২৭ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার, ০১:৩৩:৩৮ অপরাহ্ন
অসাংবিধানিক ॥ তত্ত্বাবধায়ক সরকার
  • আপডেট করা হয়েছে : ৩১-০৭-২০২৩
অসাংবিধানিক ॥ তত্ত্বাবধায়ক সরকার

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আর মাত্র ৫ মাস বাকি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বিএনপি এখনো অনড় অবস্থানে। এজন্য রাজপথে বিরামহীন আন্দোলন কর্মসূচি পালন করছে বিএনপি। কিন্তু তাদের সে আশা পূরণ হচ্ছে না। তারা মনে করেছিল আন্দোলন জোরদার করার পর বিদেশীরা তাদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবির প্রতি সমর্থন জানাবে। কিন্তু দফায় দফায় যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি এসে সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে তত্ত্বাবধায়ক সমর্থন না করে বিদ্যমান ব্যবস্থায় সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বলেছে। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগও সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চায়। যুক্তরাষ্ট্রসহ চার প্রভাবশালী দেশের নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা বাংলাদেশ সফরে এসে বলেছেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক অসাংবিধানিক। আবার নির্বাচন কমিশনের (ইসি) প্রস্তুতিও শেষ পর্যায়ে। এ পরিস্থিতিতে বিএনপির আশা পূরণ হচ্ছে না বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করছেন। 


তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে ৭ মাস ধরে ধারাবাহিক আন্দোলন কর্মসূচি পালন করে আসছে বিএনপি। তাদের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন করছে সমমনা প্রায় ৩ ডজন নামসর্বস্ব ছোট দল। এর মধ্যে অধিকাংশ দলই নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধনবিহীন। আন্দোলনের এক পর্যায়ে বিএনপির দাবির পক্ষে সমর্থন আদায় করতে দেশ-বিদেশে ব্যাপক কূটনৈতিক তৎপরতা চালায় দলের বিভিন্ন স্তরের নেতা ও সুশীল সমাজের কিছু প্রতিনিধি।


২৪ মে যুক্তরাষ্ট্র সরকার বাংলাদেশের জন্য ভিসানীতি ঘোষণা করে। এতে বলা হয় সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে যারা বাধা দেবে তাদের ভিসা দেয়া হবে না। এই ভিসানীতি ঘোষণার পর দফায় দফায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি দল ঢাকা সফরে এসে বাংলাদেশের নির্বাচন ও মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে রাজনৈতিক দল, সরকারের মন্ত্রী, সচিব, নির্বাচন কমিশন, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে শতাধিক বৈঠক করেন। এ সময় বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়ে আশাবাদী হয়ে ওঠে এবং কূটনৈতিক তৎপরতার পাশাপাশি আন্দোলনও চালিয়ে যেতে থাকে। কিন্তু প্রভাবশালী দেশের এসব প্রতিনিধি দল ফিরে যাওয়ার সময় সংবাদ সম্মেলন করে সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বললেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা বলেনি। এতে বিএনপি আশাহত হয়ে রাজপথে আন্দোলনের গতি বাড়িয়ে দেয়।


গত বছর ১০ ডিসেম্বর রাজধানীর গোলাপবাগ মাঠে সারাদেশের সর্বস্তরের নেতাকর্মীকে জড়ো করে মহাসমাবেশ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার, সরকারের পদত্যাগ ও খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ আন্দোলনের ১০ দফা দাবি ঘোষণা করে। এই আন্দোলনে সরকারকে চাপে ফেলতে পারেনি। তাই নতুন কৌশলের অংশ হিসেবে তারা সরকারকে চাপে ফেলতে বিদেশে লবিষ্ট নিয়োগ করে। এর পর একে একে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা ঢাকা সফরে এসে নির্বাচনসংশ্লিষ্ট অংশীজনের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করে। বৈঠককালে বিদেশী প্রতিনিধিদের বিএনপি জানায়, দলীয় সরকারের অধীনে তারা নির্বাচনে যাবে না। তাই সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায়ে তারা বিদেশীদের সমর্থন চায়। অপরদিকে সরকারি দল আওয়ামী লীগ বিদেশীদের জানায় সংবিধানের বাইরে গিয়ে নির্বাচনের কেনো সুযোগ নেই। তবে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনকে যত রকমের সহযোগিতা প্রয়োজন তা দেওয়া হবে। সরকারের এই আশ্বাসে আশ্বস্ত হওয়ায় বিদেশী প্রতিনিধিদের মধ্যে কেউ বিএনপির তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে কথা বলেননি। তারা দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠানোরও আশ্বাস দিয়ে গেছেন।


