দেশের বাজারে চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে পেঁয়াজ। গত এক মাসের ব্যবধানে নিত্যপ্রয়োজনীয় এই পণ্যটির দর ৩০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। বাড়তি চাল ও আলুর দরও। এছাড়া, গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে দাম বেড়েছে এমন পণ্যের মধ্যে আরও রয়েছে মসুর ডাল, রসুন ও ডিম। সব মিলিয়ে স্বস্তি নেই নিত্যপণ্যের বাজারে।
ব্যবসায়ীরা বলেছেন, মৌসুম শেষ হয়ে যাওয়ায় বাজারে সরবরাহ কমেছে পেঁয়াজের। প্রতি বছরই এ সময় একই অবস্থা হয়। এ অবস্থায় একমাত্র ভরসা ‘মুড়িকাটা পেঁয়াজ’। তবে প্রতি বছর নভেম্বরের শুরুতে মুড়িকাটা পেঁয়াজ বাজারে এলেও এবার অতিবৃষ্টির কারণে সময়মতো চাষাবাদ করতে না পারায় এই পেঁয়াজ আসতে কিছুটা দেরি হবে।
শুক্রবার রাজধানীর শান্তিনগর, নিউমার্কেট ও তুরাগ এলাকার নতুন বাজারে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, মানভেদে প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ ১৪০ থেকে ১৫০ টাকা ও আমদানিকৃত পেঁয়াজ ১১০ থেকে ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অথচ এক মাস আগেও তা যথাক্রমে ১০৫ থেকে ১১০ টাকা ও ৯০ থেকে ১০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। সরকারের বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) প্রতিদিন নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্যের দাম নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করে। এই সংস্থাটির তথ্য বলছে, গত এক মাসের ব্যবধানে পেঁয়াজের দর ৩০ শতাংশের বেশি বেড়েছে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর দেশে পেঁয়াজের চাহিদা ২৬ থেকে ২৭ লাখ টন। এরমধ্যে ৫ থেকে ৬ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করে চাহিদা মেটানো হয়। তবে যেহেতু আমদানিকৃত পেঁয়াজের বড় অংশই ভারত থেকে আমদানি করা হয় আর ভারতের বাজারেও এই সময় পেঁয়াজের সরবরাহ কম থাকে, ফলে আমদানিকৃত পেঁয়াজের দরও বেশি পড়ে। এছাড়া, ভারত তাদের চাহিদা মেটাতে বছরের এই সময় কখনো কখনো পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধও করে থাকে। তখন দেশের বাজারে পেঁয়াজের দাম হু হু করে বাড়তে থাকে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএআরআই) তথ্য বলছে, দেশে পেঁয়াজ উত্পাদনের বড় অংশ হয় বছরের মার্চ-এপ্রিল মাসে। সে সময় মোট দেশীয় উত্পাদনের ৮০ শতাংশ পেঁয়াজ কৃষক ঘরে তোলেন। তখন পেঁয়াজের দাম সবচেয়ে কম থাকে। এরপর জুন-জুলাইয়ে অল্প পরিমাণে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ উত্পাদন হয়। তবে সেপ্টেম্বর নাগাদ দেশি পেঁয়াজের মজুত কমতে থাকে। এ সময় পেঁয়াজের দাম বাড়তে থাকে। সুযোগ নেয় মজুতদাররাও। নভেম্বরে মুড়িকাটা পেঁয়াজ বাজারে এলে দাম কিছুটা কমে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএআরআই) আঞ্চলিক মসলা গবেষণা কেন্দ্র—গাজীপুরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা কৃষিবিদ মাসুদুল হক এ প্রসঙ্গে ইত্তেফাককে বলেন, পেঁয়াজ একটি বৈশ্বিক ফসল। সারা পৃথিবীতেই এ সময় পেঁয়াজের ঘাটতি