১৮ এপ্রিল ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ০৮:১২:৫৮ পূর্বাহ্ন
ক্ষমতার ‘জার্সি’ গায়ে বেপরোয়া বাহিনী
  • আপডেট করা হয়েছে : ২১-০৩-২০২৩
ক্ষমতার ‘জার্সি’ গায়ে বেপরোয়া বাহিনী

বিএনপি-আওয়ামী লীগ সব আমলেই ক্ষমতার ‘জার্সি’ গায়ে বেপরোয়া ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ৩৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. আউয়াল হোসেন। জনপ্রতিনিধি হিসাবে জনসেবার পরিবর্তে তিনি ও তার বাহিনী এখন এলাকায় মূর্তিমান আতঙ্ক। তার বিরুদ্ধে জমি দখল, চাঁদাবাজি, মাদক বাণিজ্যসহ এন্তার অভিযোগ আছে পুলিশ ও প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে। আউয়াল ও তার অস্ত্রবাজ বাহিনীর অনেক সদস্যের বিরুদ্ধে হত্যাসহ অনেক মামলা রয়েছে। এরপরও প্রভাব বিস্তার করে থাকছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। আওয়ামী লীগের দক্ষিণাঞ্চলের প্রভাবশালী এক নেতা আউয়াল ও তার বাহিনীর সদস্যদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেন বলে অভিযোগ আছে।

সম্প্রতি রাজধানীর ব্যস্ততম গুলিস্তানে আউয়াল ও তার ক্যাডার বাহিনী প্রকাশ্যে সশস্ত্র হামলা করে ব্যবসায়ী নেতা ফিরোজ আহমেদকে হত্যাচেষ্টা চালায়। নিথর দেহ পড়ে থাকলে তার মৃত্যু হয়েছে ভেবে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে বীরদর্পে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে হামলাকারীরা। মোবাইল ফোনে ধারণ করা গা শিউরে ওঠা বর্বরোচিত ওই হামলার ভিডিও চিত্র সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হলে নতুন করে সামনে চলে আসে আউয়াল বাহিনীর অপকর্ম। তাকে কাউন্সিলর পদ থেকে বহিষ্কার ও গ্রেফতারের দাবিতে এখন সোচ্চার এলাকাবাসী। বাহিনীর দখল-চাঁদাবাজি বন্ধে ফুঁসছে ব্যবসায়ীরা। তারা বিক্ষোভ ও মানববন্ধন কর্মসূচিও পালন করেছে। বিচার পেতে স্মারকলিপি দিয়েছে মেয়র ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপসের কাছে। এসব ঘটনার সূত্র ধরে যুগান্তরের অনুসন্ধানে আউয়াল ও তার বাহিনীর অপকর্ম ও উত্থান সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে।

প্রসঙ্গত, স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন ২০০৯-এর ১৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘কাউন্সিলর তার স্বীয় পদ থেকে অপসারণযোগ্য হবেন যদি তিনি (ঘ) অসদাচরণ বা ক্ষমতার অপব্যবহারের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হন। অসদাচরণ বলতে ক্ষমতার অপব্যবহার, আইন বা বিধিনিষেধ লঙ্ঘন, দুর্নীতি, অসদুপায়ে ব্যক্তিগত সুবিধা গ্রহণ, পক্ষপাতিত্ব, স্বজনপ্রীতি, ইচ্ছাকৃত অপশাসন, নির্বাচনি ব্যয়ের হিসাব দাখিল না করা বা অসত্য তথ্য প্রদান করাকে বোঝাবে।’

জানতে চাইলে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ‘কোনো কোনো কাউন্সিলরের অপকর্মে জড়ানোর খবর আমরাও শুনেছি। কিছু অভিযোগ তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে।’ হত্যা মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি হওয়ার পরও কাউন্সিলর আউয়ালের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি-এই প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘কোনো কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে হত্যা মামলায় চার্জশিট হলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়ার কথা। হয়তো এটা আমাদের গোচরীভূত হয়নি। কেউ এ সংক্রান্ত তথ্য-প্রমাণসহ আমাদের কাছে অভিযোগ করলে খতিয়ে দেখে অবশ্যই আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

সরেজমিন এলাকার লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সব সময় ক্ষমতাসীন দলের ছায়ায় থেকে অপকর্মে জড়িয়েছেন আউয়াল। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৩৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ার পর তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। এখন বংশাল, ফুলবাড়িয়া, গুলিস্তানসহ পুরান ঢাকার একাংশের অপরাধ সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণে তিনি গড়ে তুলেছেন আলাদা বাহিনী। এই বাহিনীর সদস্যরা এলাকাবাসীর কাছে মূর্তিমান আতঙ্ক। তাদের দাপটে কোণঠাসা স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ত্যাগী নেতারা।