দফায় দফায় বিদেশীরা আসলেও ত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবির প্রতি সমর্থন না দেয়ায় বিএনপি কিছুটা আশাহত হয়। এ কারণে ১২ জুলাই ঢাকায় বড় সমাবেশ করে আগের ১০ দফা দাবিকে একীভূত করে সরকারের পদত্যাগ, নির্দলীয়  সরকার ও খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ এক দফা দাবি পেশ করে। এরপর রাজপথে আন্দোলনের গতি বাড়িয়ে দেয়। ২২ জুলাই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দল আয়োজিত তারুণ্যের সমাবেশ থেকে বিএনপি মহাসচিব ২৭ জুলাই রাজধানীতে মহাসমাবেশ করার ঘোষণা দেন। তবে ওই দিন মহাসমাবেশ করার অনুমতি না পেয়ে পরদিন ২৮ জুলাই নয়াপল্টনে মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে রাজধানীতে বহুদিন পর বিশাল শোডাউন করে বিএনপি। এই মহাসমাবেশে ঢাকার বাইরে থেকে আগতদের নিজ এলাকায় না যেতে বলা হয়। এছাড়া আদালতের আদেশ উপেক্ষা করে মহাসমাবেশে লন্ডন থেকে দেয়া বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ভার্চুয়াল বক্তব্য শোনোনো হয়। এ সময় তিনি এক দফা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত নেতাকর্মীদের ঘরে ফিরে না যাওয়ার ঘোষণা আহ্বান জানান। এর পর বিএনপি মহাসচিব তাৎক্ষণিকভাবে পরদিন ২৯ জুলাই ঢাকার সকল প্রবেশ পথে অবস্থান কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেন। আর এ কর্মসূচি পালন করতে পুলিশের অনুমতি নেওয়া হবে না বলেও দলের পক্ষ থেকে জানানো হয়। কিন্তু অনুমতি ছাড়া এ কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে বিএনপি-পুলিশ সংঘর্ষে উভয় পক্ষের বেশ ক’জন আহত হয়। এক পর্যায়ে বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা বিভিন্ন স্থাপনা ভাঙচুর ও যানবাহনে অগ্নিসংযোগ করে ঢাকার চারদিকে ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। সরকার ও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয় দেশকে অস্থিতিশীল করতেই বিএনপি হঠাৎ করে সহিংস কর্মসূচি শুরু করেছে। 


অতিসম্প্রতি বায়লাদেশ সফরে আসে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ চার দেশের নির্বাচন পর্যবেক্ষক প্রতিনিধি দল। তারা রবিবার আগারগাঁও নির্বাচন ভবনে গিয়ে নির্বাচন কশিনের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল ছাড়াও চার নির্বাচন কমিশনার উপস্থিত ছিলেন। আর চার দেশের নির্বাচন পর্যবেক্ষক দলে ছিলেন যুক্ত রাষ্ট্রের টেনেট ফিন্যান্স ইন্টারন্যাশনাল গ্রুপের প্রতিনিধি ও নির্বাচন পর্যবেক্ষক টেরি এল ইসলে, জাপানের রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সমাজকর্মী ইউসুকি সুগু, চীনের রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সমাজকর্মী এনডি লিন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি সাংবাদিক নিক পউল। এ সময় তারা বাংলাদেশের বিদ্যমান নির্বাচন ব্যবস্থা সম্পর্কে ইসির কাছে বিস্তারিত জানতে চান। সিইসি সংবিধানে নির্বাচনের যে ব্যবস্থা এবং ইসির সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রস্তুতি সম্পর্কে তাদের জানান। এ সময় সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়ে বিদেশী পর্যবেক্ষকরা আশ্বস্ত হন। 


বৈঠক শেষে সংবাদিকদের ব্রিফিংকালে যুক্ত রাষ্ট্রের টেনেট ফিন্যান্স ইন্টারন্যাশনাল গ্রুপের প্রতিনিধি ও নির্বাচন পর্যবেক্ষক টেরি এল ইসলে বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে স্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি অসাংবিধানিক ও অবৈধ। কারণ সংবিধান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অনুমোদন দেয় না। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে টেরি এল ইসলে বলেন, আন্তর্জাতিক প্রতিনিধি ও পর্যবেক্ষকদের পক্ষ থেকে আমরা বলতে চাই, আপনাদের নির্বাচন কমিশন সংবিধান দ্বারা অনুমোদিত, তারা স্বাধীন। সংবিধান অনুসারে সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ নির্বাচন আয়োজন করতে পারে নির্বাচন কমিশন।


ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি নিক পউল বলেন, নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। আমরা আশা করছি সংবিধান অনুযায়ী তারা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারবে।


এদিকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের রাজনৈতিক দলগুলো এখন দ্বিধাবিভক্ত। এদিকে বিএনপি ও তাদের মিত্র দলগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে না যাওয়ার ব্যাপারে অনড় অবস্থানে। অপরদিকে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও তাদের মিত্ররা সংবিধান অনুসারে দলীয় সরকারের অধীনেই সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চায়। বিএনপি তাদের দাবির পক্ষে দেশ-বিদেশে দৌড়ঝাঁপ অব্যাহত রাখলেও আন্তর্জাতিক সমর্থন পায়নি। এখন পর্যন্ত কোনো দেশ বা আন্তর্জাতিক সংস্থা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে কথা বলেনি। তবে তারা সবাই সুষ্ঠু ভোটের পক্ষে। এ পরিস্থিতিতে নির্বাচন কমিশন বিদ্যমান ব্যবস্থায় নির্বাচন করার সকল প্রস্তুতি প্রায় শেষ পর্যায়ে নিয়ে এসেছে।


রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, কোনো দেশ বা আন্তর্জাতিক সংস্থা অন্য একটি দেশের সংবিধানের বিরুদ্ধে যায় এমন কোনো পরামর্শ বা প্রস্তাব দিতে পারে না। তাই বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনের সমর্থন পেতে অনেক দৌড়ঝাঁপ করলেও সে দাবির পক্ষে কারো সমর্থন আদায় করতে পারেনি। তবে আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে সরকার ও ইসিকে সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বলা হচ্ছে।


সূত্র মতে, আন্দোলনের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মহলের সঙ্গে এখনো বিএনপি ধারাবাহিকভাবে দেন-দরবার চালিয়ে যাচ্ছে। অবশ্য অনেক আগেই বিএনপির পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন অঙ্গনে চিঠি চালাচালি করা হয়। এ পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ তাদের মিত্রদের নিয়ে সাংবিধানিকভাবেই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি জোরদার করছে। তারা সকল দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন করার চেষ্টাও করছে। এ কারণে ১৪ দলীয় জোটের সকল শরিক দল, আগে বিএনপির সঙ্গে ২০ দলীয় জোটে থাকা ক’টি দলসহ ক’টি ইসলামী দল, জাতীয় পার্টি এবং ক’টি বাম দলসহ অনেক রাজনৈতিক দলই এখন নির্বাচনের প্রস্তুতি এগিয়ে নিচ্ছে।


সূত্র মতে, বাংলাদেশের নির্বাচন পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে আসা বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের পর্যবেক্ষণের আগে পশ্চিমা দেশগুলো আগে বিএনপির প্রতি কিছুটা নমনীয় থাকলেও পরে তাদের ধারণা পাল্টে যায়। এখন তারা মনে করছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নয়, নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী অবস্থানে থেকে নিরপেক্ষ থেকে প্রশাসনকে দায়িত্বশীল করার মাধ্যমে সুষ্ঠু নির্বাচন করা যায়। এজন্য পশ্চিমা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতরা নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করে তাদের প্রস্তুতি জানতে চেয়েছেন। নির্বাচন কমিশনও তাদের সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়ে আশ্বস্ত করেছে।


বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। তাই মানুষ এখন ভোট দিতে কেন্দ্রে যায় না। আর কেন্দ্রে গেলেও ভোট দিতে পারে না। এ কারণে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া বিএনপি নির্বাচনে যাবে না।


তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া বিএনপির নির্বাচনে না যাওয়ার কথা প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, সংবিধানে যেভাবে আছে সেভাবেই নির্বাচন হবে। বিদেশীরা বাংলাদেশে এসে নির্বাচন করে দিয়ে যাবে না। সংবিধান অনুসারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনেই দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে। গণতন্ত্রে বিশ্বাস করলে বিএনপিকে নির্বাচনে অংশ নিতে হবে।


শেয়ার করুন