প্রতিবছরই পুলিশ সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ অন্যান্য মন্ত্রী ও সচিবদের সঙ্গে বৈঠকে নিজেদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট একগুচ্ছ দাবি উত্থাপন করে পুলিশ। দাবি পূরণে আন্তরিকতার সঙ্গে আশ্বাসও দেন দেশের শীর্ষ কর্তাব্যক্তিরা। তবে আশ্বাসেই আটকে থাকে পুলিশের অধিকাংশ দাবি।
তবুও অনেকটা রেওয়াজ রক্ষার্থে এবারও পুলিশ সপ্তাহে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া তুলে ধরবেন তারা। যার মধ্যে অন্যতম পদোন্নতি জট নিরসন এবং সুপার নিউমারারি পদগুলো রেগুলার করা। নতুন পদ সৃষ্টি ও পদোন্নতি জট নিরসনের কিছু উপায়ও এবার তুলে ধরবেন পুলিশের দায়িত্বশীলরা।
এর মধ্যে অন্যতম, দেশের মধ্যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রেষণে নিয়োগের পাশাপাশি, বিদেশি মিশনগুলোতে প্রেষণে পুলিশ অফিসারদের নিয়োগ।
এছাড়া নিজস্ব বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, গাড়ি কিনতে সুদমুক্ত ঋণ ও পরিদর্শক থেকে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ঝুঁকি ভাতা, নন-ক্যাডার পুলিশ সদস্যদের জন্য সুপার নিউমারারি পদ সৃষ্টি করে পদোন্নতি জট কমানোসহ পুরোনো দাবিগুলো ফের তুলে ধরা হবে।
মঙ্গলবার অনুষ্ঠেয় পুলিশ সপ্তাহের কল্যাণ প্যারেড ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সভায় এসব দাবি তুলবেন পুলিশ সদস্যরা। পুলিশের সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
‘স্মার্ট পুলিশ, স্মার্ট দেশ শান্তি প্রগতির বাংলাদেশ’ এই স্লোগানকে ধারণ করে মঙ্গলবার থেকে শুরু হচ্ছে পুলিশ সপ্তাহ। নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে ৬ দিনব্যাপী জাঁকজমক পূর্ণভাবে পুলিশ সপ্তাহ অনুষ্ঠিত হবে। এ উপলক্ষ্যে আইজিপিসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দফায় দফায় বৈঠকও করছেন। প্রতিবছর পুলিশ সপ্তাহে সবচেয়ে বড় চমক থাকে সারা বছরের ভালো কাজের স্বীকৃতি হিসাবে পদক দেওয়া।
এবার ৪০০ পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যকে বাংলাদেশ পুলিশ পদক (বিপিএম), রাষ্ট্রপতির পুলিশ পদক (পিপিএম), বাংলাদেশ পুলিশ পদক (বিপিএম)-সেবা এবং রাষ্ট্রপতির পুলিশ পদক (পিপিএম)-সেবা দেওয়া হবে। পুলিশের দায়িত্বশীল একটি সূত্র বলছে, এবার পুলিশ সপ্তাহে যারা সুপার নিউমারারি পদোন্নতি পেয়েছেন তাদের প্রেষণে নিয়োগের দাবি তোলা হবে। আগের মতো বিআরটিএ, পাসপোর্ট অধিদপ্তরে পুলিশ অফিসারদের প্রেষণে নিয়োগ, গ্রেড-১ পদ সংখ্যা চারটি থেকে ১০টিতে উন্নীতকরণের জোরালো দাবি তোলা হবে।
এবারের পুলিশ সপ্তাহে দাবির বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) মো. আসাদুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, আমাদের সব থেকে বড় দাবি পদোন্নতি জট নিরসন করা। এজন্য সরকার ইতোমধ্যে উদ্যোগ নিয়ে সুপার নিউমারারি পদ সৃষ্টি করে পদোন্নতি দিচ্ছে কিন্তু এটা রেগুলার করতে হবে। সেক্ষেত্রে বয়স ও ব্যাচভিত্তিক পদোন্নতি দেওয়ার দাবি থাকবে। নির্দিষ্ট সময়ে অন্যান্য ক্যাডার অফিসারদের মতোন পুলিশ অফিসাররা যেন পদোন্নতি পান সে বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়। প্রশাসন ক্যাডারে যেভাবে পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে সেভাবে আমাদের পদোন্নতি জট নিরসন করার দাবি করা হবে।
প্রেষণে নিয়োগের বিষয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশি শ্রমিকরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রয়েছেন। সেখানে তারা নানা সমস্যার সম্মুখীন হন। এসব সমস্যা সমাধানে মিশনগুলোতে পুলিশ অফিসারদের প্রেষণে লিয়াজোঁ অফিসার নিয়োগের দাবি তোলা হবে।
আসাদুজ্জামান আরও বলেন, আমাদের বেশকিছু দাবি আছে যা এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। যেমন পুলিশ বিভাগ করা, মেডিকেল কলেজ, সাইবার ইউনিট গঠন, পর্যাপ্ত জনবল নিয়োগ, পরিদর্শক থেকে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ঝুঁকি ভাতা দেওয়া, আমাদের গাড়ির লোন সুবিধা দেওয়া। প্রশাসনের উপ-সচিব তদূর্ধ্ব সবাই এ সুবিধা পাচ্ছেন, পুলিশেরও অনেক আগে থেকেই অন্যতম দাবি ছিল এটি। কিন্তু সেটি এখনো পূরণ হয়নি। এগুলোর বাস্তবায়ন আমরা চাই। এছাড়া আমাদের অনেকেই পদোন্নতি পাচ্ছেন কিন্তু তাদের লজিস্টিক সাপোর্ট নেই-এ বিষয়টিও তুলে ধরা হবে।
দাবি পূরণ না হওয়ার কারণের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কিছু আছে অর্থনৈতিক মন্দার কারণে পূরণ হচ্ছে না। কিন্তু ঝুঁকি ভাতার বিষয়টিও অর্থনৈতিক মন্দার সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। তারপরও অন্যান্য সব ক্যাডারে পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে কিন্তু পুলিশে জটিলতা তৈরি হয়েছে। এ কারণে জুনিয়র থেকে সিনিয়র পর্যায়ে হতাশা বিরাজ করছে।
পুলিশ সপ্তাহে প্রতিবছরই প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ অন্যান্য মন্ত্রী ও সচিবদের সঙ্গে বৈঠক হয় পুলিশের। ওইসব বৈঠকে পুলিশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট দাবি উত্থাপন করা হয়। পুলিশের দাবিগুলোর বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আন্তরিক হলেও প্রশাসনের কাছ থেকে সহায়তা পাওয়া যায় না বলে অভিযোগ অধিকাংশ পুলিশ কর্তাদের।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, সরকারি অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা ৮ ঘণ্টা দায়িত্ব পালন করলেও পুলিশের নির্ধারিত কর্মঘণ্টা নেই। অনেক সময় টানা ২৪ ঘণ্টাও কাজ করতে হয় তাদের। কিন্তু তারা অতিরিক্ত সময়ের জন্য ওভারটাইম ভাতা পান না। বিষয়টি এর আগে একাধিকবার পুলিশ সপ্তাহে উত্থাপন করা হলেও ওভারটাইম ভাতা কার্যকর হয়নি। এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপের দাবি তোলা হবে পুলিশ সপ্তাহে।
সরকারের উপসচিবসহ তদূর্ধ্ব কর্মকর্তা, সশস্ত্র বাহিনীর মেজর বা সমমনাসহ তদূর্ধ্ব কর্মকর্তারা বিনা সুদে গাড়ির ঋণ সুবিধা পেয়ে থাকেন। তবে পুলিশ সুপারসহ তদূর্ধ্ব কর্মকর্তারা এ সুবিধা পান না। তাদের জন্য বিনা সুদে গাড়ির ঋণ সুবিধা দেওয়ার দাবি তোলা হবে এবার। উপকূলীয় থানা ও দ্বীপ এলাকায় কর্মরত পুলিশ সদস্যদের জন্য দ্বীপাঞ্চল ভাতার দাবি করা হবে। পার্বত্য এলাকায় পুলিশ সদস্যরা দুর্গম ও ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে দায়িত্ব পালন করায় তাদের প্রণোদনার অংশ হিসাবে মূল বেতনের ৩০ শতাংশ অনধিক ৩ হাজার টাকা হারে পাহাড়ি ভাতা পান। এই সিলিং তুলে দেওয়ার দাবি তোলা হবে।
ট্রাফিক পুলিশের সদস্যদের ভাতা বাড়ানোর দাবি তোলা হবে। পুলিশের অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিট (এটিইউ) ও ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিসিটিসি) ইউনিটের পুলিশ সদস্যদের জন্য মূল বেতনের ৫০ শতাংশ উচ্চঝুঁকি ভাতার দাবি তোলা হবে। বিভিন্ন বাহিনীতে কর্মরত সদস্যরা প্রণোদনা হিসাবে ফ্রেশ মানি পান। তবে পুলিশ সদস্যরা এর থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এবারও ফ্রেশ মানি দেওয়ার দাবি তুলবে পুলিশ। আইজিপি পদটি ফোর স্টার করার দাবিও উত্থাপন করা হবে। এসব দাবি নতুন না হলেও ফের তুলে ধরা হবে।
এছাড়া পুলিশ সদস্যদের স্বাস্থ্যসেবায় জেলায় স্থায়ীভাবে এমবিবিএস চিকিৎসক দেওয়া হলেও অধিকাংশ জেলাতেই থাকছেন না এসব চিকিৎসক। জেলায় তাদের অবস্থান নিশ্চিত করতে চায় পুলিশ। পুলিশের জন্য আলাদা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালকে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে উন্নীতকরণ, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকসহ শতভাগ প্যাথলজিক্যাল টেস্টের ব্যবস্থা ও পুলিশ মেডিকেল কোর গঠনসহ স্বাস্থ্যসেবায় নানা দাবি জানানো হবে পুলিশ সপ্তাহে।
রাজধানীর বিভিন্ন থানায় দায়িত্বরত পরিদর্শক ও বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারাও পদোন্নতি জট নিরসনে পুলিশের ক্যাডার অফিসারদের আদলে সুপার নিউমারারি পদ সৃষ্টির দাবি তুলবেন। এছাড়া বর্তমানে কনস্টেবল থেকে এসআই পদমর্যাদার কর্মকর্তারা ঝুঁকিভাতা দেওয়া হলেও কনস্টেবল থেকে আইজি পর্যন্ত সবাইকে ঝুঁকিভাতার আওতায় নিয়ে আসার দাবি তুলবেন তারা।