০১ মে ২০২৪, বুধবার, ১০:২৫:২২ অপরাহ্ন
৩ লাখ কোটির বিদ্যুৎ চমক
  • আপডেট করা হয়েছে : ০৬-০৩-২০২৪
৩ লাখ কোটির বিদ্যুৎ চমক

সড়ক দুর্ঘটনায় খুব অল্প বয়সেই নিজের একটি পা হারান চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার হাড়োকান্দি গ্রামের রফিকুল ইসলাম। চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে তার দরিদ্র পরিবার আরও দরিদ্র হয়ে যায়। দীর্ঘদিন কর্মহীন থাকা রফিকুল যখন দিশেহারা তখন গ্রামেরই একজনের সহায়তায় কিস্তিতে কিনে ফেললেন ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা বা ইজিবাইক। এ ইজিবাইকের চাকা ঘোরার সঙ্গে রফিকুলের ভাগ্যের চাকাও ঘুরতে থাকে। আগের দায়-দেনা শোধ করে তার এখন দিনে আয় ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা।


 


রফিকুল বলছিলেন, ‘একটা পা না থাকায় কাজকর্ম করতে পারতাম না। এখন ইজিবাইক চালিয়ে সংসার চলে। তেমন কোনো অসুবিধা হয় না। বিদ্যুৎ না থাকলে তো আমার এই আয় হতো না।’


 


দেশের শতভাগ এলাকায় বিদ্যুৎ সুবিধা পৌঁছে যাওয়ায় গ্রামীণ আর্থসামাজিক উন্নতির ফলে মানুষের জীবনমানে কতটা যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটেছে, এটি তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। এমন বহু উদাহরণ ছড়িয়ে আছে দেশ জুড়ে।


 


অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তির একটি হলো বিদ্যুৎ। গত ১৪ বছরে দেশে বিদ্যুতের উৎপাদন বেড়ে হয়েছে পাঁচগুণেরও বেশি। দেশের অর্থনীতি বিশেষ করে গ্রামীণ আর্থসামাজিক অবস্থার আমূল উন্নতি হয়েছে। তবে নিরবচ্ছিন্ন ও সাশ্রয়ী দামে বিদ্যুতের অভাবে পুরোপুরি সুবিধা পাওয়ার পথে এখনো কিছু অন্তরায় রয়ে গেছে। এ ক্ষেত্রে জ্বালানি ও ডলার সংকট অন্যতম একটি কারণ।


গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) সমীক্ষা অনুযায়ী, প্রতি ১০ লাখ ইউনিট বিদ্যুৎ ব্যবহারে সামষ্টিক অর্থনীতিতে এর অবদান হয় ৪ কোটি ৬০ লাখ থেকে ১০ কোটি ৭০ লাখ টাকা। গত ১৪ বছরে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে প্রায় ১ লাখ কোটি ইউনিট। এর বাইরে আরও কিছু বিদ্যুৎ আমদানি করা হয়েছে ভারত থেকে।


বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, গত ১৪ বছরে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপিতে বিদ্যুতের খাতভিত্তিক অবদান প্রায় ৩ লাখ ২১ হাজার কোটি টাকা। প্রতি বছর এ অবদান বাড়ছে।


বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতির পিতা বলেছিলেন, শহরের মতো গ্রামেও বিদ্যুৎ দিতে হবে। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ভেবেছিলেন, বিদ্যুৎ না হলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই ২০০৮ সালের নির্বাচনের ইশতেহারে দেশে শতভাগ বিদ্যুতায়নের ঘোষণা দেন তিনি। ২০২২ সালে দেশের প্রতিটি এলাকা বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এনেছে সরকার। এখন চাহিদা অনুযায়ী নিরবচ্ছিন্ন ও মানসম্পন্ন বিদ্যুৎ দিতে কাজ করছে সরকার। বিদ্যুতায়নের প্রভাবে দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। বিশেষ করে গ্রামের মানুষ সুবিধা পেয়েছে বেশি। দেশে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কারখানা তৈরি হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, একটা সময় ভয়াবহ বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের কারণে উদ্যোক্তারা কারখানা করতে ভয় পেতেন, তবে এখন প্রেক্ষাপট পাল্টে গেছে। বিদ্যুতের প্রভাবে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ অনেক বেড়েছে।


বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্যমতে, ২০০৯ সালে দেশে বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা ছিল ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট। তখন ভয়াবহ লোডশেডিংয়ে কলকারখানা থেকে শুরু করে জনজীবন, অর্থনীতি সবখানে ছিল স্থবিরতা আর অস্থিরতা। সেই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সরকারের নানামুখী পরিকল্পনার ফলে দেশে এখন বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৬ হাজার ৫০৪ মেগাওয়াট। ১৪ বছর আগে মাত্র ৪৭ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধা পেত। আর এখন পাচ্ছে শতভাগ মানুষ। বিদ্যুৎ সুবিধা থাকায় নতুন নতুন কারখানা তৈরি হয়েছে। বেড়েছে মানুষের কর্মসংস্থান। সেচে বিদ্যুৎ সংযোগের কারণে ফসল আবাদে সেচের খরচ কমেছে, বেড়েছে উৎপাদন। গ্রামে একসময় কেরোসিন জ্বালিয়ে পড়ালেখা ও অন্যান্য দৈনন্দিন কাজ চলত। বিদ্যুতের কারণে সেচ ও অন্যান্য খাতে কেরোসিনের ব্যবহার অনেক কমে যাওয়ায় কমেছে কার্বন দূষণ। বিদ্যুতায়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছে দ্রুত নগরায়ণ, এতে দেশ জুড়ে লাখো মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে।


গ্রামীণ অর্থনীতির চাকা সচল : এক দশক আগে গ্রামীণ অর্থনীতি ৭ লাখ কোটির হলেও এখন তা ২৫ লাখ কোটি ছাড়িয়েছে। শতভাগ বিদ্যুতায়নের ফলে গ্রাম ও শহরাঞ্চলের মধ্যে পার্থক্য কমেছে অনেক। সন্ধ্যা নামতেই নিñিদ্র অন্ধকারে নিস্তব্ধতা নেমে আসত দেশের অধিকাংশ গ্রামে। সেখানে এখন বিদ্যুৎ পৌঁছে যাওয়ায় ঘুটঘুটে অন্ধকার ভেদ করে আলো ছড়িয়েছে, নিস্তব্ধতা ভেঙে তৈরি হয়েছে নানারকম কাজের পরিবেশ। বিদ্যুতের কারণে গ্রাম এমনকি প্রত্যন্ত এলাকার মানুষের নতুন নতুন আয়ের সুযোগ তৈরি হয়েছে। ইজিবাইক বা অটোরিকশার মাধ্যমে আয় বেড়েছে, যাতায়াত সহজ হয়েছে। চার্জিং স্টেশন, চালকল, পোলট্রি খামার স্থাপনসহ নানাভাবে আয়ের পথ খুলে গেছে।


ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাকে ‘বাংলার টেসলা’ হিসেবে আখ্যায়িত করে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, এ যানবাহন সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব। সারা দেশে প্রায় ৪০ লাখ থ্রি-হুইলার রয়েছে। বিদ্যুৎ সুবিধার কারণে এর মাধ্যমে তাদের আয় হচ্ছে। দেশের অর্থনীতিতেও তাদের অবদান রয়েছে।


ইজিবাহক তুলনামূলক আরামদায়ক। তাছাড়া গভীর রাতে কিংবা যেকোনো সময় জরুরি প্রয়োজনে প্রত্যন্ত এলাকার মানুষ এ যানবাহনের মাধ্যমে তুলনামূলক কম ভাড়ায় শহরে কিংবা অন্য কোথাও যেতে পারছে।


বিদ্যুতের কারণে গ্রামাঞ্চলে হাটবাজার বেড়েছে। সেখানে রাতেও চলে বেচাকেনা। এতে মানুষের আয় যেমন বেড়েছে, তেমনি কেনাকাটাও অনেক সহজ হয়েছে। বিদ্যুতায়নের ফলে গ্রামাঞ্চলে এখন চুরি, ডাকাতির মতো অপরাধও আগের চেয়ে তুলনামূলক কমেছে। প্রসার হয়েছে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের। গ্রামীণ নারীদেরও কাজের সুযোগ তৈরি হয়েছে।


পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘একটা থাম্ব রুল আছে। তা হলো বিদ্যুতের প্রবৃদ্ধি যদি দেড় শতাংশ হয় তাহলে জিডিপিতে এর অবদান দাঁড়ায় ১ শতাংশ। দিনে দিনে আমাদের মাথাপিছু আয় বাড়ছে, শিল্পকারখানা বাড়ছে, রপ্তানি বাড়ছে। এগুলো কিন্তু বিদ্যুতের কারণেই হয়েছে।’


তিনি বলেন, শতভাগ এলাকায় বিদ্যুৎ পৌঁছানোর ফলে এখন গ্রামের মানুষেরও আয় বেড়েছে। ২০০৯ সালে মাথাপিছু আয় ছিল ৫৭৫ ডলার। এখন সেটি বেড়ে ৩ হাজার ডলারে পৌঁছেছে। বিদ্যুতের কারণে এই যে উন্নয়ন তা মাথাপিছু আয় বাড়িয়ে দিয়েছে। গত ১৪ বছরে দেশের অর্থনীতির যে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে তার মধ্যে অবকাঠামোর (যেমন সড়ক ও যোগাযোগ ব্যবস্থা ইত্যাদি) উন্নয়নটুকু বাদ দিলে জিডিপিতে যে অগ্রগতি তার কৃতিত্ব বিদ্যুতের।


প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, ‘একসময় বিদ্যুতের ভয়াবহ সংকটে দেশের সব খাতই বিপর্যস্ত ছিল। সেই অবস্থার উন্নতি হয়েছে। সরকারের প্রথম লক্ষ্য ছিল শতভাগ এলাকায় বিদ্যুৎ সুবিধা পৌঁছানো। তাতে সফল হয়েছে। এখন নিরবচ্ছিন্ন মানসম্পন্ন বিদ্যুৎসেবা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন ধরনের পরিকল্পনা একে একে বাস্তবায়ন হচ্ছে।’


কৃষি ও পোলট্রি শিল্পে বিপ্লব : বিদ্যুতের কারণে কৃষিতে সেচ ব্যবস্থা এখন আরও সহজ ও সাশ্রয়ী হয়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে কৃষি যন্ত্রের ব্যবহার। এতে কৃষকের কায়িক শ্রমও কমেছে। সবমিলে ফসলের উৎপাদন বেড়েছে। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে, ২০০৯ সালে সেচে বিদ্যুৎচালিত পাম্প ছিল ২ লাখ ৩৪ হাজার। সেটি এখন বেড়ে ৪ লাখ ৭৩ হাজার ছাড়িয়েছে। গ্রিড বিদ্যুতের পাশাপাশি এখন সৌরবিদ্যুতের সাহায্যেও চলছে সেচ কার্যক্রম।


শেয়ার করুন