৩০ এপ্রিল ২০২৪, মঙ্গলবার, ০৪:৩৮:৫২ অপরাহ্ন
৪০ ঋণখেলাপির কাছেই দুই ব্যাংকের পাওনা সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা
  • আপডেট করা হয়েছে : ১৭-০৬-২০২৩
৪০ ঋণখেলাপির কাছেই দুই ব্যাংকের পাওনা সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা

রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংকের শীর্ষ ২০ ঋণখেলাপির কাছে পাওনা ৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। নগদ আদায়ের লক্ষ্য ছিল ৩৩৫ কোটি টাকা। খেলাপিরা দিয়েছে মাত্র ৯ কোটি টাকা। যা লক্ষ্যমাত্রার ৩ শতাংশ। আর সোনালী ব্যাংকের শীর্ষ ২০ ঋণখেলাপির কাছে পাওনা ৪ হাজার ২৮৪ কোটি টাকা। নগদ আদায়ের লক্ষ্য ছিল ৩০০ কোটি টাকা। খেলাপিরা দিয়েছে মাত্র ১১ কোটি টাকা। যা লক্ষ্যমাত্রার ৪%।

তবে উলটো চিত্র ছোট এবং মাঝারি খেলাপির ক্ষেত্রে। পূবালী ব্যাংকের খেলাপি থেকে ব্যাংকটির পাওনা ৩ হাজার ৪৭৬ কোটি টাকা। এখানেও আদায়ের লক্ষ্য ৩৩৫ কোটি টাকা। আদায় ৪৮১ কোটি টাকা। যা লক্ষ্যের ১৪৪%। অর্থাৎ ছোটরা টাকা দিলেও বড় ঋণখেলাপিরা টাকা দিচ্ছেন না।

অন্যদিকে সোনালী ব্যাংকের অন্যান্য খেলাপি থেকে ব্যাংকটির পাওনা ৭ হাজার ৬৭৫ কোটি টাকা। আদায়ের লক্ষ্য ৭০০ কোটি টাকা। আদায় ৪৩০ কোটি টাকা। যা লক্ষ্যের ৬১%। অর্থাৎ ছোটরা টাকা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। সে তুলনায় শীর্ষ ঋণ খেলাপিদের টাকা ফেরত দেওয়ার প্রবণতা খুবই কম।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য। এটি রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংকের ওপর করা ২০২২ সালের ডিসেম্বরভিত্তিক একটি প্রতিবেদন।বাকি দুই ব্যাংকের চিত্রও প্রায় কাছাকাছি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংকের অবলোপন করা ঋণের অংক ১৪ হাজার ৮৭৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে আদায়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয় ১ হাজার ৪৮৮ কোটি টাকা বা ১০ শতাংশ। কিন্তু ব্যাংকগুলো লক্ষ্যের ধারেকাছেও পৌঁছাতে পারেনি। এই চার ব্যাংক নির্ধারিত সময়ে আদায় করেছে মাত্র ৩১৭ কোটি টাকা বা ২১ দশমিক ৩৩ শতাংশ। তবে চার ব্যাংকের অবলোপনকৃত ঋণের তুলনায় এই আদায়ের অংক ২ দশমিক ১৩ শতাংশ। একইভাবে ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এক বছরে চার ব্যাংকের অবলোপনকৃত ঋণ থেকে আদায়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল ১ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা। তবে ব্যাংকগুলো আদায় করতে পেরেছিল ৫৯১ কোটি টাকা। যা লক্ষ্যমাত্রার ৩৮ দশমিক ১৩ শতাংশ। সেই হিসাবে ২০২১ সালের তুলনায় গত বছর কম আদায় হয়েছে প্রায় ১৭ শতাংশ।

জানা গেছে, সমঝোতা স্মারকের (এমওইউ) আওতায় বাংলাদেশ ব্যাংকের নিবিড় তদারকি সত্ত্বেও রাষ্ট্র্রায়ত্ত চার ব্যাংকের আর্থিক অবস্থার উন্নতি করা যাচ্ছে না। সর্বশেষ ২০২২ সালের সমঝোতা স্মারকের আওতায় ব্যাংকগুলোকে যেসব লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেওয়া হয়েছিল, সেগুলো অর্জন তো দূরের কথা, ধারেকাছেও যেতে পারেনি ব্যাংক চারটি। উলটো খেলাপি ঋণ ও মূলধন ঘাটতি বেড়েছে। বিতরণ করা ঋণের অধিকাংশই কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়েছে মাত্র ৫টি শাখায়। বড় গ্রাহকের সীমাতিরিক্ত ঋণ কমিয়ে আনার শর্তও পরিপালিত হয়নি। শীর্ষ খেলাপিসহ অন্য খেলাপি গ্রাহকদের কাছ থেকে নগদ আদায়ও সন্তোষজনক নয়। এছাড়া ব্যাংকগুলোর মোট আমানতের অর্ধেকের বেশি উচ্চ সুদবাহী হওয়ায় পরিচালন ব্যয়ও কমছে না।

সম্প্রতি ব্যাংকগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ ও মূলধন ঘাটতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। সেই সঙ্গে ন্যূনতম মূলধন সংরক্ষণের শর্ত পরিপালন, খেলাপি ঋণ এক অংকের ঘরে নামিয়ে আনাসহ প্রায় ৮ দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়।

রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংকের আর্থিক অবস্থার উন্নয়নে ২০০৭ সাল থেকে সমঝোতা চুক্তি (এমওইউ) করে আসছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর ধারাবাহিকতায় ২০২২ সালেও ব্যাংকগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের এমওইউ সই হয়। এমওইউতে ন্যূনতম মূলধন সংরক্ষণ, ঋণ প্রবৃদ্ধি যথাযথ রাখা, খেলাপি ঋণ ন্যূনতম সীমায় নামিয়ে আনা, শীর্ষ ২০ খেলাপিসহ অন্যান্য খেলাপি থেকে নগদ আদায় জোরদার, লোকসানি শাখা ও পরিচালন ব্যয় কমানো, বৃহদাংক ঋণের এক্সপোজার কমিয়ে আনা এবং ঋণ প্রদানে শীর্ষ শাখা ব্যতীত অন্যান্য শাখার মাধ্যমে ঋণ বিতরণের শর্তারোপ করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ব্যাংকগুলো ২০২২ সালের ডিসেম্বরভিত্তিক ন্যূনতম মূলধন সংরক্ষণ করতে সক্ষম হয়নি। এ সময় ৪টি ব্যাংকে প্রকৃত মূলধন ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৬ হাজার ৩ কোটি টাকা, যা উদ্বেগজনক। অন্যদিকে, আলোচ্য সময়ে রূপালী ব্যাংক ছাড়া অন্য ৩টি ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকে দাখিলকৃত কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী ঝুঁকিভিত্তিক মূলধন পর্যাপ্ততা অনুপাত (সিআরএআর) সংরক্ষণ করতে পারেনি। বর্তমানে ব্যাসেল-৩ নীতিমালার আলোকে ব্যাংকের ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের ১০ শতাংশ অথবা ৪০০ কোটি টাকার মধ্যে যেটি বেশি, সে পরিমাণ মূলধন রাখতে হচ্ছে। কোনো ব্যাংক এ পরিমাণ অর্থ সংরক্ষণে ব্যর্থ হলে মূলধন ঘাটতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, বছরের পর বছর ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতিতে থাকা পুরো খাতের জন্য খারাপ বার্তা। কারণ কোনো ব্যাংক মূলধন ঘাটতিতে থাকলে তার আর্থিক ভিত্তির দুর্বলতা প্রকাশ পায়। ফলে ওই ব্যাংকের ওপর গ্রাহকদের আস্থাও কমে যায়। এছাড়া অন্য দেশের ব্যাংকগুলোর সঙ্গে লেনদেনের ক্ষেত্রে তাদের অসুবিধার মুখে পড়তে হয়। তাই ব্যাংকগুলোর মূলধন ভিত্তিকে শক্তিশালী করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, সমঝোতা স্মারকের ২০২২ সালের জুনভিত্তিক পর্যালোচনা সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক ডিসেম্বরের মধ্যে সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ন্যূনতম ১৩ শতাংশে এবং অন্য ৩টি ব্যাংকের শ্রেণীকৃত ঋণ ন্যূনতম ১৫ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা প্রদান করা হলেও কোনো ব্যাংক সে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে সক্ষম হয়নি। সেই সঙ্গে আলোচ্য সময় শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার দাঁড়ায় যথাক্রমে ১৫ শতাংশ, ১৮ শতাংশ, ২২ শতাংশ এবং ১৭ শতাংশ।

২০২৩ সালের মধ্যে ব্যাংকগুলোর ন্যূনতম মূলধন ১০ শতাংশে উন্নীত করা, ঋণের প্রবৃদ্ধি নির্ধারিত সীমায় রাখতে পরিকল্পিতভাবে ঋণ প্রদান ও আদায়, খেলাপি ঋণের হার এক অংকের ঘরে নামিয়ে আনা, বড় গ্রাহকের অনুকূলে নতুন করে ঋণ প্রদান বন্ধ রাখাসহ তা সীমার মধ্যে নামানো, খেলাপি ও অবলোপনকৃত ঋণ থেকে নগদ আদায় সন্তোষজনক পর্যায়ে উন্নীত করা, উচ্চ সুদবাহী আমানতের হার ৪০ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনা এবং তাদের কোর ব্যাংকিং সল্যুয়েশন (সিবিএস) শতভাগ বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য ব্যাংকগুলোকে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

শেয়ার করুন