২৪ নভেম্বর ২০২৪, রবিবার, ০৭:১৬:৩২ অপরাহ্ন
সাধারণ বীমা করপোরেশনে দুই বছরে ২০৯ কোটি টাকার অনিয়ম
  • আপডেট করা হয়েছে : ১২-০৭-২০২৩
সাধারণ বীমা করপোরেশনে দুই বছরে ২০৯ কোটি টাকার অনিয়ম

সরকারি বিমা প্রতিষ্ঠান সাধারণ বীমা করপোরেশনে ২ বছরে ২০৯ কোটি টাকার অনিয়ম পেয়েছে বাণিজ্যিক অডিট অধিদপ্তর। চূড়ান্ত নিরীক্ষায় সংস্থাটি ভুয়া হিসাব খুলে প্রিমিয়াম নেওয়া, অনুমোদন ছাড়াই কর্মীদের বোনাস, টিফিন ভাতা, অগ্রিম দেওয়া, কর্মীদের গৃহঋণ আদায় না করা, বেতন স্কেল লঙ্ঘন করে ইনক্রিমেন্ট দেওয়াসহ ১৩ ধরনের অনিয়ম পেয়েছে।


বাংলাদেশ মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ের অধীন বাণিজ্যিক অডিট অধিদপ্তর মনে করে, দুর্বল অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা ও যথাযথ তদারকির অভাবেই এই বিপুল অঙ্কের টাকার ক্ষতি হয়েছে। অধিদপ্তর অডিট আপত্তি জানিয়ে দায় নিরূপণ করে দোষীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি টাকা আদায় করে সরকারি কোষাগারে জমা করার সুপারিশ করেছে।

বাণিজ্যিক অডিট অধিদপ্তরের পরিচালক নাসিমুল ইসলাম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমাদের আপত্তি সংস্থার এমডি বরাবর পাঠাই। পরে চিঠি দিই, জরুরি তাগিদ দিই। তাদের জবাবের পরিপ্রেক্ষিতে আপত্তিগুলোর ওপর আমাদের সুপারিশসহ অডিটর জেনারেলের কার্যালয়ে যায়। সেখান থেকে যেগুলো জাতীয় সংসদে যাওয়ার, তা যায়। পরে পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটিতে সেগুলো সম্পর্কে অনুশাসন দেওয়া হয়।’

বাণিজ্যিক অডিট অধিদপ্তরের চূড়ান্ত নিরীক্ষা সূত্রে জানা গেছে, সাধারণ বীমা করপোরেশনে এসব অনিয়ম পাওয়া গেছে ২০১৮ ও ২০১৯ সালে। মোট অনিয়ম ২০৯ কোটি ৯৪ লাখ ৫৯ হাজার ৮৭৬ টাকার। এর মধ্যে শুধু বিদেশি পুনর্বিমাকারীদের কাছ থেকে পাওনা আদায় না করায় ক্ষতি হয়েছে প্রায় ১১৫ কোটি ৬৯ লাখ ৭৭ হাজার ৩৯৮ টাকা। ২০১৯ সালে বিদেশি বিভিন্ন কোম্পানির কাছ থেকে ফায়ার (এলসি) সারপ্লাস, ফায়ার (এফসি) ফ্যাক., মেরিন কার্গো (এফসি) সারপ্লাস, মেরিন হাল (ফ্যাক.), মেরিন হাল (এক্সএল), বিবিধ (দুর্ঘটনা) এক্সএল, মোটর ভেহিকল এক্সএল, জিএ ক্লেইম এসওফি এবং সার্ভে ফি, প্রিমিয়াম রিজার্ভ রিফান্ড বাবদ এই টাকা আদায় হয়নি।

এ বিষয়ে নিরীক্ষার জবাবে টাকা আদায়ের উদ্যোগের কথা জানায় সাধারণ বীমা। তবে বাণিজ্যিক অডিট অধিদপ্তর মনে করে, এই জবাব স্বীকৃতিমূলক। তাই পাওনা আদায় না করার দায়-দায়িত্ব নির্ধারণ করে টাকা আদায় করতে হবে।

চূড়ান্ত নিরীক্ষায় বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠানের ৩ কর্মকর্তা ৪৯২তম বোর্ড সভার জাল কাগজের মাধ্যমে ২০১০ সালে একটি বেসরকারি ব্যাংকে সাধারণ বীমার নামেই ভুয়া হিসাব খোলেন। ১০ বছর ধরে ভুয়া ওই হিসাবে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, বাংলাদেশ শিল্প ও বিজ্ঞান গবেষণা পরিষদ এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিমা প্রিমিয়াম হিসেবে ২৭ কোটি ৭৭ লাখ ৯০ হাজার ৩১ টাকা জমা নেওয়া হয়। এর মধ্যে ২৬ কোটি ১৪ লাখ ৯৮ হাজার ২০৪ টাকা তুলে আত্মসাৎ করা হয়। বাকি টাকা হিসাবে আছে। ২০২০ সালে এক বিমা কর্মকর্তার চিঠির মাধ্যমে এই জালিয়াতি সামনে আসে। এ নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) মামলা রয়েছে।