আলাপকালে স্থানীয় আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক সভাপতি মো. শাহ নেওয়াজ বলেন, ‘কাউন্সিলর আউয়াল ও তার বাহিনী গত বছর ইউনিট সম্মেলনের সময় তাকেও মারধর করে। ওই ঘটনায় শাহ নেওয়াজ বাদী হয়ে আউয়াল ও তার ক্যাডারদের নামে মামলা করেন। মামলাটি তদন্ত করছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। আউয়াল বাহিনীর অপকর্মের কথা জানিয়ে তিনি মহানগর কমিটির কাছে লিখিত অভিযোগও দিয়েছেন। আলাপের এক পর্যায়ে তিনি বলেন, আউয়াল টাকার জোরে সবাইকে ম্যানেজ করে ফেলে। দক্ষিণাঞ্চলের প্রভাবশালী এক আওয়ামী লীগ নেতা সব জেনেও তাকে বারবার রক্ষা করেন। এছাড়া সরকারি-বেসরকারি বিপুল সম্পদ দখল করে মাসে লাখ লাখ টাকা ভাড়া বাণিজ্য রয়েছে তার। এই টাকার একটি অংশ খরচ করে সে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এতে দলের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুণ্ন হচ্ছে।

অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য মতে, মো. আউয়াল হোসেন তৎকালীন ৬৯ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদলের সভাপতি ছিলেন। ৪০ সদস্যবিশিষ্ট ওই কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন মো. আলী আবেদ। ১৯৯৮ সালের ১০ সেপ্টেম্বর ঢাকা মহানগর ছাত্রদলের তৎকালীন আহ্বায়ক ইসহাক সরকার ওই কমিটি অনুমোদন দিয়েছিলেন। ছাত্রদল সভাপতি থাকাকালে প্রয়াত বিএনপি নেতা নাসির উদ্দিন আহমেদ পিন্টুর সশস্ত্র ক্যাডার ছিলেন আউয়াল। আউয়ালের কমিটির এক ছাত্রদল নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ১/১১-এর তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরই গ্রেফতার এড়াতে কলকাতায় পালিয়ে যায় আউয়াল। সেখানে পলাতক অবস্থায় আওয়ামী লীগের কয়েক নেতার সঙ্গে তার সখ্য তৈরি হয়। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট ক্ষমতায় এলে ওই নেতাদের ‘ম্যানেজ’ করে যুবলীগ ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের সভাপতির পদ বাগিয়ে নেন। কব্জা করেন কাউন্সিলর পদের টিকিট। এরপর সবই অপকর্মের ইতিহাস। বর্তমানে চরম ‘বিতর্কিত’ এই কাউন্সিলর ক্লিন ইমেজের মেয়র ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপসের নাম ভাঙিয়ে বেপরোয়া চাঁদাবাজি ও দখল বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন।

আউয়াল বাহিনীর হামলায় নিহত স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা মোখলেসুর রহমানের ভাই মোস্তাকুর রহমান ফারুক যুগান্তরকে বলেন, ‘কাউন্সিলর হওয়ার পর আউয়াল এতটাই বেপরোয়া যে, তার বাহিনীর হাতে এলাকাবাসী জিম্মি। তার ক্যাডাররা এ পর্যন্ত অন্তত ২০০ মানুষকে মারধর করেছে। এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিরাও নিস্তার পাননি। একটা দ্বৈত্যের হাতে পড়েছে সবাই।’

আলাপকালে গুলিস্তানের নগর প্লাজা ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মাসুদুর রহমান জানান, যুবলীগের হাইব্রিড নেতা হিসাবে পরিচিত কাউন্সিলর আউয়ালের টার্গেট এখন ফুলবাড়িয়ার তিনটি মার্কেট (জাকের সুপার মার্কেট, নগর প্লাজা ও সিটি প্লাজা) দখল করা। ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডে চাঁদাবাজি ও দখল বাণিজ্যের ক্ষেত্র কমে আসায় তিনি এখন ৩৪ নম্বর ওয়ার্ডের বাণিজ্যিক কেন্দ্রগুলোর দিকে হাত বাড়িয়েছেন। আর কৌশল হিসাবে তিনি কাউন্সিলরের প্রভাবে সিটি করপোরেশনের মার্কেটগুলোর পার্কিং ইজারা নিচ্ছেন। আউয়ালের ঘনিষ্ঠ আসাদ উল্লাহর মালিকানাধীন রাইতা ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের নামে এরই মধ্যে অন্তত চারটি মার্কেটের পার্কিং ইজারা নেওয়া হলেও সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন আউয়াল ও তার ক্যাডাররা। এ কাজে করপোরেশনের সম্পত্তি বিভাগের প্রভাবশালী এক কর্মকর্তা ও এক কর্মকর্তার যোগসাজশের অভিযোগ আছে। তাদের ম্যানেজ করে বারবার উচ্ছেদ অভিযানের নাটক সাজিয়ে মার্কেটগুলো দখলের পাঁয়তারা চালাচ্ছে।