হয়। ভারত কোল্ড স্টোরেজে রেখে পেঁয়াজের এ ঘাটতি মেটায়। আমাদের এখানে এ সময় ‘মুড়িকাটা’ পেঁয়াজ দিয়ে ঘাটতি মেটানো হয়। তবে এ বছর অতিবৃষ্টির কারণে আবাদ নষ্ট হওয়ায় ‘মুড়িকাটা’ পেঁয়াজ আসতে কিছুটা দেরি হবে। তিনি বলেন, দেশে পেঁয়াজসহ বিভিন্ন ফসলের ঘাটতি মেটাতে গবেষণার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রতিষ্ঠানের জন্য চুক্তি করা হয়েছে। এ ব্যাপারে কাজ চলছে। এদিকে সরবরাহ বাড়িয়ে পেঁয়াজের দাম স্থিতিশীল রাখতে সম্প্রতি বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন আমদানি শুল্ক সম্পূর্ণ প্রত্যাহারের সুপারিশ করেছে। বর্তমানে পেঁয়াজ আমদানিতে ৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক রয়েছে।
চালসহ আরও চারটি পণ্যের দর বাড়তি
গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে দাম বেড়েছে এমন পণ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে চাল, ডিম, মসুর ডাল, রসুন ও আলু। এছাড়া সবজির বাজারে এখনো স্বস্তি ফেরেনি। গতকাল বাজারে বিভিন্ন ধরনের চালের মধ্যে সরু চাল নাজিরশাইল মিনিকেট ৭০ থেকে ৮০ টাকা, মাঝারিমানের চাল পাইজাম/লতা ৫৮ থেকে ৬৫ টাকা ও মোটা চাল ইরি/স্বর্ণা ৫২ থেকে ৫৫ টাকায় বিক্রি হয়। যা সপ্তাহখানেক আগে যথাক্রমে ৬৪ থেকে ৮০ টাকা, ৫৫ থেকে ৬২ টাকা ও ৫০ থেকে ৫৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এ হিসেবে সপ্তাহের ব্যবধানে মানভেদে প্রতি কেজি চালে দুই থেকে ছয় টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।
টিসিবির তথ্য বলছে, গত বছর এই সময় দেশের খুচরা বাজারে প্রতি কেজি সরু চাল ৬০ থেকে ৭২ টাকা, মাঝারিমানের চাল ৫২ থেকে ৫৫ টাকা ও মোটা চাল ৪৮ থেকে ৫২ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
এ পরিস্থিতিতে সরকার বাজারে চালের সরবরাহ বাড়াতে ও দাম স্বল্প আয়ের মানুষের ক্রয়সীমার মধ্যে রাখতে চাল আমদানির ওপর সব ধরনের শুল্ক প্রত্যাহার করেছে। এ ব্যাপারে গত বৃহস্পতিবার জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। এতে বলা হয়েছে, চালের ওপর বিদ্যমান আমদানি শুল্ক ১৫ শতাংশ এবং রেগুলেটরি শুল্ক ৫ শতাংশ সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করা হয়েছে। অর্থাত্, চাল আমদানিতে বিদ্যমান মোট করভার ২৫ শতাংশ হতে কমিয়ে ২ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। এতে আমদানি পর্যায়ে প্রতি কেজি চালের দাম ৯ টাকা ৬০ পয়সা কমবে।
এদিকে সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতি কেজি আলুতে ৫ থেকে ১০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। গতকাল খুচরা বাজারে প্রতি কেজি আলু ৬০ থেকে ৬৫ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। এছাড়া, প্রতি কেজি মাঝারিমানের মসুর ডালে পাঁচ টাকা বেড়ে ১১০ থেকে ১২০ টাকা, রসুনের কেজিতে ২০ টাকা বেড়ে ২২০ থেকে ২৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ডিমের দাম মাঝে কিছুটা কমলেও সপ্তাহের ব্যবধানে আবার বেড়েছে। ফার্মের বাদামি রঙের ডিম হালিতে দুই টাকা বেড়ে ৫০ থেকে ৫২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।