছেন রাজবাড়ী-২ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী, কৃষক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নুরে আলম সিদ্দিকী হক, কুষ্টিয়া-৩ আসনের পরাজিত স্বতন্ত্র প্রার্থী পারভেজ আনোয়ার এবং ফরিদপুর-২ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী, নগরকান্দা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জামাল হোসেন। 

নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ ও দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যকার হামলা এবং হুমকি-ধমকির এসব ঘটনার কারণে দলটিতে দীর্ঘস্থায়ী দ্বন্দ্ব-কোন্দলের আশঙ্কা করা হচ্ছে। এই বিরোধ সহজে দূর হবে না বলেও মনে করছেন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা।


জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ বলেন, নির্বাচন নিয়ে আগেও নেতাকর্মীদের মধ্যে মতবিরোধ হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের ঐক্যে কোনো ফাটল ধরেনি। তারা অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেবেন।


শেয়ার করুন