ভবিষ্যতে জ্বালানি সঙ্কট এবং আমদানি নির্ভরতা কমাতে নিজস্ব কয়লা উত্তোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে বাংলাদেশ যেখানে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলারও পরিকল্পনা রয়েছে। সরকারের উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্তের জন্য জ্বালানি মন্ত্রণালয় যে প্রস্তাব দিতে যাচ্ছে সেখানে প্রাথমিক পর্যায়ে দেশের তিনটি খনির কয়লা উত্তোলনের ব্যাপারটি চূড়ান্ত ফয়সালা হবে।
বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে এখন পর্যন্ত পাঁচটি কয়লা খনি আবিষ্কার হয়েছে। এসব খনিতে সাত হাজার ৮২৩ মিলিয়ন টন কয়লার মজুদ আছে। জ্বালানি বিভাগের উপস্থাপনায় উঠে এসে এই কয়লার ২০ শতাংশ উত্তোলনযোগ্য যার পরিমাণ এক হাজার ৫৬৪ দশমিক ছয় মিলিয়ন টন। এ পরিমাণ কয়লা ৪০ দশমিক ছয় ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের সমান জ্বালানি চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম।
জ্বালানি মন্ত্রণালয় থেকে জানতে পেরেছে, আগামী এপ্রিল মাসের মধ্যে দেশের কয়লা খনিগুলোতে পরিচালিত বিভিন্ন সমীক্ষা ও সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি একটি প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীর সামনে উপস্থাপন করে অনুমোদন চাওয়া হবে।
ওই প্রস্তাব বিচার বিশ্লেষণ করে উচ্চপর্যায় থেকে যে সিদ্ধান্ত আসবে তার ভিত্তিতেই বাংলাদেশের কয়লা সম্পদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ হবে। এ পর্যায়ে কয়লা উত্তোলনের অনুমোদন পাওয়া গেলে খনির কাজ শুরু করে আগামী তিন বছরের মাথায় কয়লা ওঠানো সম্ভব হবে।
জ্বালানি বিভাগের প্রস্তুতি
বাংলাদেশে আবিস্কৃত পাঁচটি কয়লা খনির মধ্যে একমাত্র বড়পুকুরিয়া থেকে কয়লা উত্তোলন করা হয়। ২০০৫ সাল থেকে সেখানে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ভূ-গর্ভস্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করা হচ্ছে। বড়পুকুরিয়া কয়লা খনিতে ৪১০ মিলিয়ন টন কয়লার মজুদ রয়েছে। ২০২৭ সালের পর বড়পুকুরিয়া কোল মাইনিং কোম্পানি লিমিটেড (বিসিএমসিএল)-এর কয়লা উত্তোলনের অনুমোদিত কোনো পরিকল্পনা নেই।
বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানান, কয়লা উত্তোলনের সিদ্ধান্ত না হলে বড়পুকুরিয়ার কয়লা-ভিত্তিক ৫০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘আমরা ইতোমধ্যে ফিজিবিলিটি স্টাডি করেছি। এই মুহূর্তে দীঘিপাড়া আমাদের প্রস্তুত, আমরা কাজ করতে পারি যদি তিনি (প্রধানমন্ত্রী) আমাদেরকে বলেন। আমরা বড়পুকুরিয়ায় কাজ করতেছি। নতুন করে আমাদের করতে হবে। যদি আমরা না করি ওখানে আমাদের ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ হয়ে যাবে। আগামী দু’বছরের মাথায়। আমাদেরকে কয়লা উত্তোলন করতেই হবে সেখানে।’
এ বছর ফেব্রুয়ারি মাসে দেশের পাঁচটি কয়লা খনি নিয়ে অগ্রগতি এবং প্রস্তাবনা বিষয়ে জ্বালানি বিভাগে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় প্রতিমন্ত্রীকে যে উপস্থাপনা দেয়া হয়েছে সেখানে বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির উত্তরাংশে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা খনি করা যেতে পারে এমন সুপারিশ তুলে ধরা হয়।
