রাজধানীর মহাখালীতে ইনস্টিটিউট অব হেলথ টেকনোলজির (আইএইচটি) কর্মচারীদের জন্য নির্মিত চারতলা আবাসিক ভবনে চলছে ভাড়া-বাণিজ্য। অভিযোগ রয়েছে, এই বাণিজ্য করছেন ভবনটি দখলে রাখা আইএইচটি শাখা ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা। তাঁরা শিক্ষার্থীসহ বিভিন্নজনের কাছে কক্ষ-সিট ভাড়া দিয়ে প্রতি মাসে পকেটে পুরছেন আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা। সিট ভাড়া দিতে ফেসবুকে বিজ্ঞাপনও দেওয়া হচ্ছে।
অন্যের দখলে থাকায় দুই বছরের বেশি আগে নির্মাণ শেষ হওয়া ভবনটি গণপূর্ত অধিদপ্তর কয়েক দফায় চিঠি দিলেও বুঝে নিচ্ছে না আইএইচটি কর্তৃপক্ষ। তারা বলছে, তালাবদ্ধ নতুন ও শূন্য ভবন তাদের বুঝিয়ে দিতে হবে। ভবন দখলমুক্ত না করে চিঠি চালাচালিতে সময় পার করছে দুই পক্ষ। এতে একদিকে দখলদারদের পকেট ভারী হচ্ছে, অন্যদিকে যাঁদের জন্য এই ভবন সেই কর্মচারীরা উঠতে পারছেন না।
মহাখালী গণপূর্ত উপবিভাগ থেকে ভবন বুঝে নিতে চিঠি দিলেও বুঝে না নেওয়া প্রসঙ্গে আইএইচটির অধ্যক্ষ ডা. রুহী বনানী আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমাকে তালাবদ্ধ নতুন ভবন বুঝিয়ে দিতে হবে।’ ভবনটিতে যাঁরা আছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না–জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে মন্তব্য করতে অপারগতা জানান।
আইএইচটিতে ছয়টি বিষয়ে বিএসসি ইন মেডিকেল টেকনোলজি কোর্স পড়ানো হয়। এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের আবাসনের জন্য মহাখালীর ওই চত্বরে ছয়তলা ফাউন্ডেশন দিয়ে একটি চারতলা ভবন নির্মাণ করে গণপূর্ত অধিদপ্তর। আইএইচটি প্রাঙ্গণে টিনশেডে প্রতিষ্ঠানের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা বসবাস করছেন।
আইএইচটির প্রাক্তন একাধিক শিক্ষার্থী, কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী ও স্থানীয়রা আজকের পত্রিকাকে জানান, করোনার সময় মানবিক বিবেচনায় কয়েকজন শিক্ষার্থীকে নির্মাণাধীন ওই ভবনে থাকতে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু নির্মাণ শেষে ভবনটি দখল হয়ে গেছে। ভবনটি দখলে রেখে বিভিন্ন কক্ষ ও সিট আইএইচটি, সরকারি তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীসহ বিভিন্নজনের কাছে ভাড়া দিয়ে টাকা তুলছেন নেতারা। প্রতি মাসে আড়াই থেকে ৩ লাখ টাকা ভাড়া ওঠে। আইএইচটি শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও বর্তমানে ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাগর আহমেদ শামীমের নামে এই দখল ও ভাড়া-বাণিজ্য শুরু হয়। তিনি মহানগরে পদ পাওয়ার পর আইএইচটি ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আপন ইসলাম এতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ছাত্রলীগের নেতাদের সঙ্গে দুজন কর্মকর্তাও জড়িত আছেন।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাগর প্রথমে উত্তেজিত হয়ে বলেন, এই প্রতিবেদকের কাছ থেকে ভবন বুঝে নেবেন। প্রায় এক ঘণ্টা পর তিনি মোবাইলে ফোন করে বলেন, ভবন দখলের বিষয়টি তিনি জানেন না। খোঁজ নিয়ে দেখবেন। এমন হয়ে থাকলে ভবনটি কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করবেন।
এদিকে আপন ইসলামের দুটি মোবাইল ফোন নম্বরে গত বুধবার বিকেল সাড়ে ৪টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত ছয়বার ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, বেদখল কর্মচারী আবাসিক ভবনে রুম-সিট খালি আছে, ছাত্রদের ভাড়া দেওয়া—এমন বিজ্ঞাপন ফেসবুকে পেজ খুলে দেওয়া হয়। আজকের পত্রিকার হাতে এমন কিছু বিজ্ঞাপন আছে। টু-লেট মহাখালী এবং তানভির মেহেদী নামের দুটি আইডি থেকে এসব বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। একটি বিজ্ঞাপনে আছে, ‘চলতি মাসে মহাখালী জনস্বাস্থ্য এলাকায় দুজনের একটি রুম ৩য় তলায় এবং নিচতলায় একটি সিট ভাড়া দেওয়া হবে।’ টু-লেট মহাখালীতে লেখা হয়েছে, ‘আগামী মাস থেকে মহাখালী আইএইচটি মসজিদের পেছনের বিল্ডিংয়ে দুজনের জন্য রুমে এক সিট খালি হবে—বিস্তারিত ইনবক্সে’।
আইএইচটি, স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর ও গণপূর্ত অধিদপ্তর সূত্র বলেছে, ভবনটি নির্মাণ শেষ হওয়ার পর গণপূর্ত অধিদপ্তর বারবার আইএইচটিকে বুঝে নিতে চিঠি দিয়েছে। মহাখালী গণপূর্ত উপবিভাগের উপবিভাগীয় প্রকৌশলীর দপ্তর ২০২১ সালের ২১ নভেম্বর আইএইচটিকে ভবন বুঝে নিতে চিঠি দেয়। ২০২২ সালের ২২ এপ্রিল আইএইচটির অধ্যক্ষ মহাখালী গণপূর্ত উপবিভাগকে চিঠি দিয়ে বলেন, ভবনটি তালাবদ্ধ নেই, কে বা কারা অবস্থান করছে। তাই বুঝে নেওয়া যাচ্ছে না। ভবনটি তালাবদ্ধ অবস্থায় বুঝিয়ে দিতে অনুরোধ করা হয়। চলতি বছরের ১৫ জুন অধ্যক্ষ ডা. রুহী বনানী স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে দেওয়া চিঠিতেও ভবনে কে বা কারা বসবাস করছেন বলে উল্লেখ করেন। ১৬ জুলাই স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) ডা. মোস্তফা খালেদ আহমেদ গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলীকে এক চিঠিতে আইএইচটির অধ্যক্ষের চিঠি অনুযায়ী ভবনটি বুঝিয়ে দিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করেন।
মহাখালী গণপূর্তের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী রেজাউল করিম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা ভবন বুঝে নিতে আইএইচটিকে বারবার চিঠি দিলেও তারা বুঝে নিচ্ছে না।’
ভবনটির সর্বশেষ অবস্থা জানতে চাইলে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) ডা. মোস্তাফা খালেদ আহমেদ বলেন, ভবনটি খালি করে বুঝিয়ে দিতে বলা হয়েছে। গণপূর্ত অধিদপ্তরের এখনো সেটি করেনি। ভবনটি কারা দখলে রেখেছে—জানতে চাইলে তিনি বলেন, জানেন না। কত দিন চিঠি চালাচালি হবে–এ প্রশ্নে বলেন, পরবর্তী সময়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেবে।