দেশের আবাসন খাতে ব্যাংক ঋণ এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এখানে ক্রেতা আছেন প্রায় চার লাখ। ধীরে ধীরে ঋণের সুদহার বেড়ে যাওয়ায় দুশ্চিন্তায় পড়েছেন এসব ক্রেতা। বিশেষ করে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে যারা ফ্ল্যাট কিনেছেন, তাদের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। শুরুতে সুদের হার ছিল ৪ থেকে ৯ শতাংশ। বাড়তে বাড়তে এখন সে হার প্রায় সাড়ে ১৩ শতাংশে পৌঁছে গেছে। শেষ পর্যন্ত সুদের এই ঊর্ধ্বগতি কোথায় গিয়ে থামবে তা কেউ জানে না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যারা বুদ্ধিমান এবং সামর্থ্যবান তারা ‘আর্লি সেটেলমেন্টে’ চলে যাচ্ছেন (একসঙ্গে পরিশোধ করে বেরিয়ে যাওয়া)। তবে একসঙ্গে সব টাকা পরিশোধের সামর্থ্য যাদের নেই, তারা আছেন সবচেয়ে বেশি বিপদে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) যুগান্তরকে জানান, ডিএমডি থাকার সময় ২০১৭ সালে ৪ শতাংশ সুদে একটি স্টাফ লোন নিয়েছি। এমডি হওয়ার পর সে লোন কমার্শিয়াল হয়ে যায়। অর্থাৎ সুদের হারও বেড়ে ৮ থেকে ৯ শতাংশ হয়। গত বছরের জুনের পর সে সুদ কয়েক দফা বেড়ে সাড়ে ১১ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। পরে রাগ করে সব ঋণ একসঙ্গে পরিশোধ করে বেরিয়ে আসি। এটা তো সবার পক্ষে সম্ভব নয়। যারা বের হতে পারবেন না, তাদের অনেক কষ্ট হয়ে যাবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ফ্ল্যাট কেনার জন্য বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ১৯ হাজার ২৬৫ কোটি ২৩ লাখ টাকার ঋণ নিয়েছেন ৪৫ হাজার ৭৫০ জন গ্রাহক। ভোক্তা ঋণের আওতায় নেওয়া এসব ঋণে সুদহার ছিল সর্বনিু ৪ থেকে সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ। এখন সে সুদ ১৩ দশমিক ৪৩ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছে। এর সঙ্গে আরও কয়েক শতাংশ হিডেন চার্জ যোগ হলে পরিস্থিতি সহ্যসীমার বাইরে চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
একজন ভুক্তভোগী গ্রাহক যুগান্তরকে জানান, সুদ বাড়ার আগে প্রতি মাসে কিস্তি ছিল ৪০ হাজার টাকা। এখন সে কিস্তি হয়ে গেছে ৪২ হাজার টাকা। অর্থাৎ প্রতি কিস্তিতে ২ হাজার টাকা বেড়ে গেছে। আরও বাড়লে কী হবে? সে চিন্তায় দিশেহারা হয়ে যাচ্ছি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাণিজ্যিকভাবে বড় বড় অ্যাপার্টমেন্ট তৈরির জন্য ডেভেলপার কোম্পানিগুলো বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ২৯ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। এতে সুবিধাভোগী প্রায় ৩৭৮৩ ডেভেলপার বা কন্ট্রাক্টর। একইভাবে শহরে বসবাসের জন্য বাড়িঘর নির্মাণে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে প্রায় ৩২ হাজার কোটি টাকা। সুবিধাভোগী ৯৩ হাজার ৭০৮ জন। গ্রামে বসবাসের জন্য বাড়িঘর নির্মাণে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে ৩ হাজার ৬০ কোটি টাকা। এখানে সুবিধাভোগী ৩৫ হাজার ৩৭২ জন। এছাড়া প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা ঋণ গেছে বাড়িঘর মেরামত বা সংস্কার কাজে। সুবিধাভোগী ২ লাখ ২ হাজার ২১৭ জন এবং বাণিজ্যিক ভবন (মার্কেট, ফ্যাক্টরি, হোটেল, কোল্ড স্টোরেজ, ওয়্যারহাউজ) নির্মাণে ১৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ গেছে। এখানে সুবিধাভোগী ৫ হাজার ৩০৪ জন।
এদিকে ধারাবাহিকভাবে বাড়ানো হচ্ছে সুদহার। এখন ঋণের সুদহার নির্ধারিত হচ্ছে ‘এসএমএআরটি’ বা ‘স্মার্ট’ তথা সিক্স মান্থ মুভিং এভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিলের মাধ্যমে। প্রতি মাসের শুরুতে এই হার জানিয়ে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ১৮২ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের ছয় মাসের গড় সুদহার (স্মার্ট রেট) ছিল ৭ দশমিক ১০ শতাংশ, আগস্টে ৭ দশমিক ১৪ শতাংশ এবং সেপ্টেম্বরে বেড়ে হয় ৭ দশমিক ২০ শতাংশ, অক্টোবরে ৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ, নভেম্বরে ৭ দশমিক ৭২ শতাংশ, ডিসেম্বরে ৮ দশমিক ১৪ শতাংশ এবং সবশেষ জানুয়ারিতে স্মার্ট রেট বেড়ে দাঁড়ায় ৮ দশমিক ৬৮ শতাংশে।
জানুয়ারি মাসের স্মার্ট হারের সঙ্গে সর্বোচ্চ ৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ মার্জিন বা সুদ যোগ করে ফেব্রুয়ারি মাসে ঋণ দিচ্ছে ব্যাংকগুলো। সেই হিসাবে ২০২৪ সালের দ্বিতীয় মাস ফেব্রুয়ারিতে বড় অঙ্কের ঋণে সর্বোচ্চ ১২ দশমিক ৪৩ শতাংশ সুদ নিতে পারবে। প্রি-শিপমেন্ট রপ্তানি এবং কৃষি ও পল্লি ঋণের স্মার্ট হারের সঙ্গে সর্বোচ্চ ২ দশমিক ৭৫ শতাংশ মার্জিন যোগ হবে। অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি মাসে প্রি-শিপমেন্ট রপ্তানি ঋণ এবং কৃষি ও পল্লি ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার ১১ দশমিক ৪৩ শতাংশ। যা জানুয়ারিতে ছিল ১০ দশমিক ৮৯ শতাংশ। তবে ফেব্রুয়ারিতে ব্যক্তিগত ও গাড়ি কেনার ঋণে ব্যাংক সুদ নিচ্ছে ১৩ দশমিক ৪৩ শতাংশ। কারণ সিএমএসএমই, ব্যক্তিগত ও গাড়ি কেনার ঋণে অতিরিক্ত ১ শতাংশ তদারকি বা সুপারভিশন চার্জ নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। যা জানুয়ারিতে ছিল ১২ দশমিক ৮৯ শতাংশ। সাধারণত ব্যাংক থেকে ব্যক্তিগত ও ভোগ্যপণ্য যেমন গাড়ি কেনায় ঋণ, আবাসন ঋণ, শিক্ষা ঋণসহ ফ্রিজ, টিভি, কম্পিউটার কেনার জন্য যে ঋণ নেওয়া হয় সেগুলোকে ভোক্তা ঋণ বলা হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ভুক্তভোগী জানান, বর্তমানে গৃহঋণের সুদ ১৩ দশমিক ৪৩ শতাংশ। কিন্তু এর সঙ্গে আরও অনেক চার্জ যোগ হয়, যা গ্রাহকও জানতে পারেন না। এগুলোকে হিডেন চার্জ বলা হয়। এই হিডেন চার্জ যোগ হলে বাড়িঘর নির্মাণে এখনই ব্যাংক ঋণের সুদ ১৫ শতাংশের কম হবে না। এত উচ্চসুদের ঋণ তো কখনো পরিশোধ করা যাবে না। তখন বেড়ে যাবে খেলাপি ঋণ।