এ ছাড়া করপোরেশনের জন্য প্রযোজ্য জাতীয় বেতন স্কেল লঙ্ঘন করে ডিপ্লোমাধারীদের প্রতি বছর মূল বেতনের সঙ্গে দুটি ইনক্রিমেন্ট দিয়ে ৫ কোটি ৫০ লাখ ১৬ হাজার ৬৯৩ টাকা এবং অবসরে যাওয়া কর্মকর্তাদের মূল বেতনের সঙ্গে দুটি বিশেষ ইনক্রিমেন্ট যোগ করে পেনশন দিয়ে ২২ লাখ ৬৬ হাজার ৩৫০ টাকা ক্ষতি করা হয়েছে।

নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, জাতীয় বেতন স্কেলে ডিপ্লোমাধারীদের জন্য বিশেষ কোনো ইনক্রিমেন্টের বিধান নেই। এ বিষয়ে সাধারণ বীমার জবাব গ্রহণযোগ্য নয়। তাই ওই টাকা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছ থেকে আদায় করতে হবে। এ ছাড়া প্রাপ্য না হলেও দ্বিতীয় থেকে দশম গ্রেডের কর্মকর্তাদের প্রতিদিন দুপুরের খাবারের জন্য ২০০ টাকা করে দিয়ে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ৮ কোটি ৮৬ লাখ ১৪ হাজার ১৭১ টাকার। জাতীয় বেতন স্কেলে ১১ থেকে ২০ গ্রেডের ক্ষেত্রেই টিফিন ভাতা প্রযোজ্য। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অনুমোদন ছাড়াই কর্মকর্তাদের উৎসাহ বোনাসের নামে ১২ কোটি ৩৮ লাখ ৯৮ হাজার ৪৭৭ টাকার ক্ষতি হয়েছে।

গৃহঋণ নিয়ে ফেরত দেননি করপোরেশনের ২৮ কর্মকর্তা/কর্মচারী। এই ঋণ আদায়ের উদ্যোগও নেওয়া হয়নি। এতে ক্ষতি হয়েছে ১ কোটি ৫ লাখ ১৫ হাজার ২১৪ টাকা। এ ছাড়া ভাড়াটেদের কাছ থেকে ৯ কোটি ৬০ লাখ ৯৯ হাজার ৭৪৯ টাকার বকেয়া ভাড়া আদায় করা হয়নি। চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন এবং সার্ভেয়ার রিপোর্ট ছাড়া অগ্নি পুনর্বিমা দাবি অনিয়মিতভাবে পরিশোধ করায় ক্ষতি হয়েছে ৮ কোটি ৩১ লাখ ৬০ হাজার ৩০৭ টাকা। চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করে অগ্নি পুনর্বিমা গ্রহীতাকে বিমা দাবি পরিশোধ করায় ক্ষতি হয়েছে ১২ কোটি ২৬ লাখ ৮৭ হাজার ৮২৫ টাকা।

সাধারণ বীমার কর্মীদের (বেতন, চিকিৎসা, ভ্রমণ বিল) ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া অগ্রিম টাকা আদায় না করায় ৮ কোটি ৬০ লাখ ৬০ হাজার ৮৩ টাকা ক্ষতি হয়েছে।

জানতে চাইলে সাধারণ বীমার অডিট অ্যান্ড কমপ্লায়েন্স বিভাগের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার মো. শাহীমুল ইসলাম বাবুল বলেন, ‘অডিট আপত্তি হলে আমরা সেগুলোর জবাব দিই। এর মধ্যে কিছু মীমাংসা হয়, কিছু যোগও হয়। আপত্তির কিছু অর্থ আদায় হয়, কিছু বাকি থাকে। এভাবে চলতে থাকে। আসলে এটা নির্মূল করা যাবে না। তবে কমিয়ে আনতে হয়।’

সাধারণ বীমা করপোরেশনের অডিট আপত্তির বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর আজকের পত্রিকাকে বলেন, সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন অনিয়ম আছে। মহাহিসাব নিয়ন্ত্রকের দপ্তর থেকে এগুলোর আপত্তি তোলা হয়। কিন্তু পরে আর কোনো ফলোআপ হয় না। যাঁরা অনিয়মের সঙ্গে জড়িত, তাঁরা বদলি হয়ে যান, অবসরে যান, কেউ কেউ মারাও যান। কিছু ক্ষেত্রে এটা শুধু ব্যাখ্যাতেই শেষ হয়। তবে এসব আপত্তির দ্রুত নিষ্পত্তি হওয়া উচিত। কিন্তু সংসদীয় কমিটিতে আলোচনা হতে অনেক সময় লেগে যায়।


শেয়ার করুন