নসরুল হামিদ জানান, বড়পুকুরিয়া থেকে বর্তমানে দৈনিক তিন হাজার টন কয়লা উত্তোলন হয়। সেখানে আরো সম্ভাবনা আছে এবং দিনে আট থেকে নয় হাজার টন কয়লা উত্তোলন সম্ভব।
তিনি বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সময় চাইব আমরা বিশেষভাবে। তাকে আমরা দেখাব। তিনি যদি সন্তুষ্ট হন তাহলে হয়তো দীঘিপাড়া এবং বড়পুকুরিয়া কাজটা আমরা শুরু করব। বড়পুকুরিয়ায় দুটি প্রস্তাব আমাদের সেখানে। কিছু অংশ ওপেন পিট করতে হবে আর কিছু অংশ আন্ডারগ্রাউন্ড করতে হবে।’
উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা খনির সুপারিশ
জ্বালানি সঙ্কট এবং ভবিষ্যৎ জ্বালানি নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে কয়লা নিয়ে জ্বালানি বিভাগের পরিকল্পনা হলো নতুন তিনটি কয়লা খনি ফুলবাড়ী, দীঘিপাড়া ও খালাশপীর থেকে কয়লা উত্তোলন করা।
জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী জানান, এই তিনটির মধ্যে ফুলবাড়ী ওপেন পিট করা যেতে পারে আর বাকি দুটি আন্ডারগ্রাউন্ড।
তিনি বলেন, ‘আমরা ফিজিবিলিটি স্টাডি করে রাখছি ফুলবাড়ি এবং দিঘীপাড়া। এবং খালাশপীরেও প্রিফিজিবিলিটি স্টাডি করা আছে।’
ফুলবাড়ি এবং বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির উত্তরাংশে উন্মুক্ত কয়লা খনির যে প্রস্তাব তৈরি হচ্ছে সে বিষয়ে নসরুল হামিদ বলেন, ‘বিষয়টা হলো ওখানে কৃষকের জমি, পানির যে ব্যবস্থা এ বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের কাজ করতে হচ্ছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটা বক্তব্য আছে। উনি অনেক আগে আমাদেরকে বলছেন যে কৃষকের জমির ন্যায্য বিষয়টা দেখতে হবে। সার্বিকভাবে পানির ব্যবস্থাটা ঠিকমতো করতে হবে। সেখানে যদি সমাধান করা যায় তাহলেই কয়লা উত্তোলন করা যাবে তারা আগে না। আমরা সেই কাজটা এখন করছি। আমরা যদি দেখতে পাই একটা ভালো সল্যুশন হয়েছে। আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে নিয়ে যাব, উনি যদি মনে করেন যে হ্যাঁ, কয়লা উত্তোলন করা যেতে পারে, পারিপার্শ্বিক অবস্থা, সেখানকার জনগণ যারা আছেন তাদের সকলের মতামতের ভিত্তিতে আমরা এ জায়গায় মাইনিং করব।’
কয়লা উত্তোলনে প্রধানত দু’টি পদ্ধতি বহুল প্রচলিত। একটি হলো ওপেন পিট মাইনিং বা উন্মুক্ত পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে খনি থেকে সর্বোচ্চ পরিমাণ কয়লা তোলা যায়। দিনাজপুরের ফুলবাড়ী কয়লা খনি থেকে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের সুপারিশ রয়েছে এশিয়া এনার্জি নামক একটি কোম্পানির (বর্তমানে জিসিএম)। ফুলবাড়িতে ২৪ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে মাটির ১৪১ থেকে ২৭০ মিটার গভীরে ৫৭২ মিলিয়ন টন কয়লার মজুদ আছে।
কয়লা উত্তোলনের আরেকটি প্রচলিত পন্থা হলো ভূ-গর্ভস্থ পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে সুড়ঙ্গ করে খনির গভীর থেকে কয়লা ওঠানো হয়। এটি অনুসরণ করেই বাংলাদেশের বড়পুকুরিয়া খনি থেকে কয়লা উত্তোলন হচ্ছে। এই দুই পদ্ধতির বাইরে কোল বেড মিথেন এবং আন্ডারগ্রাউন্ড কোল গ্যাসিফিকেশন পদ্ধতিতে কয়লা থেকে জ্বালানি সম্পদ আহরণের প্রচলন রয়েছে। বাংলাদেশে জামালগঞ্জ কয়লা খনিতে কোল গ্যাসিফিকেশন পদ্ধতি কাজ করে কিনা সেটি সমীক্ষা করার প্রস্তাব রয়েছে।