২২ নভেম্বর ২০২৪, শুক্রবার, ১২:২৬:৪০ পূর্বাহ্ন
মন্ত্রীর হুমকিতেও দাম বাড়েনি গরুর চামড়ার, ছাগলেরটি ফ্রিতেও নেয় না
  • আপডেট করা হয়েছে : ৩০-০৬-২০২৩
মন্ত্রীর হুমকিতেও দাম বাড়েনি গরুর চামড়ার, ছাগলেরটি ফ্রিতেও নেয় না

কোরবানির পশুর চামড়া বছর কয়েক ধরে যেন ফেলনা বস্তুতে পরিণত হয়েছে! গত বছর দাম না পেয়ে অনেকে ক্ষোভে চামড়া পুঁতে ফেলেছেন। এ বছর সরকার প্রতি বর্গফুটে ৫ টাকা বাড়িয়ে দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে। মৌসুমী ব্যবসায়ীদের ঠকালে সরকার কাঁচা চামড়া রপ্তানির উদ্যোগ নেবে বলে চামড়া সিন্ডিকেটের প্রতি কড়া বার্তা দিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী। 


কিন্তু দাম নির্ধারণ এবং চামড়া ব্যবসায়ীদের প্রতি সরকারের হুমকি–ধমকির কোনো প্রভাব পড়েনি। গতবারের মতোই এবার কোরবানির পশুর চামড়ার দাম যৎসামান্য। দিনের শুরুতে কিছুটা দাম থাকলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দাম কমে এসেছে। ছাগলের চামড়ার ক্রেতাই নেই! 


অথচ চামড়াজাত পণ্যের দাম বেড়েই চলেছে। এক দশক আগের তুলনায় দেশে অন্তত তিন গুণ বেড়েছে চামড়ার জুতা ও অন্যান্য ব্যবহার্য জিনিসের দাম। 


বর্গফুটে ৫ টাকা বাড়িয়ে কোরবানির পশুর চামড়ার দাম নির্ধারণবর্গফুটে ৫ টাকা বাড়িয়ে কোরবানির পশুর চামড়ার দাম নির্ধারণ

আমাদের বগুড়া প্রতিনিধির পাঠানো প্রতিবেদন অনুযায়ী, মৌসুমী এবং নিয়মিত ব্যবসায়ীরা গত বছরের দামেই চামড়া কিনছেন। বৃহস্পতিবার (২৯ জুন) দুপুর পর্যন্ত অনেক চামড়া অবিক্রিত ছিল। বেলা ১২টা দিকে গরুর যে চামড়া ৭০০ টাকা দাম বলা হতো, দুপুরের পর সেটি ৫০০ টাকার বেশি দাম বলেনি কেউ। মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত কয়েক বছর বাড়ি বাড়ি ঘুরে চামড়া কিনে লোকসান হয়েছে। তাই এবার ভেবেচিন্তে কিনছেন। 


এর প্রমাণ মিলল শহরের বিভিন্ন রাস্তার মোড়ে চামড়া ব্যবসায়ী ও আড়তদারদের সঙ্গে কথা বলে। মৌসুমী ব্যবসায়ীরা গ্রাম ঘুরে চামড়া কিনে তাঁদের কাছে আনেন। কিন্তু বেলা দেড়টা পর্যন্ত সেখানে খুব একটা চামড়া পৌঁছেনি। 


বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার মহাস্থান এলাকা থেকে চামড়া বিক্রি করতে আসা মামুনুর রশিদ নামের এক মৌসুমী ব্যবসায়ী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, পুরো বাজারের ব্যবসায়ীরাই সিন্ডিকেট করে দাম কম দিচ্ছে। মৌসুমী ব্যবসায়ীরা আসল টাকাই তুলতে পারবে না। 


চামড়া ব্যবসায়ী জসমত উল্লাহ বলছেন, গত বছরের চেয়ে এবার লবণের দাম বেশি, এছাড়া আড়ত থেকে নগদ টাকা পাওয়া যায়নি, এ কারণে বেশি দামে চামড়া কেনা সম্ভব হচ্ছে না। 


স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১ লাখ ২০ হাজার টাকা দামের গরুর চামড়া ফড়িয়া ডেকে ৫০০ টাকায় গছিয়ে দিতে হয়েছে। আর ছাগলের চামড়া ২০ টাকা থেকে ৪০ টাকার বেশি কেউ বেচতে পারেননি। গরুর চামড়া ৬০০ টাকার ওপর কেউ দাম বলে না। ভেড়ার চামড়া বিনামূল্যেও নিতে চাননি ফড়িয়ারা। 


তবে বগুড়া জেলা চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি একেএম আসাদুজ্জামান খান বলেন, ‘আড়তে সরকার নির্ধারিত মূল্যেই চামড়া কেনা হবে। এতে ভালো মানের চামড়ার দাম ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা পর্যন্ত হওয়ার কথা।’ তবে নগদ টাকার সংকটের কারণে অনেক ব্যবসায়ী ঝুঁকি নিচ্ছে না বলেও উল্লেখ করেন তিনি। 


একই পরিস্থিতি দেশের অন্যান্য জেলাতেও। ফেনীর পরশুরাম উপজেলা প্রতিনিধির পাঠানো প্রতিবেদন অনুযায়ী, উপজেলার মির্জানগর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. নুরুজ্জামান ভুট্টো আড়াই লাখ টাকার গরুর চামড়া মাত্র দেড়শ টাকায় বিক্রি করেছেন। দেড় লাখ টাকার একটি গরুর চামড়ার দামও দেড়শ টাকার বেশি বলেনি ফড়িয়ারা। 


উপজেলা বক্সমাহমুদ ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আবদুল গফুর বলেন, ১ লাখ ২০ হাজার টাকা মূল্যের গরুর চামড়া অনেক দর–কষাকষি করে মাত্র দেড়শ টাকায় বিক্রি করেছেন তিনি। 


এরকম আরও কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ফেনীতে একশ–দেশড় টাকার বেশি দামে কেউ চামড়া বেচতে পারেননি। 


পরশুরাম বাজারের মৌসুমী চামড়া ব্যবসায়ী মোহাম্মদ তহিদুল ইসলাম বলেন, বিভিন্ন আকারের আড়াইশ চামড়া কিনেছেন সর্বোচ্চ ১৫০ টাকা দরে। বেশির ভাগের দাম পড়েছে ১০০ টাকা। 


এদিকে মেহেরপুর জেলার গাংনী উপজেলায় গরুর চামড়া আকার ভেদে বিক্রি হয়েছে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা দরে। আর ছাগলের চামড়া ২০ থেকে ৩০ টাকায়। 


ক্ষুব্ধ কোরবানিদাতারা বলেছেন, এত কম টাকায় চামড়া বিক্রয় করার চেয়ে মাটিতে পুঁতে রাখা ভালো! 


মৌসুমী ব্যবসায়ী মোহা. জুয়েল রানা বলেন, ঝুঁকি নিয়ে চামড়া কিনছেন তাঁরা। বিক্রি করতে পারবেন কি না জানেন না। ব্যবসায়ী মো. আব্দুল আউয়াল বলেন, গরুর চামড়া ৪০০ থেকে ৫০০ টাকার মধ্যে কিনেছেন। 


ময়মনসিংহে বিনামূল্যেও ছাগলের চামড়া নিচ্ছেন না ফড়িয়ারা। আর লাখ টাকার গরুর চামড়া বিক্রি হয়েছে ৩০০ টাকা দরে। ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা কামরুজ্জামান দুটি ষাঁড় গরু ও দুটি গাভির চামড়া মোট ১ হাজার ৩০০ টাকায় বিক্রি করেছেন! 


মৌসুমী ব্যবসায়ীরা বলেন, গরুর চামড়া ৩০০–৬০০ টাকা এবং ছাড়লের চামড়া ২০–৪০ টাকা দরে কিনেছেন তাঁরা। সুদাংশু নামে এক ফড়িয়া ব্যবসায়ী বলেন, একটা খাসির চামড়া ১০ টাকা করে কিনে লবণ লাগাতে হয় ৩০ টাকার। বাজারে সেই চামড়া তুললে ১০ টাকাও দাম বলে না। তাই এবার খাসির চামড়া কিনছেন না। 


গত কয়েকবারের মতো এবারও কোরবানির পশুর চামড়া নিয়ে বিপাকে পড়েছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মানুষ। মৌসুমী ব্যবসায়ীরাও বিপদে। কারণ স্থানীয় ব্যবসায়ীরা চামড়া কিনতে চাচ্ছেন না। দাম না পাওয়ায় জেলার আখাউড়ার উপজেলার বিভিন্ন মাদ্রাসা ও এতিমখানায় বিনামূল্যে চামড়া দিয়ে দেওয়া হচ্ছে।


পৌরসভার জামিয়া দারুল উলূম মূহিউস সুন্নাহ মাদ্রাসার ভারপ্রাপ্ত প্রিন্সিপাল হাফেজ মাওলানা মাকসুদুল আলম জানান, বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ঘুরে কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহ করেছেন। কিন্তু বিক্রি করতে পারছেন না।


মৌসুমি ব্যবসায়ীদের ঠকালে কাঁচা চামড়া রপ্তানির উদ্যোগ নেওয়া হবে: বাণিজ্যমন্ত্রীমৌসুমি ব্যবসায়ীদের ঠকালে কাঁচা চামড়া রপ্তানির উদ্যোগ নেওয়া হবে: বাণিজ্যমন্ত্রী

গরুর চামড়ার দাম কম, বিনামূল্যে কেউ নিচ্ছে না ছাগলের চামড়া—এমন পরিস্থিতি ঠাকুরগাঁওয়ে। জেলার বালিয়াডাঙ্গীতে দেড় লাখ টাকা দামের গরুর চামড়া ৪৩০ টাকায় বিক্রি করেছেন উপজেলার আমজানখোর ইউনিয়নের শরীফ উদ্দীন। সহিদুল ইসলাম নামে এক ব্যবসায়ী ২৫টি ছাগলের চামড়া বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে কিনেছেন মোট ৩২০ টাকায়। কিন্তু বাজারে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করতে পারছেন না। রাতের মধ্যে বিক্রি না হলে ফেলে দিয়ে যাবেন।


সবকিছুরই দাম বাড়ে, চামড়ার কমে কেনসবকিছুরই দাম বাড়ে, চামড়ার কমে কেন

মৌসুমি ব্যবসায়ী শাহাজাহান আলী জানান, একটা গরুর চামড়াতে কমপক্ষে দুইশ টাকার লবণ খরচ। যারা লবণ লাগাবে তাদের মজুরি আছে। সরকার যে দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে, তা তাঁরা জানেন না। প্রতিবার বাইরের ব্যবসায়ীরা তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। এবার কোনো সাড়াশব্দ নেই!


প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন বগুড়া, পরশুরাম (ফেনী), গাংনী (মেহেরপুর), ময়মনসিংহ, আখাউড়া (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) ও বালিয়াডাঙ্গী (ঠাকুরগাঁও) প্রতিনিধি


শেয়ার করুন