বংশালের এক ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী জানান, আউয়ালের চাঁদাবাজ ও দখলবাজ বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে বেশি বেপরোয়া মানিক, দিলদার, রুম্মান, মোয়াজ্জেম, শাহীন, সজল, কাউসার লিথোসহ অন্তত ২০ জনের একটি দল। এই বাহিনীর ক্যাডারদের দাপটে আউয়াল এলাকায় বহু সরকারি-বেসরকারি জায়গা দখল করেছে। পুরান ঢাকার বেশ কয়েকটি বাড়ি দখলের অভিযোগও আছে তার বিরুদ্ধে। অভিযোগ আছে, আউয়ালের অবৈধ আয়লব্ধ অনেক সম্পদ রয়েছে তার বডিগার্ড দিলদারের নামে। দুর্নীতি দমন কমিশন ও বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট খোঁজ নিলে আউয়াল, তার বাহিনী সদস্য আকাশ ও বাবলার নামে-বেনামে বিপুল স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ পাওয়া যাবে বলে আউয়ালের ঘনিষ্ঠ সূত্র জানিয়েছে।

আরও জানা গেছে, আউয়ালের মাদক বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রক হলেন ফারুক। তার সহযোগীদের মধ্যে আছে মিক্কাটুলির মমিন, বুলবুল, সাগর, সোহেল, আবদুল হাদী লেনের সুজন, নবাব কাটরার বেবী, নাজিম উদ্দিন রোড এলাকায় জাহিদ ও জাকির।

জানা গেছে, ২০১৬ সালের ৫ সেপ্টেম্বর বংশালের স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা মোখলেসুর রহমান হত্যা মামলার চার্জশিটভুক্ত এক নম্বর আসামি আউয়াল। এই মামলার ৮ জনের নামে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় তদন্ত সংস্থা ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)। মামলাটি এখন আদালতে বিচারাধীন। ব্যবসায়ী ফিরোজ হত্যাচেষ্টা মামলায়ও আউয়াল প্রধান আসামি। তার দখলবাজির হাত থেকে পরিত্রাণ চেয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার বরাবর আবেদন করেছেন বংশালের বাসিন্দা মো. সাইদ। এছাড়াও আউয়াল ও তার ক্যাডারদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা, সাধারণ ডায়েরি এবং প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে অভিযোগ জমা আছে।

জানতে চাইলে ৩৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. আউয়াল হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ‘একটি মহল রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা করতে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে নেমেছে। তারা বানোয়াট তথ্য সংবাদমাধ্যমে সরবরাহ করছে। আমার কোনো চাঁদাবাজ বাহিনী নেই। আমি ছাত্রদলের নেতা ছিলাম না। ছাত্রদলের কমিটির একটি ভুয়া কাগজ বানিয়ে তারা বিভিন্ন জায়গায় দিচ্ছে। এসব নিয়ে তদন্ত হয়েছে। কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি। মেয়র সাহেব এগুলো সব জানেন।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমার ঘনিষ্ঠ এক যুবলীগ নেতার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান রাইতা ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের নামে মার্কেটের পার্কিং ইজারা নেওয়া হয়েছে। আমরা অন্যায় কিছু করছি না। ফিরোজের ওপর হামলার দিন আমি বাসায় ছিলাম। ম্যাজিস্ট্রেট মনিরুজ্জামান জাকের মার্কেটে উচ্ছেদ অভিযানে গিয়ে বিপদগ্রস্ত হয়ে আমাকে ফোন করলে আমি ঘটনাস্থলে যাই।’ আপনি ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর, জাকের মার্কেটের অবস্থান ৩৪ নম্বর ওয়ার্ডে, মনিরুজ্জামান আপনাকে কেন ডাকবেন-এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘৩৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর বিএনপির। তাই আমাকে ডেকেছে।’ আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ওয়ান-ইলেভেনের সময় আমি আগরতলায় পলাতক ছিলাম এটা ঠিক। তখন একই সঙ্গে জাহাঙ্গীর কবির নানক ভাই, আজম ভাই, হাজী সেলিম, মায়া ভাই, তোফায়েল আহমেদের ভাগ্নে মনির একসঙ্গে ছিলাম।’ তখনই কি তাদের সঙ্গে আপনার সখ্য তৈরি হয়-এই প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘কি যে বলেন ভাই, আমি তো ছোটবেলা থেকেই মেয়র হানিফ ভাইয়ের সঙ্গে চলতাম।’

শেয়ার করুন